বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

বিএনপির হরতাল ও আইন প্রতিমন্ত্রীর ‘পোস্ট বক্স’


জামিন নাকচ করার মুখ্য কারণ আসামিদের পালানোর আশঙ্কা, যা এ ক্ষেত্রে ছিল না
জামিন নাকচ করার মুখ্য কারণ আসামিদের পালানোর আশঙ্কা, যা এ ক্ষেত্রে ছিল না
বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ জন নেতাকে তাৎক্ষণিক কোনো কারণ না দেখিয়ে জামিন নাকচ করেছেন নিম্ন আদালত। দীর্ঘ শুনানির পরে দু-তিনটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন আদালত। যে ঘটনা দেশব্যাপী একটি হরতালের জন্ম দিল, সেখানে বিচারকের জবানিতে জামিন নাকচের কারণ জানতে পারলাম না। অথচ জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কেন জামিন পাবেন বা পাবেন না, তার কারণ বিচারকেরা যাতে লেখেন, সে রকম বাধ্যবাধকতা সিআরপিসির ৪৯৭ ধারায় আছে। তবে ৩৩ নেতাকে জামিন না দিতে এই আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, সেটা আদালতের চূড়ান্ত লিখিত আদেশ দেখে বলা যাবে। জামিন নাকচ করার মুখ্য কারণ আসামিদের পালানোর আশঙ্কা, যা এ ক্ষেত্রে ছিল না। তবে যে কারণে এই নিবন্ধ, তা হলো সুপ্রিম কোর্টের বিএনপির আইনজীবীদের সুবিধাবাদী ও খণ্ডিত প্রতিক্রিয়া। আদালতের স্বাধীনতার জন্য তারা হরতাল করেনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন গতকাল একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি অধস্তন আদালত ঠিকঠাক না চলা ও তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ না করার বিষয়ে যা বলেছেন, তা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু লক্ষণীয়, পদ্ধতিগত যে কালাকানুন বর্তমানে বহাল আছে এবং যার অপব্যবহার চলছে তা বিলোপ করে দিতে তাঁরা নীরব। দুই বড় দল কাদা ছোড়াছুড়ি করে বলে আমরা কত আক্ষেপ করি। কিন্তু তাঁরা সেয়ানা পাগল। বিএনপি কাদার দলা ছুড়তে পারে। বলতে পারে, উঠতে-বসতে সামরিক শাসক বলে আমাদের নেতাকে গাল পাড়েন। অথচ এক বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট তিনটি ফরমান শিরোধার্য করলেন। অথচ জিয়াকে শেরপা মানছেন না। তিনি তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঘোষক! এ কথা মুখ ফুটে বেগম খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুলেরা বললে কেমন আনন্দ হতো বলুন। জ্যৈষ্ঠের এই কাঠফাটা তপ্ত হরতালীয় আবহাওয়াটা কেমন রঙিন হতে পারত। কিন্তু বিএনপি এতটা বেরসিক নয় যে এসব বলে আওয়ামী লীগকে শরম দেবে। এই যে মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না অবস্থা, কেন। কারণ, রাষ্ট্রের চরিত্র যাতে গণমুখী না হয়, এটা যাতে সামন্ততান্ত্রিক থাকে, সে বিষয়ে আমাদের এই দুই কলহপ্রিয় শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে তফাত নেই।
বিএনপির এখনকার সমস্যা হলো, কালাকানুনটা থাকুক, আমজনতাকে ঠ্যাঙ্গাও। আমাদের নেতাদের কেন। আর ক্ষমতায় গেলে আমরাও সুবিধা নেব। তোমরা তখন চিল্লাবে। গলা ফাটাবে। আমরা তখন এই নজিরবিহীন গ্রেপ্তারের নজির হাজির করব। মহানগর হাকিমের আদালতে আমরা বুধবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ধাক্কাধাক্কি দেখেছি। তারা দরকারে মারামারিও করতে পারে। সুপ্রিম কোর্টে গতকাল সরকারদলীয়দের চাপা উত্তেজনা ছিল। বিএনপির আইনজীবীরা সমিতি ভবন থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক পর্যন্ত মিছিল করেছেন। আমরা এটা দেখতে চাইব যে, মিছিল করতে করতে তাঁরা একদিন প্রধান বিচারপতির দরোজায় যাবেন। লাথি মারতে নয়, সৌজন্য ও মর্যাদার সঙ্গে প্রতিবাদ জানাতে। প্রশ্ন তুলতে নিম্ন আদালতে বদলির ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে কেন। 
বিরোধী দলের ৩৩ নেতাকে কারাগারে পাঠানোর এজাহার দুটো আমি পড়েছি। এর বাক্য গঠন বালখিল্য, হাসির উদ্রেক করে। একটি বাক্য পড়ে মনে হলো, দেশপ্রেমিক পুলিশটি তো আমাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নেত্রী সাহারা খাতুনের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের অনুমতি চাইতে পারতেন। গাড়ি পোড়ানোর মামলায় সাজা দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। ওই ধারায় ফেললে যাবজ্জীবন।
৩৩ নেতাকে জেলজীবনের স্বাদ দেওয়া আসলে বিচার বিভাগ পৃথককরণ যে কার্যকর অর্থে ঘটেনি, তা-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এর আগে আমি নিম্ন আদালতে জামিন না চেয়ে কেন নেতারা উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন তার সমালোচনা করেছিলাম। বস্তুত এটাই রুঢ় বাস্তবতা। সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিক এবং এমনকি সুুপ্রিম কোর্ট নিজেও অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা পুরোপুরি ধারণ করতে পারছেন না। অধস্তন আদালতের চেয়ে এখনো উচ্চ আদালত অধিকতর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তবে সব সময় নয়।
অধস্তন আদালতের স্বাধীনতার সঙ্গে তাদের কর্মস্থল নির্ধারণ, বদলি ও পদন্নোতি এতটাই তীব্র ও ব্যাপক ভূমিকা রাখে যে, অন্য আর কোনো কিছুই এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখানে বিরাট অবিচার ও অনাচার চলছে। এ বিষয়ে বিএনপি কোনো নীতিগত অবস্থান নিতে পলায়নপর রয়েছে। তারা আসলে আওয়ামী লীগ যেভাবে বিচার বিভাগ চালায়, তারাও সেভাবেই চালিয়ে এসেছে এবং সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে চালাবে। সে কারণে তারা সহজ হরতাল পাঠ করে। নির্দিষ্টভাবে, কোমরে গামছা বেঁধে বিচারিক স্বাধীনতায় ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপের মুখোশ উন্মোচন করে না। হরতালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করি। কিন্তু চাপের মুখে বিচারকের অন্যায্য বদলি যে হরতালের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর, তা আমরা চিন্তা করি না।
আমাদের চামড়া গন্ডারের চেয়েও শক্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশের আইনকানুন কোথায় কীভাবে লেখা আছে আর কে কীভাবে তা প্রয়োগ করছে এবং তাতে মানুষ তার প্রতিকার পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, তা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো বিতর্ক নেই। ৩৩ নেতা জামিন পেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয়, তা নিয়ে কোনো কথাবার্তাই উচ্চারিত হতো না। বারের সভাপতি দায়সারা হলেও বলেছেন, ‘সম্প্রতি সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে বিচার বিভাগ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।’ সত্য হলো, এই সরকার আগাগোড়া বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। এটা কোনো ‘সাম্প্রতিক’ প্রবণতা নয়।
ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বুধবার বাহাস করলেন। খন্দকার সাহেব নির্দিষ্টভাবে একটি পৃথক সচিবালয় গঠনের কথা বললেন। সেটা অর্থহীন, যদি না সংবিধান শোধরানো হয়। আইন প্রতিমন্ত্রী ধারণা দিলেন, ৩৩ নেতার সম্পৃক্ততার যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকার কারণেই আদালত তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করেছেন। বারের সভাপতি বলছিলেন, অধস্তন আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর আইন প্রতিমন্ত্রী তা খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি ছাড়া তাঁরা বিচারকদের কোনো একটিও বদলির আদেশ দিতে পারেন না এবং দেন না। একটি শব্দ তিনি ইদানীং খুব ব্যবহার করছেন। সেটা হলো, তাঁরা নাকি পোস্ট বক্স। সবই করা হয় সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনে। আচ্ছা ‘পোস্ট বক্স’ যদি এতই ফেলনা হবে, তাহলে এটা আঁকড়ে থাকা কেন। ফেলে দিন। ওটা তো সামরিক ফরমানের সৃষ্টি এবং সেটা অবশ্যই অধস্তন আদালতের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। এটা ডেমোক্লেসের সেই তরবারি, এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, থাকতে পারে না এবং থাকার প্রশ্নই আসে না।
সুপ্রিম কোর্টের যে সত্তা অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি একান্তভাবে প্রশাসনিক। তাই আদালত অবমাননার ভয় করি না। নিম্ন আদালতের কতিপয় বিচারক ঢাকায় একটি বদলি পাওয়ার জন্য জান কোরবান করতে প্রস্তুত থাকেন। বিড়ালের ইঁদুর ধরার মতো সরকারও এর সুযোগ নিতে ওত পেতে থাকে। আমরা দালিলিকভাবে প্রমাণ দিতে পারি, সরকারের অস্বচ্ছ ইচ্ছা পূরণে সুপ্রিম কোর্ট কখনো কখনো কীভাবে পোস্ট বক্সের মতো কাজ করেন। প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর (বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান), বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী এবং বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিঞা সমন্বয়ে একটি জিএ কমিটি রয়েছে। তাঁরা সরকারের প্রস্তাবক্রমে বিচারকদের বদলি অনুমোদন করেন।
আমরা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটির কতিপয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজকে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবস্থান গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। শ্রদ্ধাভাজন বামপন্থী নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে একদিন বলেছি এবং সবাইকে বলি, এসবের বিরুদ্ধে আপনারা কেন নির্দিষ্টভাবে আওয়াজ তুলছেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো বিমূর্ত নয়। এর যেটুকু ছুঁয়ে পরখ করা চলে, সেটুকু খতিয়ে দেখুন। কেন আপনারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সুপ্রিম কোর্টের ফটকে ধরনা দিচ্ছেন না। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেই এই শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। কিছু জবাবদিহি প্রধান বিচারপতিকে সরাসরি করতে হবে। মন্ত্রীদের কাছে তার ব্যাখ্যা শুনতে চাই না। মার্কিন প্রধান বিচারপতি রবার্ট সম্প্রতি বিচারকদের আচরণবিধি মানা না-মানা নিয়ে একটি বৃিবতি দিয়েছেন, তেমন বিবৃতি আমরাও শুনতে চাই।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শতাধিক জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়ে একজন বিচারকের প্রতি সীমাহীন পক্ষপাতিত্ব দেখানোর সরকারি প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে থামিয়ে দেন। আইন মন্ত্রণালয়ে বিচারকেরা যাতে মাজা সোজা করে বসতে না পারেন, সব সময় খাড়া থাকেন, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে স্থায়ী সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না।
দেশে আইনের শাসন কি আর কে তা মানে তার একটা নজির দেই। ৩৩ নেতার জামিন থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও দিতে পারতেন। এ কথা শুনে অনেকেই আঁৎকে উঠতে পারেন। আইনে থাকলেও এদেশে এর প্রয়োগ নেই। চোর ধরতেও কখনও প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য কড়া নির্দেশ লাগে। তাই দেখার বিষয় হলো, যে কাজ একজন দারোগা সারতে পারতেন, সেটার জন্য আমরা সুপ্রিম কোর্টের দেয়াল টপকিয়ে রাতবিরাতে নেতাদের দৌড়াদৌড়ি দেখলাম। হাইকোর্টে কত বিভক্ত রায়, তৃতীয় বেঞ্চের রায়। কত মিছিল মিটিং, হরতাল, জ্বালাও পোড়াও। সিআরপিসির ৪৯৭ ধারা অজামিন যোগ্য ধারায় অভিযুক্তকে জামিন দিতে আদালত ও দারোগাকে একই মর্যাদায় দেখেছে। অথচ আমরা এর সমপ্রয়োগ চাই না। পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় বসাতে দুই দলই অপ্রস্তুত। পুলিশকে তারা পেটোয়া বাহিনী হিসেবেই দেখতে চায়। এরা পিটিয়ে শিক্ষক মারে, রিমাণ্ডে নিয়ে মানুষ নির্যাতন করে। গাড়ি ভাংচুর, বাস পোড়ানোর প্রতিকার আমরা পাই না, দূষিত রাজনীতিতে সমাহিত হয়। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সরকারি দল থেকে পুলিশের পৃথককরণ ও বিরাজনীতিকীকরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
শেষে একটা কথা বলি। ৩৩ নেতার কেউ যেহেতু বিচার থেকে পলাতক হতেন না, তাই তাদের জামিন না দেওয়ায় বিচারবিভাগ পৃথককরণ পরবর্তী অধস্তন আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। সাধারণ রীতি হচ্ছে জামিন দেওয়াই বিধি না দেওয়াই ব্যতিক্রম।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন