রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

গোপন সিডি কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না?


বাস পোড়ানোর মামলার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে—এ কথা বিচারিক আদেশেই লেখা হয়েছে। বিচার ছাড়াই কী করে এটা লেখা সম্ভব হলো, তা হাইকোর্ট বিভাগ খতিয়ে দেখতে পারেন। তবে গতকাল বিরোধীদলীয় পাঁচজন সংসদ সদস্যকে হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আমি একটি অনুরোধ করতে চাই। সেটি হলো, একটি সিডি জাতির সামনে প্রকাশ করা। ওই মামলার অন্য আসামিদের কেন মুক্তি দেওয়া হবে না, সে মর্মে রাষ্ট্র কী অবস্থান নিতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের একটা ধারণা আছে। আর সেখানে ওই সিডি হতে পারে একটি বিরাট হাতিয়ার। কারণ, মির্জা ফখরুলেরা বাস পোড়াতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে যেসব গোপনীয় সলাপরামর্শ করেছেন, তা নাকি সব বন্দী আছে ওই সিডিতে। অন্তত জামিন নাকচ করে দেওয়া মহানগর হাকিম ও মহানগর দায়রা জজের লেখা আদেশগুলো পড়ে তেমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে। 
আমি দুঃখিত যে বাজেট অধিবেশন শুরুর দিনে গতকালের জামিন দেওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগের তেমন স্বাধীনতা দেখি না। স্বাধীনতা দেখতাম ও দেখব, যদি দেখি হাইকোর্ট বিভাগ ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন’ বিবেচনায় এ রকম একটি মামলার পূর্ণ বিচার করতে আগ্রহী হতেন বা হচ্ছেন। ৬০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার আইন বহাল থাকতে সেই আইনে কী করে ছয় মাসের জামিন হতে পারে, সে আরেক প্রশ্ন। বিএনপির জামিন পাওয়া নেতারা দ্রুতই পুরো মামলা কোয়াশ করতে হাইকোর্টে আসবেন। তখন যদি স্থগিতাদেশ আসে, তাহলে তো আর কথাই নেই। আমরা এ রকম চক্কর থেকে বেরোতে চাই। 
সংবিধানে ১১০ নামে একটি অনুচ্ছেদ আছে। এটি বলছে, হাইকোর্ট দরকার হলে বিচারিক আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহার করে আনতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের উচিত নবতর দৃষ্টান্ত স্থাপনে সচেষ্ট হওয়া। আমরা চাই, জামিন কিংবা কোয়াশ নয়, এ মামলার বিচারিক আদালত হোক হাইকোর্ট। কিন্তু এটা হবে না। কারণ, রাষ্ট্র সত্যকে ভয় পায়। সে নিজের সামন্ত চরিত্র উন্মোচিত করতে চায় না। আর আদালত রাষ্ট্রের অন্তর্গত।
অর্ধডজন সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ মাইক্রোবাসে চড়ে এসে নিজেরাই বাসে আগুন দিয়েছেন। এটা কি যেইসেই অভিযোগ! জুতার ফিতা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানোর পুলিশি গল্প আমরা জানি। ক্রসফায়ারের গল্পে আমরা অভ্যস্ত। জজ মিয়াকাহিনি বা বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধানকে ঘড়ি চুরির মামলায় অভিযুক্ত করার মতো বিএনপি-মার্কা কাণ্ড সমাজে আকসার ঘটছে। 
এ ধরনের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার আসামিরা জামিন পেলেই বাঁচেন। রাজনীতিক হলে তো কথাই নেই। এবার কত ভুঁইফোড় নেতা, ত্যাগী গণতন্ত্রীর তকমা পাবেন। তারা ছাড়া পেয়ে সাজানো মামলার প্রতিকার চান না বা চাওয়ার ইচ্ছা কিংবা তাগিদ কোনোটাই তাঁদের থাকে না। তবে ২০০২ সালের যে আইনটির আওতায় এবারের ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ মামলাটি করা হয়েছে, সেখানে মিথ্যা মামলা করার শাস্তির বিধান আছে। এর ৬ ধারায় বলা আছে, যদি কেউ ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা মামলা করেন, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কমপক্ষে দুই বছর ও অনধিক পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। এজাহারের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও ওই একই দণ্ড। 
ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে আগামী আগস্টের গোড়ায় ওই মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারিক হাকিম মোহম্মদ এরফান উল্লাহ ‘অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেছেন। সাংসদ মাহবুব উদ্দিন খোকন কী অপরাধ করেছেন, তা অভিযোগপত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। অথচ বিচারক তাঁর আদেশে লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে এই মামলার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আসামিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া সংগত নয় বিধায় আসামির জামিনের প্রার্থনা নামঞ্জুর করা হলো।’ সপ্তাহের ব্যবধানে একজন সাংসদের জামিন নিচের আদালতে নাকচ ও ওপরের আদালতে কেন মঞ্জুর হলো, তার কৈফিয়ত কে দেবেন। 
ওই মহানগর হাকিমের আদালতে জামিন নাকচের পর ৩৩ জন নেতা ধরনা দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজকোর্টে। বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল হক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় জামিন নাকচ করে লিখেছেন, ‘প্রসিকিউশন পক্ষে বিজ্ঞ পিপি আসামির জামিনের ঘোর বিরোধিতা করে উল্লেখ করেন যে, অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে এবং অভিযোগপত্র গৃহীত হয়েছে।’ তিনি এমনভাবে বিচারিক আদেশ লিখেছেন, যাতে মনে হতে পারে তাঁর ঝোঁক নিরপেক্ষ নয়, রাষ্ট্রের প্রতি পক্ষপাতে স্পষ্ট, তাঁর বর্ণনায়, ‘আসামিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুঠোফোনে ঘটনা ঘটানোর বিষয়ে নির্দেশ দেয়, যা ঘটনাস্থলে ধৃত আসামিরা বর্ণনা করেছে। আসামিদের উক্ত রূপ নির্দেশের বক্তব্যের সিডি প্রসিকিউশন পক্ষের কাছে আছে। এবং আসামিদের টেলিফোনের বক্তব্য সব রেকর্ড করা আছে। এবং উক্ত রূপ বক্তব্য অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।’ পিপির বরাতে মহানগর দায়রা জজের এই বিবরণ কিন্তু অভিযোগপত্র সমর্থন করে না। অথচ পিপি ও বিচারকের সামনে অভিযোগপত্র ছাড়া আসামিদের বিষয়ে অন্য কোনো দলিল ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। বিচারকের তো উন্মুক্ত এজলাসের বাইরে গোপনে সিডি বা অন্য কোনো প্রমাণ দেখে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মহানগর দায়রা জজ তাঁর আদেশে পিপির বরাতে আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথক সিডি আছে, যাতে প্রমাণিত হবে যে আসামি কথিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। এমতাবস্থায় পিপি আসামির জামিনের বিরোধিতা করেন।’
আমরা বাস পোড়ানো ও ককটেল ফাটানোর দুটি মামলাই সাজানো হিসেবে গোড়া থেকেই সন্দেহ করে আসছি। কিন্তু এখন আমরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজের কাছ থেকে দালিলিকভাবে জানতে পারলাম, ‘অভিযোগপত্রে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ কীভাবে প্রমাণিত, তা সিডিতে ধারণ করা আছে।’ 
সেই কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রধান অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবুকে গতকাল ফোন করলাম। সিডি যখন আদালতে দেওয়া হয়েছে, তখন সেটা পাবলিক রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। এটা আর গোপনীয় বিষয় হতে পারে না। তাই খুব ভরসা করে তাঁর কাছে সিডির কপি চাইলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বিস্মিত করলেন। বললেন, অভিযোগপত্রের বাইরে আর কিছু তাঁর জানা নেই। সিডির কপি আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। তাঁর যুক্তি: এই সিডি তো জামিনের শুনানির সময় আদালতে দেওয়ার বিষয় নয়। যখন সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রশ্ন আসবে, তখন এটা আদালত শুনবেন। 
আমি তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললাম, তাহলে বিচারকের আদেশে কীভাবে লেখা হলো, ‘আসামিদের উক্ত রূপ বক্তব্যের সিডি প্রসিকিউশন পক্ষের কাছে আছে।’ তিনি বললেন, এটা আদালতের বিষয়। আমি তখন তাঁকে প্রশ্ন করলাম, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথক সিডি আছে, সেটা আপনি কোথায় পেলেন? পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, আমি সিডির বিষয় শুনিনি। দেখিওনি। বললাম, বিচারকেরা শুনেছেন? পিপি বললেন, না। প্রশ্ন করি, তাহলে এটা কোথায় আছে? তিনি বললেন, ‘এটা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে।’ 
আমরা অবশ্যই আশা করব, যে মামলাকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলীয় রাজনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে, সেই মামলার এত বড় অকাট্য প্রমাণ এখনো শুধু গোয়েন্দা সংস্থার হাতে থাকবে কেন। আদালতের কাছে যখন তাঁরা সিডির কথা প্রকাশ করেছে, তখন তার বিষয়বস্তু জাতির সামনে পুরোপুরি প্রকাশ করতে অসুবিধা কী। 
মির্জা ফখরুলেরা এখনো কারাগারে। সুতরাং অভিযোগপত্রে বর্ণিত সিডির কথিত টেলিফোনের বিবরণে কী আছে, তা আমরা জানতে চাই। অভিযোগপত্র পাঠে মনে হয়, এখানে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে। সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মেশানো হয়েছে। অভিযোগপত্রটির লেখক ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য উত্তর বিভাগের জঙ্গি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ টিমের পুলিশ পরিদর্শক মো. নুরুল আমিন। তিনি শুধু লিখেছেন ‘ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও বোমাবাজি ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে হরতাল সফল করার নিমিত্তে আসামিরা পারস্পরিক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যে কথোপকথন করেছে তার রেকর্ডকৃত সিডি সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করি।’ এর মধ্যে আমরা পিপি ও বিচারিক আদেশের সিডিকথনের মিল পাই না। 
আমরা দালিলিকভাবে অভিযোগপত্রের ভাষ্যের সঙ্গে পিপি ও বিচারিক আদেশের সিডিসংক্রান্ত ভাষ্যের অমিলটাই বেশি লক্ষ করি। অভিযোগপত্রে নির্দিষ্টভাবে এটা বলা হয়নি যে বাসটি (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২১০৯) পোড়ানোর বিষয়ে সিডিতে বক্তব্য রয়েছে। তাহলে অভিযোগপত্রে বিরোধীদলীয় ৪২ জন নেতাকে কী কথা বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তদন্তকালে সাক্ষ্য-প্রমাণে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাদৃষ্টে এজাহারে বর্ণিত আসামিগণ রতন, আমান, আব্বাস, দুলু, মিলন, আলম, গয়েশ্বর ও এ্যানি “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনা” দিয়েছেন।’ 
মির্জা ফখরুলসহ ৩৪ জন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাঁরা ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসযোগে ওই বাসটির গতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কন্ডাক্টর সোহান মিয়া ও হেলপার জসিমের সহায়তায় ৩২ জন নেতা বাসটি থামিয়ে তা ভাঙচুর করেন ও আগুন লাগান। অভিযোগপত্র দাখিলকারী নুরুল আমিন নির্দিষ্টভাবে আর কোনো বক্তব্য কিংবা তথ্য দাখিল করেননি। তিনি কিন্তু একা এ অভিযোগের দায়িত্ব নেননি। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং পিপির মতামত নিয়ে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নাম অভিযোগপত্রে নেই। তবে ৯ মে ২০১২, ১০২৪ নম্বর স্মারকসূত্র ধরে খুঁজলেই তা পাওয়া যাবে।
এটি যদি মিথ্যা মামলাই হবে, তাহলে কি আমরা দেখব, এজাহার ও অভিযোগপত্র প্রস্তুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দুই থেকে অনধিক পাঁচ বছর লাল দালানের ভাত খাচ্ছেন? 
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

বিএনপির হরতাল ও আইন প্রতিমন্ত্রীর ‘পোস্ট বক্স’


জামিন নাকচ করার মুখ্য কারণ আসামিদের পালানোর আশঙ্কা, যা এ ক্ষেত্রে ছিল না
জামিন নাকচ করার মুখ্য কারণ আসামিদের পালানোর আশঙ্কা, যা এ ক্ষেত্রে ছিল না
বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ জন নেতাকে তাৎক্ষণিক কোনো কারণ না দেখিয়ে জামিন নাকচ করেছেন নিম্ন আদালত। দীর্ঘ শুনানির পরে দু-তিনটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন আদালত। যে ঘটনা দেশব্যাপী একটি হরতালের জন্ম দিল, সেখানে বিচারকের জবানিতে জামিন নাকচের কারণ জানতে পারলাম না। অথচ জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কেন জামিন পাবেন বা পাবেন না, তার কারণ বিচারকেরা যাতে লেখেন, সে রকম বাধ্যবাধকতা সিআরপিসির ৪৯৭ ধারায় আছে। তবে ৩৩ নেতাকে জামিন না দিতে এই আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, সেটা আদালতের চূড়ান্ত লিখিত আদেশ দেখে বলা যাবে। জামিন নাকচ করার মুখ্য কারণ আসামিদের পালানোর আশঙ্কা, যা এ ক্ষেত্রে ছিল না। তবে যে কারণে এই নিবন্ধ, তা হলো সুপ্রিম কোর্টের বিএনপির আইনজীবীদের সুবিধাবাদী ও খণ্ডিত প্রতিক্রিয়া। আদালতের স্বাধীনতার জন্য তারা হরতাল করেনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন গতকাল একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি অধস্তন আদালত ঠিকঠাক না চলা ও তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ না করার বিষয়ে যা বলেছেন, তা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু লক্ষণীয়, পদ্ধতিগত যে কালাকানুন বর্তমানে বহাল আছে এবং যার অপব্যবহার চলছে তা বিলোপ করে দিতে তাঁরা নীরব। দুই বড় দল কাদা ছোড়াছুড়ি করে বলে আমরা কত আক্ষেপ করি। কিন্তু তাঁরা সেয়ানা পাগল। বিএনপি কাদার দলা ছুড়তে পারে। বলতে পারে, উঠতে-বসতে সামরিক শাসক বলে আমাদের নেতাকে গাল পাড়েন। অথচ এক বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট তিনটি ফরমান শিরোধার্য করলেন। অথচ জিয়াকে শেরপা মানছেন না। তিনি তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঘোষক! এ কথা মুখ ফুটে বেগম খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুলেরা বললে কেমন আনন্দ হতো বলুন। জ্যৈষ্ঠের এই কাঠফাটা তপ্ত হরতালীয় আবহাওয়াটা কেমন রঙিন হতে পারত। কিন্তু বিএনপি এতটা বেরসিক নয় যে এসব বলে আওয়ামী লীগকে শরম দেবে। এই যে মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না অবস্থা, কেন। কারণ, রাষ্ট্রের চরিত্র যাতে গণমুখী না হয়, এটা যাতে সামন্ততান্ত্রিক থাকে, সে বিষয়ে আমাদের এই দুই কলহপ্রিয় শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে তফাত নেই।
বিএনপির এখনকার সমস্যা হলো, কালাকানুনটা থাকুক, আমজনতাকে ঠ্যাঙ্গাও। আমাদের নেতাদের কেন। আর ক্ষমতায় গেলে আমরাও সুবিধা নেব। তোমরা তখন চিল্লাবে। গলা ফাটাবে। আমরা তখন এই নজিরবিহীন গ্রেপ্তারের নজির হাজির করব। মহানগর হাকিমের আদালতে আমরা বুধবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ধাক্কাধাক্কি দেখেছি। তারা দরকারে মারামারিও করতে পারে। সুপ্রিম কোর্টে গতকাল সরকারদলীয়দের চাপা উত্তেজনা ছিল। বিএনপির আইনজীবীরা সমিতি ভবন থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক পর্যন্ত মিছিল করেছেন। আমরা এটা দেখতে চাইব যে, মিছিল করতে করতে তাঁরা একদিন প্রধান বিচারপতির দরোজায় যাবেন। লাথি মারতে নয়, সৌজন্য ও মর্যাদার সঙ্গে প্রতিবাদ জানাতে। প্রশ্ন তুলতে নিম্ন আদালতে বদলির ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে কেন। 
বিরোধী দলের ৩৩ নেতাকে কারাগারে পাঠানোর এজাহার দুটো আমি পড়েছি। এর বাক্য গঠন বালখিল্য, হাসির উদ্রেক করে। একটি বাক্য পড়ে মনে হলো, দেশপ্রেমিক পুলিশটি তো আমাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নেত্রী সাহারা খাতুনের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের অনুমতি চাইতে পারতেন। গাড়ি পোড়ানোর মামলায় সাজা দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। ওই ধারায় ফেললে যাবজ্জীবন।
৩৩ নেতাকে জেলজীবনের স্বাদ দেওয়া আসলে বিচার বিভাগ পৃথককরণ যে কার্যকর অর্থে ঘটেনি, তা-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এর আগে আমি নিম্ন আদালতে জামিন না চেয়ে কেন নেতারা উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন তার সমালোচনা করেছিলাম। বস্তুত এটাই রুঢ় বাস্তবতা। সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিক এবং এমনকি সুুপ্রিম কোর্ট নিজেও অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা পুরোপুরি ধারণ করতে পারছেন না। অধস্তন আদালতের চেয়ে এখনো উচ্চ আদালত অধিকতর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তবে সব সময় নয়।
অধস্তন আদালতের স্বাধীনতার সঙ্গে তাদের কর্মস্থল নির্ধারণ, বদলি ও পদন্নোতি এতটাই তীব্র ও ব্যাপক ভূমিকা রাখে যে, অন্য আর কোনো কিছুই এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখানে বিরাট অবিচার ও অনাচার চলছে। এ বিষয়ে বিএনপি কোনো নীতিগত অবস্থান নিতে পলায়নপর রয়েছে। তারা আসলে আওয়ামী লীগ যেভাবে বিচার বিভাগ চালায়, তারাও সেভাবেই চালিয়ে এসেছে এবং সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে চালাবে। সে কারণে তারা সহজ হরতাল পাঠ করে। নির্দিষ্টভাবে, কোমরে গামছা বেঁধে বিচারিক স্বাধীনতায় ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপের মুখোশ উন্মোচন করে না। হরতালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করি। কিন্তু চাপের মুখে বিচারকের অন্যায্য বদলি যে হরতালের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর, তা আমরা চিন্তা করি না।
আমাদের চামড়া গন্ডারের চেয়েও শক্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশের আইনকানুন কোথায় কীভাবে লেখা আছে আর কে কীভাবে তা প্রয়োগ করছে এবং তাতে মানুষ তার প্রতিকার পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, তা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো বিতর্ক নেই। ৩৩ নেতা জামিন পেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয়, তা নিয়ে কোনো কথাবার্তাই উচ্চারিত হতো না। বারের সভাপতি দায়সারা হলেও বলেছেন, ‘সম্প্রতি সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে বিচার বিভাগ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।’ সত্য হলো, এই সরকার আগাগোড়া বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। এটা কোনো ‘সাম্প্রতিক’ প্রবণতা নয়।
ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বুধবার বাহাস করলেন। খন্দকার সাহেব নির্দিষ্টভাবে একটি পৃথক সচিবালয় গঠনের কথা বললেন। সেটা অর্থহীন, যদি না সংবিধান শোধরানো হয়। আইন প্রতিমন্ত্রী ধারণা দিলেন, ৩৩ নেতার সম্পৃক্ততার যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকার কারণেই আদালত তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করেছেন। বারের সভাপতি বলছিলেন, অধস্তন আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর আইন প্রতিমন্ত্রী তা খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি ছাড়া তাঁরা বিচারকদের কোনো একটিও বদলির আদেশ দিতে পারেন না এবং দেন না। একটি শব্দ তিনি ইদানীং খুব ব্যবহার করছেন। সেটা হলো, তাঁরা নাকি পোস্ট বক্স। সবই করা হয় সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনে। আচ্ছা ‘পোস্ট বক্স’ যদি এতই ফেলনা হবে, তাহলে এটা আঁকড়ে থাকা কেন। ফেলে দিন। ওটা তো সামরিক ফরমানের সৃষ্টি এবং সেটা অবশ্যই অধস্তন আদালতের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। এটা ডেমোক্লেসের সেই তরবারি, এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, থাকতে পারে না এবং থাকার প্রশ্নই আসে না।
সুপ্রিম কোর্টের যে সত্তা অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি একান্তভাবে প্রশাসনিক। তাই আদালত অবমাননার ভয় করি না। নিম্ন আদালতের কতিপয় বিচারক ঢাকায় একটি বদলি পাওয়ার জন্য জান কোরবান করতে প্রস্তুত থাকেন। বিড়ালের ইঁদুর ধরার মতো সরকারও এর সুযোগ নিতে ওত পেতে থাকে। আমরা দালিলিকভাবে প্রমাণ দিতে পারি, সরকারের অস্বচ্ছ ইচ্ছা পূরণে সুপ্রিম কোর্ট কখনো কখনো কীভাবে পোস্ট বক্সের মতো কাজ করেন। প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর (বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান), বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী এবং বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিঞা সমন্বয়ে একটি জিএ কমিটি রয়েছে। তাঁরা সরকারের প্রস্তাবক্রমে বিচারকদের বদলি অনুমোদন করেন।
আমরা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটির কতিপয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজকে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবস্থান গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। শ্রদ্ধাভাজন বামপন্থী নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে একদিন বলেছি এবং সবাইকে বলি, এসবের বিরুদ্ধে আপনারা কেন নির্দিষ্টভাবে আওয়াজ তুলছেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো বিমূর্ত নয়। এর যেটুকু ছুঁয়ে পরখ করা চলে, সেটুকু খতিয়ে দেখুন। কেন আপনারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সুপ্রিম কোর্টের ফটকে ধরনা দিচ্ছেন না। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেই এই শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। কিছু জবাবদিহি প্রধান বিচারপতিকে সরাসরি করতে হবে। মন্ত্রীদের কাছে তার ব্যাখ্যা শুনতে চাই না। মার্কিন প্রধান বিচারপতি রবার্ট সম্প্রতি বিচারকদের আচরণবিধি মানা না-মানা নিয়ে একটি বৃিবতি দিয়েছেন, তেমন বিবৃতি আমরাও শুনতে চাই।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শতাধিক জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়ে একজন বিচারকের প্রতি সীমাহীন পক্ষপাতিত্ব দেখানোর সরকারি প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে থামিয়ে দেন। আইন মন্ত্রণালয়ে বিচারকেরা যাতে মাজা সোজা করে বসতে না পারেন, সব সময় খাড়া থাকেন, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে স্থায়ী সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না।
দেশে আইনের শাসন কি আর কে তা মানে তার একটা নজির দেই। ৩৩ নেতার জামিন থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও দিতে পারতেন। এ কথা শুনে অনেকেই আঁৎকে উঠতে পারেন। আইনে থাকলেও এদেশে এর প্রয়োগ নেই। চোর ধরতেও কখনও প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য কড়া নির্দেশ লাগে। তাই দেখার বিষয় হলো, যে কাজ একজন দারোগা সারতে পারতেন, সেটার জন্য আমরা সুপ্রিম কোর্টের দেয়াল টপকিয়ে রাতবিরাতে নেতাদের দৌড়াদৌড়ি দেখলাম। হাইকোর্টে কত বিভক্ত রায়, তৃতীয় বেঞ্চের রায়। কত মিছিল মিটিং, হরতাল, জ্বালাও পোড়াও। সিআরপিসির ৪৯৭ ধারা অজামিন যোগ্য ধারায় অভিযুক্তকে জামিন দিতে আদালত ও দারোগাকে একই মর্যাদায় দেখেছে। অথচ আমরা এর সমপ্রয়োগ চাই না। পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় বসাতে দুই দলই অপ্রস্তুত। পুলিশকে তারা পেটোয়া বাহিনী হিসেবেই দেখতে চায়। এরা পিটিয়ে শিক্ষক মারে, রিমাণ্ডে নিয়ে মানুষ নির্যাতন করে। গাড়ি ভাংচুর, বাস পোড়ানোর প্রতিকার আমরা পাই না, দূষিত রাজনীতিতে সমাহিত হয়। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সরকারি দল থেকে পুলিশের পৃথককরণ ও বিরাজনীতিকীকরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
শেষে একটা কথা বলি। ৩৩ নেতার কেউ যেহেতু বিচার থেকে পলাতক হতেন না, তাই তাদের জামিন না দেওয়ায় বিচারবিভাগ পৃথককরণ পরবর্তী অধস্তন আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। সাধারণ রীতি হচ্ছে জামিন দেওয়াই বিধি না দেওয়াই ব্যতিক্রম।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

মাননীয় প্রধান বিচারপতি রায়টি প্রকাশ করুন


অনেক দিন পর নির্দিষ্ট খবর পেলাম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্টের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানালেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বহুল আলোচিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চূড়ান্ত করেছেন। তবে এটা গল্পের শুরু না শেষ, তা স্পষ্ট নয়। এই রায়ে আমাদের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে বললে ভুল হবে না। 
বিরোধী দল এখন ইলিয়াস আলীতে, পরে অন্য ইস্যুতে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে যেতে পারে। মুখে তারা যা-ই বলুক, তাদের অন্তরে মসনদ, সেখানে যাওয়ার মওকা হিসেবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। আমরা চাই সাংবিধানটা যাতে আস্ত থাকে। তা ছাড়া ক্ষমতাসীনেরা ও তাঁদের দ্বারা পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত এমন কিছু করে দেখাতে পারেনি, যাতে আমরা ভরসা করতে পারি। অন্যদিকে বিরোধী দলের এমন মুরোদ নেই যে, তারা শান্তি বজায় রেখে ১৫তম সংশোধনীতে বিলোপ হওয়া তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাটা ফিরিয়ে আনতে পারে। সুতরাং আপিল বিভাগ এক বছর আগে যে বলেছিলেন, আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হতে পারে, তা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না। 
আমি তো ভয়ডর ভুলে বলেই রেখেছি, ১৫তম সংশোধনীতে বাতিল হওয়া সত্ত্বেও আগামী দুই মেয়াদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় নির্বাচন করার একটি আইন এখনো বেঁচে আছে। সহজ করে বললে এটি সর্বোচ্চ আদালতের ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে’ আছে। অক্সিজেনের নল খুলে না ফেললে তো তাকে মৃত ঘোষণা করা যাবে না। এখন এই নল কীভাবে, কী আছে, সেটাই লেখা থাকবে কিংবা থাকা উচিত আপিল বিভাগের ওই রায়ে। 
বিচারপতি খায়রুল হক রায়টি বাংলায় হাতে লিখেছিলেন। ছিল নাকি প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠা, টাইপ করার পর প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের গোড়ায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ওই মামলায় রায়দানকারী অন্যান্য বিচারকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। এটি বিভক্ত রায়। জনগণকে আদালত শুধু বলেছেন, তাঁরা এ রায় লিখতে একমত হতে পারেননি। কেন কী কারণে এই বিভক্তি, তা পুরোটা আন্দাজ করা চলে না। সাত বিচারকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে হলে চার তো লাগবেই। সুতরাং অন্তত চারজন পক্ষে ও সর্বাধিক তিনজন বিপক্ষে বলে মনে করা চলে। 
সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিদায়ী প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছেন তেমনটা বলেন ওই কর্মকর্তা। কিন্তু সবাই তাতে স্বাক্ষর সম্পন্ন করেছেন কি না, তা তিনি নিশ্চিত করেননি।
সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার রায়ে সংখ্যালঘু এক বা একাধিক বিচারক কী অভিমত দেবেন তা গুরুত্বপূর্ণ। আইনের চোখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলাটি এখনো সাবজুডিশ বা বিচারাধীন। আওয়ামী লীগ জবরদস্তি একটি বিচারাধীন বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সংবিধান থেকে মুছে ফেলেছে। আদালতের রায়টি অবশ্য তারা মোছেনি। 
যেকোনো বিশেষজ্ঞ তা তিনি যে দলের সমর্থকই হোন না কেন, তাঁকে তত্ত্ব ও তর্কের খাতিরে হলেও মানতে হবে যে রিভিউতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। এমনকি যে বিতর্কিত ১৫তম সংশোধনীর বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়নি, সেটিও শুনানির প্রতিপাদ্য হতে পারে। কেউ বলবেন বাহে আপনার মস্তিষ্ক দেখছি অতিশয় উর্বর! আমি কাষ্ঠ হেসে সায় দেব। কিন্তু কেউ কি বলবেন, আমার এ যুক্তির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই? 
আপিল বিভাগের রায়ে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র অবৈধ বলে সাব্যস্ত হয়। নির্বাচন কমিশন তাঁর সদস্যপদ খারিজ করে প্রজ্ঞাপনও জারি করে। আপিল বিভাগের রায়ের পর কীভাবে তিনি সাংসদ পদে বহাল, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করেছেন। প্রধান বিচারপতির হাত ঘুরে সেই রুলের শুনানি যখন শুরু হতে যাবে, তখন ড. খানের আইনজীবী হাইকোর্টকে একটি তথ্য দিয়েছেন; বলেছেন, আপিল বিভাগের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করা হয়েছে। যদিও আপিল বিভাগ স্টে দেননি। এটি হল রিভিউর শক্তি। ড. খান একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে বহাল আছেন। 
সন্দেহ নেই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলার রায় ঝুলিয়ে রেখে ইতিমধ্যেই এই উপমহাদেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের ইতিহাসেও এর নজির নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের অজান্তে পাকিস্তানকেই অনুসরণ করে থাকি। মুখে সারাক্ষণ গালাগালি দিই। কিন্তু কখন যেন আমরা তাদেরই অনুসরণ করতে থাকি। বহু ক্ষেত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীর বিপ্লবী ভূমিকায় আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারকদের এক সমাবেশে ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীর বাংলাদেশি মডেল খুঁজেছিলেন! কিন্তু আমি নিশ্চিত, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক ভূমিকার পর অনেকেই আর অমন কথা মুখে আনবেন না। এখন তাঁরা বহু ক্ষেত্রে দলীয় সরকারের খাস তালুক শাসনের প্রবণতা দেখাচ্ছেন। 
নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, জাতীয় সংসদ নয়, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। তারা এখন ‘তৃতীয় খেলোয়াড়।’ প্রধান বিচারপতি ইফতেখার এমন আদেশ দিচ্ছেন জেনারেল কায়ানি কিংবা জেনারেল পাশাকে সরকার বরখাস্ত করতে চায় কি না। পাকিস্তানে এখন জেনারেল, বিচারক ও রাজনীতিকদের লড়াই ত্রিমুখী হয়ে উঠেছে। ইফতেখার চৌধুরীকে নিয়ে যাঁরা রাজপথে অগ্রণী সিপাহসালার ছিলেন, তাঁদের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বারের সাবেক সভাপতি মুনির-এ-মালিক তাঁদের অন্যতম। তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদে এটা একটা ভয়ংকর প্রবণতা। বিচারকেরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। অথচ তাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগে এতটাই মত্ত হয়ে উঠেছেন যে মনে হচ্ছে, তাঁরাই দেশের একমাত্র পবিত্র প্রতিষ্ঠান। সব জাতের স্বৈরশাসক এই মনস্তত্ত্বে ভোগে। তাঁরা মনে করেন, আমরাই শুধু পরিচ্ছন্ন এবং সব সঠিক কাজ করতে সামর্থ্যবান।’ 
আমরা বিচারকদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দ্বিমুখী লড়াই ক্রমশ স্পষ্ট হওয়ার লক্ষণগুলো দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে। রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মামলাগুলোতে বিব্রত হওয়া, এমনকি রুল জারি প্রশ্নে বিভক্ত হওয়া একটা নিয়মিত প্রবণতা হতে চলেছে। এটা এখনই প্রশমিত না হলে ভবিষ্যৎ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তা আমরা কেউ জানি না। 
বাংলাদেশে গত সাড়ে তিন বছরে উচ্চ আদালতের কাছ থেকে এমন সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত পাওয়া গেছে, যা একসময়ে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনার মধ্যে ছিল না। সুতরাং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর-প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে উচ্চ আদালতের সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত কিংবা হস্তক্ষেপ এবং তার ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিরোধ মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। সে কারণে আইন শুধরে নির্বাচনী মামলা দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে ফয়সালার দায়িত্ব হাইকোর্টকে দেওয়া হয়েছিল। সেই ভরসার জায়গা অটুট আছে কি? 
আগামী সাধারণ নির্বাচন এমন একটি পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলো ক্ষমতাসীন দলের কবজায় থাকবে। ১৯৯০ সালের পর যাঁরা জন্ম নিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে ভোটার হয়েছেন, তাঁদের জীবনে এটি হবে পুরোপুরি নতুন অভিজ্ঞতা। সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিন আগে নির্বাচন কমিশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল ঘোষণা করবে। সুতরাং প্রত্যেক মন্ত্রী ও সাংসদ পূর্ণমাত্রায় ক্ষমতা প্রয়োগ করার অবস্থায় থাকবেন। এই পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণ গত ২২ বছরে কেউ দেখেনি। এই অসাধারণ অবস্থা সামাল দিতে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের উপযুক্ত বিধিবিধান তৈরি করার কথা ভাবছে বলেও জানা যায় না।
স্পিকার আবদুল হামিদ সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র নাকচ করে যে মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তাকে তীব্রতা দেবে। ক্ষমতাসীন দলের সংবেদনশীলতায় অভিঘাত সৃষ্টি হয় এমন সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সাংবিধানিক সংস্থাগুলো যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ও সামর্থ্যের অভাব দেখিয়ে চলেছে। স্পিকার তাঁর নিরপেক্ষতার কফিনে আর একটি পেরেক ঠুকলেন। 
যে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায় লেখা হয়েছিল, তার চেয়ে এখন রাজনৈতিক সংলাপের পরিবেশের আরও অবনতি ঘটেছে। হিলারি ক্লিনটনের সংলাপের তাগিদের পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা সক্রিয় হয়েছেন। কিন্তু কার্যকর সংলাপের কোনো নড়াচড়া টের পাই না। তাই সার্বিক বিচারে আপিল বিভাগের ওই রায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। 
বিলম্বিত রায় লেখার জন্য মাননীয় বিচারপতিগণ দ্বারা অধস্তন আদালতের বিচারকদের শাস্তিদান বা তিরস্কার করা একটা রুটিন ব্যাপার। সমগ্র জাতি একটি অন্ধকার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে কি না বলে প্রশ্ন উঠছে। সেখানে তা থেকে উত্তরণের সুপ্রিম কোর্ট বাতলানো পথ তো যাচাই না করে ফেলে রাখা যায় না। সময় দ্রুত গড়াচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে বিবদমান দলগুলো কী পাবে বা পাবে না, সেটা ভিন্ন বিষয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কোনো কিছুতেই প্রলয় ঠেকানো যাবে না।
তবে এটুকু বুঝতে পারি, পূর্ণাঙ্গ রায় এমন লেখার সুযোগ নেই, যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই মেয়াদে নির্বাচনের সুযোগ রুদ্ধ বা তা আরও সংকুচিত হতে পারে। ইতিমধ্যেই ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশকে উল্টে দেওয়ার নিয়ম নেই। এমনকি ১৫তম সংশোধনী ও তার পরের আইনগত অবস্থাটিও আপিল বিভাগ বিবেচনায় নিতে পারেন না। যে বিচারবুদ্ধিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা দুই মেয়াদের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, তাতে তাঁদের দূরদর্শিতাই প্রমাণিত হচ্ছে। সে কারণেই মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, রাজনীতিতে যা হওয়ার হবে, অনতিবিলম্বে রায়টি জাতির সামনে প্রকাশ করা হোক। সুপ্রিম কোর্টের দায় তো ঘুচুক। তাঁদের রায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফর্মুলা আছে—জনমনে এ ধারণা কমবেশি ছড়িয়ে আছে। জাতীয় রাজনীতির সংকটের সঙ্গে আদালতের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার এমন অভাবনীয় আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ার এই প্রেক্ষাপট আমরা তো কল্পনা করতে প্রস্তুত ছিলাম না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

তাঁরা কেন ছোট কোর্টে গেলেন না?


হরতালীয় নাশকতার দুটি মামলার এজাহার পাঠ করে অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে। কিন্তু আজ সেটা আলোচনা করা লক্ষ্য নয়, এটা আমরা বুঝতে চাইব যে এতসব হুলুস্থুল কাণ্ড করে বড় নেতারা কেন রাতবিরাতে বড় কোর্টে আসেন। ছোট কোর্টে কেন যান না। ছোট কোর্ট পুরান ঢাকায়। সেখানকার একটি খাবার হলো ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। আমরা যারা বড় বাপের পোলা, তারা কেন পুরান ঢাকায় যাই না। বিএনপির নেতারা বড় কোর্টে বলেছেন, ছোট কোর্টেই যাব। তবে পথে পুলিশ ধরে ফেলবে। তাই আগাম জামিন দিন। এটা সর্বাংশে সত্য মনে হয়? আইন বলছে, আগাম জামিন দিতে কারণ লিখতে হবে। প্রায়শ জামিনের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে কারণ লেখা দেখি না। 
বিচার বিভাগ পৃথককরণ পুরা করার কথা দুই বড় দলের কেউ মুখে আনে না। মিডিয়া কিংবা বার তাতে তেমন মাইন্ড করে না! দুই বড় দলের চিরচেনা গান জনগণ জানে। জামিন পেলে আদালত স্বাধীন, না পেলে সরকারের অধীন। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। বিচার বিভাগ একটি গভীর অসুখে ভুগছে। উচ্চ আদালত সব সময় নিম্ন আদালতকে ধারণ করছেন বলে মনে হয় না। 
মির্জা ফখরুল, এম কে আনোয়ার, খোকন, প্রমুখ বিএনপির নেতা কটা দিন পালিয়ে বেড়ালেন। শাহবাগের এজাহার বলছে, সচিবালয়ে ‘একটি কালো রঙের মোটরসাইকেলে দুজন অজ্ঞাতনামা যুবক আসিয়া দুইটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাইয়া পালাইয়া যায়।’ পুলিশ তাদের ধরতে পারার দাবি করেনি। কিন্তু মহাবিজ্ঞ এসআই ২৮ জন আসামি আবিষ্কার করে মামলা ফেঁদেছেন। দ্বিতীয় মামলাটি বাস পোড়ানোর। এই মামলার নির্দিষ্ট আসামি ৩৬ জন। এর এজাহারেও নির্দিষ্টভাবে পুলিশ দাবি করেনি যে মির্জা ফখরুলরাই আগুন দিয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়াল? নেতারা ককটেল ছোড়েননি, বাস পোড়াননি। তাহলে কী করেছেন? এজাহারের দাবি, যারা এসব করেছে, নেতারা তাদের টাকা দিয়েছেন। এ মামলাটি হরতালে আওয়ামী লীগকে সাইজ করতে বিএনপির তৈরি করা ২০০২ সালের আইনে করা হয়েছে। মামলা দায়ের থেকে সাত দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র ও ৩০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার মন্ত্র আছে আইনে। কিন্তু দল করা কোনো বড় বাপের পোলায় এ পর্যন্ত দণ্ডিত হয়েছেন বলে জানি না। এবারও হবে না।
আগাম জামিন নিয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি দ্বৈত বেঞ্চ দুটি বিভক্ত রায় দিলেন। একটি নজিরবিহীন ঘটনা। মির্জা ফখরুলরা সিআরপিসির ৪৯৮ ধারার আওতায় আগাম জামিন চান। কোনো আইনেই আগাম জামিন দেওয়ার বিধান নেই। সংসদ তা বিলুপ্ত করলেও হাইকোর্ট তা টিকিয়ে রেখেছেন। আদালতের তৈরি আইন বলছে, আগাম জামিন এক অতীব অসাধারণ প্রতিকার যা বিরল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটা দায়রা জজও দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে শুধু হাইকোর্ট দেন। 
এখন বড় কোর্ট যদি বলতেন, আপনারা এখানে কেন, ওখানে নয় কেন? তাহলে মানুষ প্রশ্ন করতে শিখত, এত কাঠখড় পুড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের ক্যাম্পাসে এক কাপড়ে রাত কাটানোর দরকারটা কী? তাঁরা লুকিয়ে যদি হাইকোর্টে আসতে পারেন, তাহলে লুকিয়ে কেন অনতি দূরের ছোট কোর্ট বা জজ কোর্টে নয়? 
মির্জা ফখরুল ও খোকন সাহেবরা তাঁদের আবেদনে লিখেছেন, ‘যদিও হাকিমের আদালত এখন স্বাধীন কিন্তু তাঁদের চাকরি এখনো সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবেদনকারীরা শংকিত যে নিম্ন আদালতে তাঁরা যথাযথভাবে এবং আইনগত প্রতিকার নাও পেতে পারেন।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কথা নাগরিকদের জন্যও প্রযোজ্য বলে বিএনপি নেতারা মনে করেন কি না? সংবিধানে আইনের চোখে সব নাগরিকের সমতার কথা লেখা আছে। 
ভয়ের কথা, আগাম জামিন ক্রমবর্ধমান হারে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। এবং বার ও বেঞ্চ উভয়ে লিখিতভাবে তাঁর প্রমাণ রাখছেন। বার পক্ষ বলছে, ‘তিনি সংসদ ও বারের সদস্য। তাই তিনি আগাম জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে লিগ্যাল প্রিভিলেজ বা আইনগত বিশেষাধিকার আশা করতে পারেন।’ রাষ্ট্রপক্ষের বরাতে বেঞ্চ তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীকার করেন যে অভিযুক্ত আবেদনকারী সাংসদ ও বার সদস্য হিসেবে আগাম জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর ভালো অবস্থানে রয়েছেন।’ রায় দিতে গিয়েও তার যথার্থতা দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকারান্তরে আইনি অসমতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। 
আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে আমরা এভাবে আর বেশি দূর যেতে পারব কি না। অনেক ক্ষেত্রে আগাম জামিন মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটা চলতি সময়ের এক অপ্রিয় বাস্তবতা। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক চেহারা দেখে রায় দেওয়ার কথা অকপটে বলে থাকেন।
দিনে দিনে আগাম জামিনের প্রশ্নে হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায়ের সঙ্গে আরেকটির সংঘাত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বিএনপির নেতা, বারের বড় সদস্য এবং সংসদের সদস্য। বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক এবং বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে তাঁর আগাম জামিনের শুনানি হলো ২ ও ৩ মে। 
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আগাম জামিন প্রশ্নে একটি রায় দিয়ে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ এই কলামে লিখেছিলাম, এই রায় যথেষ্ট নয়। এর আলোকে নতুন আইন করতে হবে। ওই রায়ের পরে বেশ কিছুদিন হাইকোর্ট বেঞ্চগুলো আগাম জামিন দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মির্জা ফখরুলরা পলাতক হিসেবে হাইকোর্টে যান। তাই আমি আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ওই রায় কীভাবে শুনানিতে এসেছে, তা জানতে উদগ্রীব হই। এই রায়টি ৬২ ডিএলআর-এ ছাপা। মজার বিষয় হলো, এই রায় শুনানিতে আসেনি।
খোকন সাহেবকে জামিনদানকারী প্রথম বিচারক আনোয়ারুল হক সতর্কতার সঙ্গে ‘সাত দিনের’ জন্য পুলিশ ও ছোট কোর্টের কর্তব্য রদ করেন। সাফ বলে দেন, সাত দিন পরে তাঁকে দেওয়া আগাম জামিনের অস্তিত্ব থাকবে না। ৯ তারিখে যখন তিনি আত্মসমর্পণ করবেন, তখন আদালত স্বাধীনভাবে উচ্চ আদালতের জামিনের আদেশের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তাঁর এই রায়ের সঙ্গে একমত হননি কনিষ্ঠ বিচারপতি মজিবুর রহমান মিঞা। তিনি দ্বিমত পোষণ করে যা বলেন, তা-ই আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য। তাঁর কথায়, ‘নিম্ন আদালত স্বাধীন বলে আবেদনকারী মেনে নিয়েছেন। তাহলে তিনি কেন নিম্ন আদালতে না গিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেবেন, তা ব্যাখ্যা করেননি। সে কারণে জামিনের দরখাস্ত নাকচ করা হলো।’ খুবই দামি কথা। কিন্তু ৬২ ডিএলআরের ব্যাখ্যা নেই কেন, সেটা আমাদের প্রশ্ন।
এরপর আগ্রহ ছিল, তৃতীয় বিচারক নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা প্রশ্নে কী বলেছেন। তিনি কিছুই বলেননি। মনে করা হয়, জেলা জজদের মধ্য থেকে যাঁরা হাইকোর্টে বিচারক হন, তাঁরা নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার প্রশ্নে বেশি সংবেদনশীল। 
হরতাল মামলার আগাম জামিন নিয়ে তিনটি আলোচিত বেঞ্চের জ্যেষ্ঠরা সবাই জেলা জজ ছিলেন। প্রথম বিভক্ত রায়ের পরে গঠিত এক সদস্যের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি খন্দকার মুসা খালেদও কিন্তু তাঁর রায়ে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট রায়গুলোর ব্যাখ্যা দেননি। এমনকি তিনি কেন উল্লিখিত কনিষ্ঠ বিচারকের অভিমতের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না, তারও ব্যাখ্যা দেননি। সেখানেও ব্যক্তির মহিমা স্বীকৃত। বলা হয়েছে, তিনি সাংসদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, তাঁর মতো লোক পালিয়ে যেতে পারেন না।
পাঠক লক্ষ করবেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এমন সব কারণে জামিন চাইছেন এবং আদালত তা মঞ্জুর করছেন, তার বাস্তব ভিত্তি আলগা। যেমন ওই তৃতীয় বিচারক তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘ তাঁকে (খোকন) আগাম জামিন দেওয়া হয়েছে শুধু নিরাপদে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য।’ আচ্ছা বলুন তো, যাঁরা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ‘নিরাপদে’ হাইকোর্টে পৌঁছাতে পারেন, তাঁরা দায়রা আদালতে যেতে পারেন না কেন? পুরান ঢাকায় যানজট বেশি বলেই? তা ছাড়া সাত দিন পরে কী নিম্ন আদালত স্বাধীনতা অর্জন করবেন। রিজভীকে রিমান্ডে দেওয়ার দৃষ্টান্ত কি প্রমাণ করে? ছোট আদালতে কীভাবে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন? তাঁরা না পেলে নাগরিকেরা পাবে বা পাচ্ছে কীভাবে? আমরা তো বুঝি, অভিযোগপত্র দেওয়ামাত্রই ওই মামলা কোয়াশ করতে তাঁরা আবার হাইকোর্টেই ছুটবেন। স্টে নেবেন। ছোট আদালত হয়তো বড় বাপের পোলাদের বিরুদ্ধে ‘সাজানো মামলা’ বিচার করারই সুযোগ পাবেন না।
সর্বোচ্চ আদালত অবশ্য বলেছেন, সরকারের দ্বারা ছোট কোর্ট কব্জা রাখা সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ শুধরে বাহাত্তরের সংবিধানে না ফিরলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘দূরবর্তী ঢোলের শব্দ’ হয়ে থাকবে। ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির এক আলোচনায় আমার এ কথার জবাবে আইন প্রতিমন্ত্রী সোমবার স্পষ্ট বলেছেন, তাঁরা বাহাত্তরে ফিরবেন না। এটা সম্ভব নয়। ওই আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বিএনপি নেতা বার সভাপতিও নিরুত্তর ছিলেন। তাহলে ‘সরকারনিয়ন্ত্রিত আদালত’ই কি আমজনতার নিয়তি? 
হরতাল মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় তো জামিনের পক্ষেই ছিল। অথচ বাইরে পুলিশ ও র‌্যাব বেষ্টিত সোমবারের শ্বাসরুদ্ধকর শুনানিতে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও কনিষ্ঠ বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কিন্তু পুনরায় বিভক্ত হলেন। আসামি পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি আইন আঁকড়ানোর চেয়ে আবেগে ভাসলেন। বললেন, বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক থাকতে হবে। যাতে রাজনৈতিক প্রভাব না পড়ে ইত্যাদি। তবে ওইদিন আদালতের সিদ্ধান্ত উত্তেজনা প্রশমিত করেছে। 
লক্ষণীয়, ওই দিনের শুনানিতেও রাষ্ট্রপক্ষ ৬২ ডিএলআর এ বর্ণিত আপিল বিভাগের নির্দেশনা উল্লেখ করেননি। তবে সোমবার দুই মাননীয় বিচারপতি রুল জারিসংক্রান্ত যে বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন, তা আমাকে ৬৩ ডিএলআরের (২০১০) একটি সিদ্ধান্ত মনে করিয়ে দিয়েছে। আপিল বিভাগ এতে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চকে পরোক্ষভাবে তিরস্কার করেছিলেন। সেটিও ছিল আগাম জামিনের মামলা। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই মামলায় আট সপ্তাহের সময় দিয়ে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার কিংবা হয়রানি করা যাবে না। ক্ষুব্ধ আপিল বিভাগ বলেন, ‘আমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত বাধ্যকর। এর লঙ্ঘন ঘটানো হলে তা শুধু আদালত অবমাননাকর নয়, সংবিধান লঙ্ঘনেরও শামিল।’ তাই সোমবারের সিদ্ধান্তের লিখিত আদেশ ও তৃতীয় বেঞ্চের রায়ের জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকব।
আগাম জামিন যাতে নিম্ন আদালত দিতে পারেন, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে উপযুক্ত প্রশাসনিক আদেশ জারি করতে হবে। বিএনপিকে বলতে হবে, তাঁরা আইন প্রতিমন্ত্রীর ওই কথায় একমত কি না। তাঁরা প্রতিমন্ত্রীর বহু মন্তব্যের তুলাধোনা করেন, এটা করবেন না। 
আগাম জামিনের জন্য শুধু হাইকোর্টমুখী থাকার রেওয়াজ বদলাতে হবে। সামনে সাধারণ নির্বাচন। লোক ঠকানোর জন্য হলেও তাঁরা যেন একটা ফাঁকা বুলি আওড়ান। মির্জা ফখরুল, এম কে আনোয়ার প্রমুখ আর কুস্তি লড়ে নিজেরা হাইকোর্টে যাবেন না। নাগরিকদেরও যেতে দেবেন না। আগাম জামিনের যখনই যার দরকার পড়বে, বড় বাপ-ছোট বাপের পোলানির্বিশেষে তাঁরা তাঁদের বাড়ির কাছের ‘সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত’ আদালতেই যাবেন। 
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

পড়ন্ত বিকেলের অতিথি হিলারি


হিলারির সঙ্গে তাঁর মেয়ে চেলসি। ৩ এপ্রিল, ১৯৯৫ যশোরের এক গ্রাম থেকে তোলা ছবি
হিলারির সঙ্গে তাঁর মেয়ে চেলসি। ৩ এপ্রিল, ১৯৯৫ যশোরের এক গ্রাম থেকে তোলা ছবি
এপি
এক পড়ন্ত বিকেলের অতিথি হয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আজ আসছেন। মেয়াদের দিক থেকে এই পড়ন্ত বিকেল শেখ হাসিনা ও বারাক ওবামা উভয়ের জন্য সত্য। শেখ হাসিনার জন্য বেশি সত্য। তবু বেইজিং থেকে ঢাকা হয়ে হিলারির দিল্লি সফর বিশ্বকূটনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব নিশ্চিত করেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত বাংলাদেশে ২০০৮ সালে একটি জঙ্গিবাদবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির বিজয়ের পর ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের অগ্রগতি ও যতটা গতিসঞ্চার প্রত্যাশিত ছিল, সেটা ঘটেনি।
হিলারি এক অস্থির, ইলিয়াস আলীর গুমজনিত গুমোট পরিবেশে বাংলাদেশে, যখন রাজনৈতিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে এবং আরেকটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কি হবে না—সেই দুশ্চিন্তায় আমরা সবাই জেরবার। 
যুক্তরাষ্ট্রের মুখ্য চাওয়া, টিকফা তারা হয়তো এখনই পাবে না। কিংবা বাংলাদেশের মুখ্য চাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগও মিলবে না। তেমন কোনো দয়াদাক্ষিণ্য ছাড়াই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। আফ্রিকার স্বল্পোন্নতরা যখন বিনা শুল্কে, তখন আমরা ১৭ থেকে ৩২ ভাগ পর্যন্ত শুল্ক দিয়ে ঢুকি। ইউনিসেফ ও ইউএনডিপির সাহায্য গ্রহণকারীদের তালিকার প্রায় শীর্ষে আমরা থাকি, ইউএসএইডে থাকি না। মাতবরের মাথায় ছাতি ধরার স্বস্তি নিয়ে হাইতিতে আমরা বিল ক্লিনটনের ডাকে সাড়া দিই। সবার আগে সৈন্য পাঠাই। জর্জ বুশের সন্ত্রাসী যুদ্ধের হাতিয়ার হই। আফগানিস্তানে হামলা চালাতে আমরা ‘শূন্য শুল্কে’ জল-স্থল-অন্তরিক্ষ ইজারা দিই। এর বিনিময়ে আমরা যথাপ্রতিদান পাই না। এখন তাদের আগ্রহেই কৌশলগত নতুন চুক্তিতে আমরা হয়তো ঢুকব, কিন্তু মর্যাদার সঙ্গে কী পাব?
মাত্র ছয় মাস আগে হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। এই চিঠির শেষ বাক্যটি এ রকম: ‘আশা করি একটি উন্নত পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আমার পুনরায় বাংলাদেশ সফর সম্ভব করে তুলবে।’ হিলারি কি তাঁর ‘উন্নত পরিস্থিতি’র দেখা পেয়েছেন, না পাবেন?
হিলারি লিখেছিলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক হয়রানি, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার এবং কতিপয় এনজিওর ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে বের করতে আমি গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম।’ কিন্তু বিষয়টি ঝুলে আছে। বৃহস্পতিবার একজন ওয়াকিবহাল জ্যেষ্ঠ বাংলাদেশি কূটনীতিকের কাছে জানতে চাইলাম, এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের তরফ থেকে এখনো প্রশ্ন ওঠে কি না। তিনি বললেন, প্রশ্ন ওঠে। আমরা বলি, গ্রামীণ ব্যাংক কারও ব্যক্তির নয়, এটা রাষ্ট্রের। নতুন এমডি খুঁজে পেতে একটি বাছাই কমিটি কাজ করছে।
হিলারির অন্যান্য অভিযোগ অপনোদনের কোনো চেষ্টাও অবশ্য আমরা দেখিনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। দুই নেত্রীর তিক্ততা প্রকট হয়েছে। হিলারি অভিযোগ করেছিলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায়, নাগরিক সমাজের প্রতি আপনার সরকারের সমর্থনে ঘাটতি আছে। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো শক্তিশালীকরণেও অনিশ্চয়তা চলছে। তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে এই ঘাটতির বিষয়ে শুধু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নয়, কংগ্রেস সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্পন্দমান নাগরিক সমাজেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ক্ষমতাসীন দল এর প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করারও কোনো দরকার আছে বলে মনে করেছে বলে আমরা প্রমাণ পাই না। হিলারির সফরকে সমানে রেখে দীপু মনি যখন সার্বভৌমত্বের কথা বলেন, তখন আমরা তা মানি। কিন্তু যখন শত গুম সত্ত্বেও তিনি বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয়, তখন তা মানতে অপারগ।
‘গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো’ কী, হিলারি তাঁর ওই চিঠিতে তা ভেঙে বলেননি। তবে গত ২৩ এপ্রিল হিলারি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক এক ভাষণে গণতন্ত্রের স্তম্ভ সংজ্ঞায়িত করেন। বলেন, সংখ্যালঘুর প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দেওয়া হলো গণতন্ত্রের স্তম্ভ। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংখ্যালঘু পরিস্থিতির তুলনামূলক উন্নতি ঘটেছে। তবে স্পষ্টতই বিরোধীদলীয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সরকার সহ্য করেনি। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে। আর গণতন্ত্রের যে স্তম্ভটি মজবুত না থাকলে গণতন্ত্র থাকার দাবি করাই অর্থহীন, সেখানে বাংলাদেশে অবশ্যই অবনতি ঘটেছে। ভয়ংকর অবনতি ঘটেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে সামান্য কিছু আর অবশিষ্ট রয়েছে। হিলারির সঙ্গে কথা বলে খালেদা জিয়া সন্তুষ্ট হতে পারেন। কারণ, অবাধ নির্বাচন প্রশ্নে হিলারি যা বলতে পারেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকেই ইঙ্গিত স্পষ্ট হতে পারে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে হিলারি বলেছিলেন, রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র‌্যাফ দুবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। এই বিচার কীভাবে হিলারির কথায় ‘স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ’ হয়, সে জন্য র‌্যাফ সরকারকে ‘সমন্বিত সুপারিশ’ রেখেছেন। যত দূর সম্ভব, বিচারে সহায়তা দিতে রাষ্ট্রদূত র‌্যাফ সদা প্রস্তুত থাকবেন বলেও হিলারি ক্লিনটন উল্লেখ করেছিলেন। আমরা অবশ্য কখনো জানতে পারিনি র‌্যাফের ‘সমন্বিত সুপারিশমালা’ কী ছিল এবং তার কতটা সরকার পালন করেছে কিংবা করেনি। তবে আমি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেব মাও সে-তুংয়ের সঙ্গে হিলারির পূর্বসূরি হেনরি কিসিঞ্জারের সংলাপ। বেইজিংয়ে গিয়ে কিসিঞ্জার চীনা নেতাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যাতে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারে, আমি দরকার হলে সেটা পররাষ্ট্রনীতির অংশে পরিণত করব।’ মার্কিন সরকারের অবমুক্ত করা অনেক গোপন দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিসিঞ্জার সেটা করেছিলেন। খাদ্যাস্ত্র ব্যবহার করে কিসিঞ্জার বাংলাদেশের মানুষকে কষ্ট দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিচার-প্রচেষ্টার আন্তরিক উদ্যোগ তিনি ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন। আমি সব সময় বলি, একাত্তরের গণহত্যাকারীদের প্রতি নৈতিক সমর্থন দেওয়ার দায় স্বীকার করে ওবামা-হিলারির উচিত, বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা। তাঁরা কেন অতীতের গ্লানি বয়ে বেড়াবেন।
আজ হিলারির সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রবার্ট ও ব্লেক থাকবেন। তিনি বাংলাদেশে একাধিকবার এসেছেন। গত ২৭ এপ্রিল হনলুলুতে অবস্থিত ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারে ‘দক্ষিণ এশিয়ায় মুখ্য উন্নয়ন’ শীর্ষক যে বক্তব্য দেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। একটা কথা চালু আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দিল্লির চশমা দিয়ে দেখে। এই ধারণায় ওয়াশিংটনের কোনো কোনো মহল একদা আচ্ছন্ন থাকলেও সাম্প্রতিক কালে এখানে পরিবর্তন এসেছে। অনেকের মতে, তার মূলে চীন। কর্ণফুলীর মোহনায় কনটেইনার পোর্ট করতে না পারার যাতনা নিয়ে ওয়াশিংটন এখন তীক্ষ চোখ রাখছে, প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরটির নির্মাণকাজ চীনারা পায় কি না। এই উদ্বেগ দিল্লির থাকাও অস্বাভাবিক নয়। তবে বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের এবং দিল্লিতে নিযুক্ত আমাদের হাইকমিশনার আহমাদ তারিক করিমের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের স্থিতি ও উন্নতি দুই দেশের স্বার্থের রক্ষাকবচ—এটা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বুঝতে পেরেছে। চীনেরও তাতে শিরঃপীড়া নেই।
হনলুলুতে ব্লেক বলেছেন, ‘আমরা দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এমন পর্যায়ে তুলতে চাইছি, যখন এক মুহূর্তের নোটিশে আমাদের সামরিক বাহিনী একটি যৌথ শান্তিরক্ষা অপারেশন কিংবা একটি যৌথ মানবিক উদ্ধার-তৎপরতায় অবতীর্ণ হতে পারে।’ 
ব্লেক সুসম্পর্কের আরও দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন, তার বিবরণ আর দিতে চাই না। সুতরাং, দিল্লি-ওয়াশিংটনের এই গভীর সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে আমি যখন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার আহমাদ তারিক করিমের কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা, বলুন তো ‘আমাদের পানি সমস্যা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হিলারি ক্লিনটন কি আমাদের জন্য কোনো কথা বলতে পারেন? তিনি হাসলেন। বললেন, আমাদের তো এখানে কিছুই বলার নেই। যদি তিনি বলেন সেটা তাঁর ইচ্ছে।’ হিলারি ভারত সফরে সব সময় কোনো একটি নতুন রাজ্য বেছে নেন। কিন্তু কলকাতায় হিলারির প্রথম সফরকে লাল দুর্গের পতন উদ্যাপন হিসেবেও কেউ দেখতে পারেন। 
গতকাল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের মুখপত্র দৈনিক গণশক্তির প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম: ‘মমতা-হিলারি আলোচনায় বাংলাদেশ কেন, প্রশ্ন উঠছে কূটনৈতিক মহলে।’ এর উৎস ওয়াশিংটন থেকে পিটিআইএর পাঠানো একটি খবর। এতে বলা হয়েছে, ‘হিলারি ক্লিনটন মনে করেন, মমতার সঙ্গে কথা বলার এটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং তার বাইরের বিষয় নিয়েও কথা বলবেন। আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছি।’ পশ্চিমবঙ্গ যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী, সে কথাও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।
২০০৯ সালে ভারত সফরকালে হিলারির ঢাকায় আসার কথা ছিল। এর আগে তিনি ইয়াঙ্গুন ও ইসলামাবাদ সফর করেছেন। ঢাকায় আসার সময় তাঁর হয়নি। বড় ঝড়ের আগে অনেক সময় বাংলাদেশে বড় আন্তর্জাতিক নেতার আগমন ঘটে। আগামী নভেম্বরেই হিলারি নির্বাচনের পিঁড়িতে বসবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ছাড়াও স্পিকার, বাণিজ্য, শিল্প, অর্থ, স্থানীয় সরকার, শ্রম ও জনশক্তি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করেছেন। কিন্তু ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়া হয়নি শেখ হাসিনার। তেমন কোনো আমন্ত্রণও নেই। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের পরে অপেক্ষাকৃত শান্তি ও স্থিতিকালে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পরীক্ষিত মিত্র শেখ হাসিনার উপযুক্ত কদর ওয়াশিংটন করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। ড. ইউনূসের প্রতি সরকারের অমার্জনীয় আচরণে আমরা ব্যথিত। কিন্তু আমরা মানতে পারি না যে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতেও এবং যিনি ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের উন্নয়নে সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তাঁকে ওবামা ও হিলারি সত্যিকারের কোনো সহায়তা দিতে পারেননি। তবু এই পড়ন্ত বিকেলে হিলারি ক্লিনটন যদি মমতাকে বোঝাতে পারেন, তাহলে মঙ্গল। বিপদে বন্ধুর পরিচয়। 
আজ বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত প্রণব মুখার্জিও আসছেন। তাঁর সফরও তাঁর সরকারের একপ্রকার বেলা শেষের। মমতা-কাঁটায় তাঁরাও কম বিদ্ধ নন। শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে বাড়তি কিছু নয়, ন্যায্য কিছু দিলেই চলে। জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ যদি দিল্লি ও ওয়াশিংটনের স্বার্থের পরিপূরক হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে ওবামা-মনমোহনের একযোগে কিছু করা জরুরি নয় কি?
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।

mrkhanbd@gmail.com