মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

তাঁরা কেন ছোট কোর্টে গেলেন না?


হরতালীয় নাশকতার দুটি মামলার এজাহার পাঠ করে অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে। কিন্তু আজ সেটা আলোচনা করা লক্ষ্য নয়, এটা আমরা বুঝতে চাইব যে এতসব হুলুস্থুল কাণ্ড করে বড় নেতারা কেন রাতবিরাতে বড় কোর্টে আসেন। ছোট কোর্টে কেন যান না। ছোট কোর্ট পুরান ঢাকায়। সেখানকার একটি খাবার হলো ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। আমরা যারা বড় বাপের পোলা, তারা কেন পুরান ঢাকায় যাই না। বিএনপির নেতারা বড় কোর্টে বলেছেন, ছোট কোর্টেই যাব। তবে পথে পুলিশ ধরে ফেলবে। তাই আগাম জামিন দিন। এটা সর্বাংশে সত্য মনে হয়? আইন বলছে, আগাম জামিন দিতে কারণ লিখতে হবে। প্রায়শ জামিনের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে কারণ লেখা দেখি না। 
বিচার বিভাগ পৃথককরণ পুরা করার কথা দুই বড় দলের কেউ মুখে আনে না। মিডিয়া কিংবা বার তাতে তেমন মাইন্ড করে না! দুই বড় দলের চিরচেনা গান জনগণ জানে। জামিন পেলে আদালত স্বাধীন, না পেলে সরকারের অধীন। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। বিচার বিভাগ একটি গভীর অসুখে ভুগছে। উচ্চ আদালত সব সময় নিম্ন আদালতকে ধারণ করছেন বলে মনে হয় না। 
মির্জা ফখরুল, এম কে আনোয়ার, খোকন, প্রমুখ বিএনপির নেতা কটা দিন পালিয়ে বেড়ালেন। শাহবাগের এজাহার বলছে, সচিবালয়ে ‘একটি কালো রঙের মোটরসাইকেলে দুজন অজ্ঞাতনামা যুবক আসিয়া দুইটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাইয়া পালাইয়া যায়।’ পুলিশ তাদের ধরতে পারার দাবি করেনি। কিন্তু মহাবিজ্ঞ এসআই ২৮ জন আসামি আবিষ্কার করে মামলা ফেঁদেছেন। দ্বিতীয় মামলাটি বাস পোড়ানোর। এই মামলার নির্দিষ্ট আসামি ৩৬ জন। এর এজাহারেও নির্দিষ্টভাবে পুলিশ দাবি করেনি যে মির্জা ফখরুলরাই আগুন দিয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়াল? নেতারা ককটেল ছোড়েননি, বাস পোড়াননি। তাহলে কী করেছেন? এজাহারের দাবি, যারা এসব করেছে, নেতারা তাদের টাকা দিয়েছেন। এ মামলাটি হরতালে আওয়ামী লীগকে সাইজ করতে বিএনপির তৈরি করা ২০০২ সালের আইনে করা হয়েছে। মামলা দায়ের থেকে সাত দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র ও ৩০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার মন্ত্র আছে আইনে। কিন্তু দল করা কোনো বড় বাপের পোলায় এ পর্যন্ত দণ্ডিত হয়েছেন বলে জানি না। এবারও হবে না।
আগাম জামিন নিয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি দ্বৈত বেঞ্চ দুটি বিভক্ত রায় দিলেন। একটি নজিরবিহীন ঘটনা। মির্জা ফখরুলরা সিআরপিসির ৪৯৮ ধারার আওতায় আগাম জামিন চান। কোনো আইনেই আগাম জামিন দেওয়ার বিধান নেই। সংসদ তা বিলুপ্ত করলেও হাইকোর্ট তা টিকিয়ে রেখেছেন। আদালতের তৈরি আইন বলছে, আগাম জামিন এক অতীব অসাধারণ প্রতিকার যা বিরল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটা দায়রা জজও দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে শুধু হাইকোর্ট দেন। 
এখন বড় কোর্ট যদি বলতেন, আপনারা এখানে কেন, ওখানে নয় কেন? তাহলে মানুষ প্রশ্ন করতে শিখত, এত কাঠখড় পুড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের ক্যাম্পাসে এক কাপড়ে রাত কাটানোর দরকারটা কী? তাঁরা লুকিয়ে যদি হাইকোর্টে আসতে পারেন, তাহলে লুকিয়ে কেন অনতি দূরের ছোট কোর্ট বা জজ কোর্টে নয়? 
মির্জা ফখরুল ও খোকন সাহেবরা তাঁদের আবেদনে লিখেছেন, ‘যদিও হাকিমের আদালত এখন স্বাধীন কিন্তু তাঁদের চাকরি এখনো সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবেদনকারীরা শংকিত যে নিম্ন আদালতে তাঁরা যথাযথভাবে এবং আইনগত প্রতিকার নাও পেতে পারেন।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কথা নাগরিকদের জন্যও প্রযোজ্য বলে বিএনপি নেতারা মনে করেন কি না? সংবিধানে আইনের চোখে সব নাগরিকের সমতার কথা লেখা আছে। 
ভয়ের কথা, আগাম জামিন ক্রমবর্ধমান হারে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। এবং বার ও বেঞ্চ উভয়ে লিখিতভাবে তাঁর প্রমাণ রাখছেন। বার পক্ষ বলছে, ‘তিনি সংসদ ও বারের সদস্য। তাই তিনি আগাম জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে লিগ্যাল প্রিভিলেজ বা আইনগত বিশেষাধিকার আশা করতে পারেন।’ রাষ্ট্রপক্ষের বরাতে বেঞ্চ তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীকার করেন যে অভিযুক্ত আবেদনকারী সাংসদ ও বার সদস্য হিসেবে আগাম জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর ভালো অবস্থানে রয়েছেন।’ রায় দিতে গিয়েও তার যথার্থতা দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকারান্তরে আইনি অসমতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। 
আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে আমরা এভাবে আর বেশি দূর যেতে পারব কি না। অনেক ক্ষেত্রে আগাম জামিন মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটা চলতি সময়ের এক অপ্রিয় বাস্তবতা। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক চেহারা দেখে রায় দেওয়ার কথা অকপটে বলে থাকেন।
দিনে দিনে আগাম জামিনের প্রশ্নে হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায়ের সঙ্গে আরেকটির সংঘাত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বিএনপির নেতা, বারের বড় সদস্য এবং সংসদের সদস্য। বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক এবং বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে তাঁর আগাম জামিনের শুনানি হলো ২ ও ৩ মে। 
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আগাম জামিন প্রশ্নে একটি রায় দিয়ে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ এই কলামে লিখেছিলাম, এই রায় যথেষ্ট নয়। এর আলোকে নতুন আইন করতে হবে। ওই রায়ের পরে বেশ কিছুদিন হাইকোর্ট বেঞ্চগুলো আগাম জামিন দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মির্জা ফখরুলরা পলাতক হিসেবে হাইকোর্টে যান। তাই আমি আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ওই রায় কীভাবে শুনানিতে এসেছে, তা জানতে উদগ্রীব হই। এই রায়টি ৬২ ডিএলআর-এ ছাপা। মজার বিষয় হলো, এই রায় শুনানিতে আসেনি।
খোকন সাহেবকে জামিনদানকারী প্রথম বিচারক আনোয়ারুল হক সতর্কতার সঙ্গে ‘সাত দিনের’ জন্য পুলিশ ও ছোট কোর্টের কর্তব্য রদ করেন। সাফ বলে দেন, সাত দিন পরে তাঁকে দেওয়া আগাম জামিনের অস্তিত্ব থাকবে না। ৯ তারিখে যখন তিনি আত্মসমর্পণ করবেন, তখন আদালত স্বাধীনভাবে উচ্চ আদালতের জামিনের আদেশের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তাঁর এই রায়ের সঙ্গে একমত হননি কনিষ্ঠ বিচারপতি মজিবুর রহমান মিঞা। তিনি দ্বিমত পোষণ করে যা বলেন, তা-ই আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য। তাঁর কথায়, ‘নিম্ন আদালত স্বাধীন বলে আবেদনকারী মেনে নিয়েছেন। তাহলে তিনি কেন নিম্ন আদালতে না গিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেবেন, তা ব্যাখ্যা করেননি। সে কারণে জামিনের দরখাস্ত নাকচ করা হলো।’ খুবই দামি কথা। কিন্তু ৬২ ডিএলআরের ব্যাখ্যা নেই কেন, সেটা আমাদের প্রশ্ন।
এরপর আগ্রহ ছিল, তৃতীয় বিচারক নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা প্রশ্নে কী বলেছেন। তিনি কিছুই বলেননি। মনে করা হয়, জেলা জজদের মধ্য থেকে যাঁরা হাইকোর্টে বিচারক হন, তাঁরা নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার প্রশ্নে বেশি সংবেদনশীল। 
হরতাল মামলার আগাম জামিন নিয়ে তিনটি আলোচিত বেঞ্চের জ্যেষ্ঠরা সবাই জেলা জজ ছিলেন। প্রথম বিভক্ত রায়ের পরে গঠিত এক সদস্যের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি খন্দকার মুসা খালেদও কিন্তু তাঁর রায়ে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট রায়গুলোর ব্যাখ্যা দেননি। এমনকি তিনি কেন উল্লিখিত কনিষ্ঠ বিচারকের অভিমতের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না, তারও ব্যাখ্যা দেননি। সেখানেও ব্যক্তির মহিমা স্বীকৃত। বলা হয়েছে, তিনি সাংসদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, তাঁর মতো লোক পালিয়ে যেতে পারেন না।
পাঠক লক্ষ করবেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এমন সব কারণে জামিন চাইছেন এবং আদালত তা মঞ্জুর করছেন, তার বাস্তব ভিত্তি আলগা। যেমন ওই তৃতীয় বিচারক তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘ তাঁকে (খোকন) আগাম জামিন দেওয়া হয়েছে শুধু নিরাপদে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য।’ আচ্ছা বলুন তো, যাঁরা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ‘নিরাপদে’ হাইকোর্টে পৌঁছাতে পারেন, তাঁরা দায়রা আদালতে যেতে পারেন না কেন? পুরান ঢাকায় যানজট বেশি বলেই? তা ছাড়া সাত দিন পরে কী নিম্ন আদালত স্বাধীনতা অর্জন করবেন। রিজভীকে রিমান্ডে দেওয়ার দৃষ্টান্ত কি প্রমাণ করে? ছোট আদালতে কীভাবে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন? তাঁরা না পেলে নাগরিকেরা পাবে বা পাচ্ছে কীভাবে? আমরা তো বুঝি, অভিযোগপত্র দেওয়ামাত্রই ওই মামলা কোয়াশ করতে তাঁরা আবার হাইকোর্টেই ছুটবেন। স্টে নেবেন। ছোট আদালত হয়তো বড় বাপের পোলাদের বিরুদ্ধে ‘সাজানো মামলা’ বিচার করারই সুযোগ পাবেন না।
সর্বোচ্চ আদালত অবশ্য বলেছেন, সরকারের দ্বারা ছোট কোর্ট কব্জা রাখা সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ শুধরে বাহাত্তরের সংবিধানে না ফিরলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘দূরবর্তী ঢোলের শব্দ’ হয়ে থাকবে। ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির এক আলোচনায় আমার এ কথার জবাবে আইন প্রতিমন্ত্রী সোমবার স্পষ্ট বলেছেন, তাঁরা বাহাত্তরে ফিরবেন না। এটা সম্ভব নয়। ওই আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বিএনপি নেতা বার সভাপতিও নিরুত্তর ছিলেন। তাহলে ‘সরকারনিয়ন্ত্রিত আদালত’ই কি আমজনতার নিয়তি? 
হরতাল মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় তো জামিনের পক্ষেই ছিল। অথচ বাইরে পুলিশ ও র‌্যাব বেষ্টিত সোমবারের শ্বাসরুদ্ধকর শুনানিতে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও কনিষ্ঠ বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কিন্তু পুনরায় বিভক্ত হলেন। আসামি পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি আইন আঁকড়ানোর চেয়ে আবেগে ভাসলেন। বললেন, বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক থাকতে হবে। যাতে রাজনৈতিক প্রভাব না পড়ে ইত্যাদি। তবে ওইদিন আদালতের সিদ্ধান্ত উত্তেজনা প্রশমিত করেছে। 
লক্ষণীয়, ওই দিনের শুনানিতেও রাষ্ট্রপক্ষ ৬২ ডিএলআর এ বর্ণিত আপিল বিভাগের নির্দেশনা উল্লেখ করেননি। তবে সোমবার দুই মাননীয় বিচারপতি রুল জারিসংক্রান্ত যে বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন, তা আমাকে ৬৩ ডিএলআরের (২০১০) একটি সিদ্ধান্ত মনে করিয়ে দিয়েছে। আপিল বিভাগ এতে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চকে পরোক্ষভাবে তিরস্কার করেছিলেন। সেটিও ছিল আগাম জামিনের মামলা। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই মামলায় আট সপ্তাহের সময় দিয়ে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার কিংবা হয়রানি করা যাবে না। ক্ষুব্ধ আপিল বিভাগ বলেন, ‘আমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত বাধ্যকর। এর লঙ্ঘন ঘটানো হলে তা শুধু আদালত অবমাননাকর নয়, সংবিধান লঙ্ঘনেরও শামিল।’ তাই সোমবারের সিদ্ধান্তের লিখিত আদেশ ও তৃতীয় বেঞ্চের রায়ের জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকব।
আগাম জামিন যাতে নিম্ন আদালত দিতে পারেন, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে উপযুক্ত প্রশাসনিক আদেশ জারি করতে হবে। বিএনপিকে বলতে হবে, তাঁরা আইন প্রতিমন্ত্রীর ওই কথায় একমত কি না। তাঁরা প্রতিমন্ত্রীর বহু মন্তব্যের তুলাধোনা করেন, এটা করবেন না। 
আগাম জামিনের জন্য শুধু হাইকোর্টমুখী থাকার রেওয়াজ বদলাতে হবে। সামনে সাধারণ নির্বাচন। লোক ঠকানোর জন্য হলেও তাঁরা যেন একটা ফাঁকা বুলি আওড়ান। মির্জা ফখরুল, এম কে আনোয়ার প্রমুখ আর কুস্তি লড়ে নিজেরা হাইকোর্টে যাবেন না। নাগরিকদেরও যেতে দেবেন না। আগাম জামিনের যখনই যার দরকার পড়বে, বড় বাপ-ছোট বাপের পোলানির্বিশেষে তাঁরা তাঁদের বাড়ির কাছের ‘সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত’ আদালতেই যাবেন। 
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন