রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

মাননীয় প্রধান বিচারপতি রায়টি প্রকাশ করুন


অনেক দিন পর নির্দিষ্ট খবর পেলাম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্টের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানালেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বহুল আলোচিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চূড়ান্ত করেছেন। তবে এটা গল্পের শুরু না শেষ, তা স্পষ্ট নয়। এই রায়ে আমাদের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে বললে ভুল হবে না। 
বিরোধী দল এখন ইলিয়াস আলীতে, পরে অন্য ইস্যুতে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে যেতে পারে। মুখে তারা যা-ই বলুক, তাদের অন্তরে মসনদ, সেখানে যাওয়ার মওকা হিসেবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। আমরা চাই সাংবিধানটা যাতে আস্ত থাকে। তা ছাড়া ক্ষমতাসীনেরা ও তাঁদের দ্বারা পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত এমন কিছু করে দেখাতে পারেনি, যাতে আমরা ভরসা করতে পারি। অন্যদিকে বিরোধী দলের এমন মুরোদ নেই যে, তারা শান্তি বজায় রেখে ১৫তম সংশোধনীতে বিলোপ হওয়া তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাটা ফিরিয়ে আনতে পারে। সুতরাং আপিল বিভাগ এক বছর আগে যে বলেছিলেন, আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হতে পারে, তা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না। 
আমি তো ভয়ডর ভুলে বলেই রেখেছি, ১৫তম সংশোধনীতে বাতিল হওয়া সত্ত্বেও আগামী দুই মেয়াদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় নির্বাচন করার একটি আইন এখনো বেঁচে আছে। সহজ করে বললে এটি সর্বোচ্চ আদালতের ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে’ আছে। অক্সিজেনের নল খুলে না ফেললে তো তাকে মৃত ঘোষণা করা যাবে না। এখন এই নল কীভাবে, কী আছে, সেটাই লেখা থাকবে কিংবা থাকা উচিত আপিল বিভাগের ওই রায়ে। 
বিচারপতি খায়রুল হক রায়টি বাংলায় হাতে লিখেছিলেন। ছিল নাকি প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠা, টাইপ করার পর প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের গোড়ায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ওই মামলায় রায়দানকারী অন্যান্য বিচারকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। এটি বিভক্ত রায়। জনগণকে আদালত শুধু বলেছেন, তাঁরা এ রায় লিখতে একমত হতে পারেননি। কেন কী কারণে এই বিভক্তি, তা পুরোটা আন্দাজ করা চলে না। সাত বিচারকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে হলে চার তো লাগবেই। সুতরাং অন্তত চারজন পক্ষে ও সর্বাধিক তিনজন বিপক্ষে বলে মনে করা চলে। 
সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিদায়ী প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছেন তেমনটা বলেন ওই কর্মকর্তা। কিন্তু সবাই তাতে স্বাক্ষর সম্পন্ন করেছেন কি না, তা তিনি নিশ্চিত করেননি।
সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার রায়ে সংখ্যালঘু এক বা একাধিক বিচারক কী অভিমত দেবেন তা গুরুত্বপূর্ণ। আইনের চোখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলাটি এখনো সাবজুডিশ বা বিচারাধীন। আওয়ামী লীগ জবরদস্তি একটি বিচারাধীন বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সংবিধান থেকে মুছে ফেলেছে। আদালতের রায়টি অবশ্য তারা মোছেনি। 
যেকোনো বিশেষজ্ঞ তা তিনি যে দলের সমর্থকই হোন না কেন, তাঁকে তত্ত্ব ও তর্কের খাতিরে হলেও মানতে হবে যে রিভিউতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। এমনকি যে বিতর্কিত ১৫তম সংশোধনীর বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়নি, সেটিও শুনানির প্রতিপাদ্য হতে পারে। কেউ বলবেন বাহে আপনার মস্তিষ্ক দেখছি অতিশয় উর্বর! আমি কাষ্ঠ হেসে সায় দেব। কিন্তু কেউ কি বলবেন, আমার এ যুক্তির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই? 
আপিল বিভাগের রায়ে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র অবৈধ বলে সাব্যস্ত হয়। নির্বাচন কমিশন তাঁর সদস্যপদ খারিজ করে প্রজ্ঞাপনও জারি করে। আপিল বিভাগের রায়ের পর কীভাবে তিনি সাংসদ পদে বহাল, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করেছেন। প্রধান বিচারপতির হাত ঘুরে সেই রুলের শুনানি যখন শুরু হতে যাবে, তখন ড. খানের আইনজীবী হাইকোর্টকে একটি তথ্য দিয়েছেন; বলেছেন, আপিল বিভাগের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করা হয়েছে। যদিও আপিল বিভাগ স্টে দেননি। এটি হল রিভিউর শক্তি। ড. খান একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে বহাল আছেন। 
সন্দেহ নেই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলার রায় ঝুলিয়ে রেখে ইতিমধ্যেই এই উপমহাদেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের ইতিহাসেও এর নজির নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের অজান্তে পাকিস্তানকেই অনুসরণ করে থাকি। মুখে সারাক্ষণ গালাগালি দিই। কিন্তু কখন যেন আমরা তাদেরই অনুসরণ করতে থাকি। বহু ক্ষেত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীর বিপ্লবী ভূমিকায় আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারকদের এক সমাবেশে ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীর বাংলাদেশি মডেল খুঁজেছিলেন! কিন্তু আমি নিশ্চিত, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক ভূমিকার পর অনেকেই আর অমন কথা মুখে আনবেন না। এখন তাঁরা বহু ক্ষেত্রে দলীয় সরকারের খাস তালুক শাসনের প্রবণতা দেখাচ্ছেন। 
নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, জাতীয় সংসদ নয়, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। তারা এখন ‘তৃতীয় খেলোয়াড়।’ প্রধান বিচারপতি ইফতেখার এমন আদেশ দিচ্ছেন জেনারেল কায়ানি কিংবা জেনারেল পাশাকে সরকার বরখাস্ত করতে চায় কি না। পাকিস্তানে এখন জেনারেল, বিচারক ও রাজনীতিকদের লড়াই ত্রিমুখী হয়ে উঠেছে। ইফতেখার চৌধুরীকে নিয়ে যাঁরা রাজপথে অগ্রণী সিপাহসালার ছিলেন, তাঁদের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বারের সাবেক সভাপতি মুনির-এ-মালিক তাঁদের অন্যতম। তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদে এটা একটা ভয়ংকর প্রবণতা। বিচারকেরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। অথচ তাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগে এতটাই মত্ত হয়ে উঠেছেন যে মনে হচ্ছে, তাঁরাই দেশের একমাত্র পবিত্র প্রতিষ্ঠান। সব জাতের স্বৈরশাসক এই মনস্তত্ত্বে ভোগে। তাঁরা মনে করেন, আমরাই শুধু পরিচ্ছন্ন এবং সব সঠিক কাজ করতে সামর্থ্যবান।’ 
আমরা বিচারকদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দ্বিমুখী লড়াই ক্রমশ স্পষ্ট হওয়ার লক্ষণগুলো দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে। রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মামলাগুলোতে বিব্রত হওয়া, এমনকি রুল জারি প্রশ্নে বিভক্ত হওয়া একটা নিয়মিত প্রবণতা হতে চলেছে। এটা এখনই প্রশমিত না হলে ভবিষ্যৎ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তা আমরা কেউ জানি না। 
বাংলাদেশে গত সাড়ে তিন বছরে উচ্চ আদালতের কাছ থেকে এমন সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত পাওয়া গেছে, যা একসময়ে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনার মধ্যে ছিল না। সুতরাং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর-প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে উচ্চ আদালতের সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত কিংবা হস্তক্ষেপ এবং তার ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিরোধ মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। সে কারণে আইন শুধরে নির্বাচনী মামলা দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে ফয়সালার দায়িত্ব হাইকোর্টকে দেওয়া হয়েছিল। সেই ভরসার জায়গা অটুট আছে কি? 
আগামী সাধারণ নির্বাচন এমন একটি পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলো ক্ষমতাসীন দলের কবজায় থাকবে। ১৯৯০ সালের পর যাঁরা জন্ম নিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে ভোটার হয়েছেন, তাঁদের জীবনে এটি হবে পুরোপুরি নতুন অভিজ্ঞতা। সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিন আগে নির্বাচন কমিশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল ঘোষণা করবে। সুতরাং প্রত্যেক মন্ত্রী ও সাংসদ পূর্ণমাত্রায় ক্ষমতা প্রয়োগ করার অবস্থায় থাকবেন। এই পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণ গত ২২ বছরে কেউ দেখেনি। এই অসাধারণ অবস্থা সামাল দিতে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের উপযুক্ত বিধিবিধান তৈরি করার কথা ভাবছে বলেও জানা যায় না।
স্পিকার আবদুল হামিদ সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র নাকচ করে যে মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তাকে তীব্রতা দেবে। ক্ষমতাসীন দলের সংবেদনশীলতায় অভিঘাত সৃষ্টি হয় এমন সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সাংবিধানিক সংস্থাগুলো যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ও সামর্থ্যের অভাব দেখিয়ে চলেছে। স্পিকার তাঁর নিরপেক্ষতার কফিনে আর একটি পেরেক ঠুকলেন। 
যে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায় লেখা হয়েছিল, তার চেয়ে এখন রাজনৈতিক সংলাপের পরিবেশের আরও অবনতি ঘটেছে। হিলারি ক্লিনটনের সংলাপের তাগিদের পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা সক্রিয় হয়েছেন। কিন্তু কার্যকর সংলাপের কোনো নড়াচড়া টের পাই না। তাই সার্বিক বিচারে আপিল বিভাগের ওই রায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। 
বিলম্বিত রায় লেখার জন্য মাননীয় বিচারপতিগণ দ্বারা অধস্তন আদালতের বিচারকদের শাস্তিদান বা তিরস্কার করা একটা রুটিন ব্যাপার। সমগ্র জাতি একটি অন্ধকার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে কি না বলে প্রশ্ন উঠছে। সেখানে তা থেকে উত্তরণের সুপ্রিম কোর্ট বাতলানো পথ তো যাচাই না করে ফেলে রাখা যায় না। সময় দ্রুত গড়াচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে বিবদমান দলগুলো কী পাবে বা পাবে না, সেটা ভিন্ন বিষয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কোনো কিছুতেই প্রলয় ঠেকানো যাবে না।
তবে এটুকু বুঝতে পারি, পূর্ণাঙ্গ রায় এমন লেখার সুযোগ নেই, যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই মেয়াদে নির্বাচনের সুযোগ রুদ্ধ বা তা আরও সংকুচিত হতে পারে। ইতিমধ্যেই ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশকে উল্টে দেওয়ার নিয়ম নেই। এমনকি ১৫তম সংশোধনী ও তার পরের আইনগত অবস্থাটিও আপিল বিভাগ বিবেচনায় নিতে পারেন না। যে বিচারবুদ্ধিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা দুই মেয়াদের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, তাতে তাঁদের দূরদর্শিতাই প্রমাণিত হচ্ছে। সে কারণেই মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, রাজনীতিতে যা হওয়ার হবে, অনতিবিলম্বে রায়টি জাতির সামনে প্রকাশ করা হোক। সুপ্রিম কোর্টের দায় তো ঘুচুক। তাঁদের রায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফর্মুলা আছে—জনমনে এ ধারণা কমবেশি ছড়িয়ে আছে। জাতীয় রাজনীতির সংকটের সঙ্গে আদালতের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার এমন অভাবনীয় আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ার এই প্রেক্ষাপট আমরা তো কল্পনা করতে প্রস্তুত ছিলাম না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন