বাস পোড়ানোর মামলার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে—এ কথা বিচারিক আদেশেই লেখা হয়েছে। বিচার ছাড়াই কী করে এটা লেখা সম্ভব হলো, তা হাইকোর্ট বিভাগ খতিয়ে দেখতে পারেন। তবে গতকাল বিরোধীদলীয় পাঁচজন সংসদ সদস্যকে হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আমি একটি অনুরোধ করতে চাই। সেটি হলো, একটি সিডি জাতির সামনে প্রকাশ করা। ওই মামলার অন্য আসামিদের কেন মুক্তি দেওয়া হবে না, সে মর্মে রাষ্ট্র কী অবস্থান নিতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের একটা ধারণা আছে। আর সেখানে ওই সিডি হতে পারে একটি বিরাট হাতিয়ার। কারণ, মির্জা ফখরুলেরা বাস পোড়াতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে যেসব গোপনীয় সলাপরামর্শ করেছেন, তা নাকি সব বন্দী আছে ওই সিডিতে। অন্তত জামিন নাকচ করে দেওয়া মহানগর হাকিম ও মহানগর দায়রা জজের লেখা আদেশগুলো পড়ে তেমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে।
আমি দুঃখিত যে বাজেট অধিবেশন শুরুর দিনে গতকালের জামিন দেওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগের তেমন স্বাধীনতা দেখি না। স্বাধীনতা দেখতাম ও দেখব, যদি দেখি হাইকোর্ট বিভাগ ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন’ বিবেচনায় এ রকম একটি মামলার পূর্ণ বিচার করতে আগ্রহী হতেন বা হচ্ছেন। ৬০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার আইন বহাল থাকতে সেই আইনে কী করে ছয় মাসের জামিন হতে পারে, সে আরেক প্রশ্ন। বিএনপির জামিন পাওয়া নেতারা দ্রুতই পুরো মামলা কোয়াশ করতে হাইকোর্টে আসবেন। তখন যদি স্থগিতাদেশ আসে, তাহলে তো আর কথাই নেই। আমরা এ রকম চক্কর থেকে বেরোতে চাই।
সংবিধানে ১১০ নামে একটি অনুচ্ছেদ আছে। এটি বলছে, হাইকোর্ট দরকার হলে বিচারিক আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহার করে আনতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের উচিত নবতর দৃষ্টান্ত স্থাপনে সচেষ্ট হওয়া। আমরা চাই, জামিন কিংবা কোয়াশ নয়, এ মামলার বিচারিক আদালত হোক হাইকোর্ট। কিন্তু এটা হবে না। কারণ, রাষ্ট্র সত্যকে ভয় পায়। সে নিজের সামন্ত চরিত্র উন্মোচিত করতে চায় না। আর আদালত রাষ্ট্রের অন্তর্গত।
অর্ধডজন সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ মাইক্রোবাসে চড়ে এসে নিজেরাই বাসে আগুন দিয়েছেন। এটা কি যেইসেই অভিযোগ! জুতার ফিতা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানোর পুলিশি গল্প আমরা জানি। ক্রসফায়ারের গল্পে আমরা অভ্যস্ত। জজ মিয়াকাহিনি বা বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধানকে ঘড়ি চুরির মামলায় অভিযুক্ত করার মতো বিএনপি-মার্কা কাণ্ড সমাজে আকসার ঘটছে।
এ ধরনের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার আসামিরা জামিন পেলেই বাঁচেন। রাজনীতিক হলে তো কথাই নেই। এবার কত ভুঁইফোড় নেতা, ত্যাগী গণতন্ত্রীর তকমা পাবেন। তারা ছাড়া পেয়ে সাজানো মামলার প্রতিকার চান না বা চাওয়ার ইচ্ছা কিংবা তাগিদ কোনোটাই তাঁদের থাকে না। তবে ২০০২ সালের যে আইনটির আওতায় এবারের ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ মামলাটি করা হয়েছে, সেখানে মিথ্যা মামলা করার শাস্তির বিধান আছে। এর ৬ ধারায় বলা আছে, যদি কেউ ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা মামলা করেন, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কমপক্ষে দুই বছর ও অনধিক পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। এজাহারের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও ওই একই দণ্ড।
ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে আগামী আগস্টের গোড়ায় ওই মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারিক হাকিম মোহম্মদ এরফান উল্লাহ ‘অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেছেন। সাংসদ মাহবুব উদ্দিন খোকন কী অপরাধ করেছেন, তা অভিযোগপত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। অথচ বিচারক তাঁর আদেশে লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে এই মামলার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আসামিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া সংগত নয় বিধায় আসামির জামিনের প্রার্থনা নামঞ্জুর করা হলো।’ সপ্তাহের ব্যবধানে একজন সাংসদের জামিন নিচের আদালতে নাকচ ও ওপরের আদালতে কেন মঞ্জুর হলো, তার কৈফিয়ত কে দেবেন।
ওই মহানগর হাকিমের আদালতে জামিন নাকচের পর ৩৩ জন নেতা ধরনা দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজকোর্টে। বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল হক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় জামিন নাকচ করে লিখেছেন, ‘প্রসিকিউশন পক্ষে বিজ্ঞ পিপি আসামির জামিনের ঘোর বিরোধিতা করে উল্লেখ করেন যে, অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে এবং অভিযোগপত্র গৃহীত হয়েছে।’ তিনি এমনভাবে বিচারিক আদেশ লিখেছেন, যাতে মনে হতে পারে তাঁর ঝোঁক নিরপেক্ষ নয়, রাষ্ট্রের প্রতি পক্ষপাতে স্পষ্ট, তাঁর বর্ণনায়, ‘আসামিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুঠোফোনে ঘটনা ঘটানোর বিষয়ে নির্দেশ দেয়, যা ঘটনাস্থলে ধৃত আসামিরা বর্ণনা করেছে। আসামিদের উক্ত রূপ নির্দেশের বক্তব্যের সিডি প্রসিকিউশন পক্ষের কাছে আছে। এবং আসামিদের টেলিফোনের বক্তব্য সব রেকর্ড করা আছে। এবং উক্ত রূপ বক্তব্য অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।’ পিপির বরাতে মহানগর দায়রা জজের এই বিবরণ কিন্তু অভিযোগপত্র সমর্থন করে না। অথচ পিপি ও বিচারকের সামনে অভিযোগপত্র ছাড়া আসামিদের বিষয়ে অন্য কোনো দলিল ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। বিচারকের তো উন্মুক্ত এজলাসের বাইরে গোপনে সিডি বা অন্য কোনো প্রমাণ দেখে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মহানগর দায়রা জজ তাঁর আদেশে পিপির বরাতে আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথক সিডি আছে, যাতে প্রমাণিত হবে যে আসামি কথিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। এমতাবস্থায় পিপি আসামির জামিনের বিরোধিতা করেন।’
আমরা বাস পোড়ানো ও ককটেল ফাটানোর দুটি মামলাই সাজানো হিসেবে গোড়া থেকেই সন্দেহ করে আসছি। কিন্তু এখন আমরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজের কাছ থেকে দালিলিকভাবে জানতে পারলাম, ‘অভিযোগপত্রে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ কীভাবে প্রমাণিত, তা সিডিতে ধারণ করা আছে।’
সেই কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রধান অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবুকে গতকাল ফোন করলাম। সিডি যখন আদালতে দেওয়া হয়েছে, তখন সেটা পাবলিক রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। এটা আর গোপনীয় বিষয় হতে পারে না। তাই খুব ভরসা করে তাঁর কাছে সিডির কপি চাইলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বিস্মিত করলেন। বললেন, অভিযোগপত্রের বাইরে আর কিছু তাঁর জানা নেই। সিডির কপি আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। তাঁর যুক্তি: এই সিডি তো জামিনের শুনানির সময় আদালতে দেওয়ার বিষয় নয়। যখন সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রশ্ন আসবে, তখন এটা আদালত শুনবেন।
আমি তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললাম, তাহলে বিচারকের আদেশে কীভাবে লেখা হলো, ‘আসামিদের উক্ত রূপ বক্তব্যের সিডি প্রসিকিউশন পক্ষের কাছে আছে।’ তিনি বললেন, এটা আদালতের বিষয়। আমি তখন তাঁকে প্রশ্ন করলাম, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথক সিডি আছে, সেটা আপনি কোথায় পেলেন? পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, আমি সিডির বিষয় শুনিনি। দেখিওনি। বললাম, বিচারকেরা শুনেছেন? পিপি বললেন, না। প্রশ্ন করি, তাহলে এটা কোথায় আছে? তিনি বললেন, ‘এটা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে।’
আমরা অবশ্যই আশা করব, যে মামলাকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলীয় রাজনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে, সেই মামলার এত বড় অকাট্য প্রমাণ এখনো শুধু গোয়েন্দা সংস্থার হাতে থাকবে কেন। আদালতের কাছে যখন তাঁরা সিডির কথা প্রকাশ করেছে, তখন তার বিষয়বস্তু জাতির সামনে পুরোপুরি প্রকাশ করতে অসুবিধা কী।
মির্জা ফখরুলেরা এখনো কারাগারে। সুতরাং অভিযোগপত্রে বর্ণিত সিডির কথিত টেলিফোনের বিবরণে কী আছে, তা আমরা জানতে চাই। অভিযোগপত্র পাঠে মনে হয়, এখানে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে। সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মেশানো হয়েছে। অভিযোগপত্রটির লেখক ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য উত্তর বিভাগের জঙ্গি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ টিমের পুলিশ পরিদর্শক মো. নুরুল আমিন। তিনি শুধু লিখেছেন ‘ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও বোমাবাজি ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে হরতাল সফল করার নিমিত্তে আসামিরা পারস্পরিক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যে কথোপকথন করেছে তার রেকর্ডকৃত সিডি সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করি।’ এর মধ্যে আমরা পিপি ও বিচারিক আদেশের সিডিকথনের মিল পাই না।
আমরা দালিলিকভাবে অভিযোগপত্রের ভাষ্যের সঙ্গে পিপি ও বিচারিক আদেশের সিডিসংক্রান্ত ভাষ্যের অমিলটাই বেশি লক্ষ করি। অভিযোগপত্রে নির্দিষ্টভাবে এটা বলা হয়নি যে বাসটি (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২১০৯) পোড়ানোর বিষয়ে সিডিতে বক্তব্য রয়েছে। তাহলে অভিযোগপত্রে বিরোধীদলীয় ৪২ জন নেতাকে কী কথা বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তদন্তকালে সাক্ষ্য-প্রমাণে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাদৃষ্টে এজাহারে বর্ণিত আসামিগণ রতন, আমান, আব্বাস, দুলু, মিলন, আলম, গয়েশ্বর ও এ্যানি “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনা” দিয়েছেন।’
মির্জা ফখরুলসহ ৩৪ জন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাঁরা ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসযোগে ওই বাসটির গতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কন্ডাক্টর সোহান মিয়া ও হেলপার জসিমের সহায়তায় ৩২ জন নেতা বাসটি থামিয়ে তা ভাঙচুর করেন ও আগুন লাগান। অভিযোগপত্র দাখিলকারী নুরুল আমিন নির্দিষ্টভাবে আর কোনো বক্তব্য কিংবা তথ্য দাখিল করেননি। তিনি কিন্তু একা এ অভিযোগের দায়িত্ব নেননি। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং পিপির মতামত নিয়ে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নাম অভিযোগপত্রে নেই। তবে ৯ মে ২০১২, ১০২৪ নম্বর স্মারকসূত্র ধরে খুঁজলেই তা পাওয়া যাবে।
এটি যদি মিথ্যা মামলাই হবে, তাহলে কি আমরা দেখব, এজাহার ও অভিযোগপত্র প্রস্তুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দুই থেকে অনধিক পাঁচ বছর লাল দালানের ভাত খাচ্ছেন?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আমি দুঃখিত যে বাজেট অধিবেশন শুরুর দিনে গতকালের জামিন দেওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগের তেমন স্বাধীনতা দেখি না। স্বাধীনতা দেখতাম ও দেখব, যদি দেখি হাইকোর্ট বিভাগ ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন’ বিবেচনায় এ রকম একটি মামলার পূর্ণ বিচার করতে আগ্রহী হতেন বা হচ্ছেন। ৬০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার আইন বহাল থাকতে সেই আইনে কী করে ছয় মাসের জামিন হতে পারে, সে আরেক প্রশ্ন। বিএনপির জামিন পাওয়া নেতারা দ্রুতই পুরো মামলা কোয়াশ করতে হাইকোর্টে আসবেন। তখন যদি স্থগিতাদেশ আসে, তাহলে তো আর কথাই নেই। আমরা এ রকম চক্কর থেকে বেরোতে চাই।
সংবিধানে ১১০ নামে একটি অনুচ্ছেদ আছে। এটি বলছে, হাইকোর্ট দরকার হলে বিচারিক আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহার করে আনতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের উচিত নবতর দৃষ্টান্ত স্থাপনে সচেষ্ট হওয়া। আমরা চাই, জামিন কিংবা কোয়াশ নয়, এ মামলার বিচারিক আদালত হোক হাইকোর্ট। কিন্তু এটা হবে না। কারণ, রাষ্ট্র সত্যকে ভয় পায়। সে নিজের সামন্ত চরিত্র উন্মোচিত করতে চায় না। আর আদালত রাষ্ট্রের অন্তর্গত।
অর্ধডজন সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ মাইক্রোবাসে চড়ে এসে নিজেরাই বাসে আগুন দিয়েছেন। এটা কি যেইসেই অভিযোগ! জুতার ফিতা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানোর পুলিশি গল্প আমরা জানি। ক্রসফায়ারের গল্পে আমরা অভ্যস্ত। জজ মিয়াকাহিনি বা বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধানকে ঘড়ি চুরির মামলায় অভিযুক্ত করার মতো বিএনপি-মার্কা কাণ্ড সমাজে আকসার ঘটছে।
এ ধরনের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার আসামিরা জামিন পেলেই বাঁচেন। রাজনীতিক হলে তো কথাই নেই। এবার কত ভুঁইফোড় নেতা, ত্যাগী গণতন্ত্রীর তকমা পাবেন। তারা ছাড়া পেয়ে সাজানো মামলার প্রতিকার চান না বা চাওয়ার ইচ্ছা কিংবা তাগিদ কোনোটাই তাঁদের থাকে না। তবে ২০০২ সালের যে আইনটির আওতায় এবারের ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ মামলাটি করা হয়েছে, সেখানে মিথ্যা মামলা করার শাস্তির বিধান আছে। এর ৬ ধারায় বলা আছে, যদি কেউ ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা মামলা করেন, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কমপক্ষে দুই বছর ও অনধিক পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। এজাহারের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও ওই একই দণ্ড।
ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে আগামী আগস্টের গোড়ায় ওই মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারিক হাকিম মোহম্মদ এরফান উল্লাহ ‘অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেছেন। সাংসদ মাহবুব উদ্দিন খোকন কী অপরাধ করেছেন, তা অভিযোগপত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। অথচ বিচারক তাঁর আদেশে লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে এই মামলার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আসামিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া সংগত নয় বিধায় আসামির জামিনের প্রার্থনা নামঞ্জুর করা হলো।’ সপ্তাহের ব্যবধানে একজন সাংসদের জামিন নিচের আদালতে নাকচ ও ওপরের আদালতে কেন মঞ্জুর হলো, তার কৈফিয়ত কে দেবেন।
ওই মহানগর হাকিমের আদালতে জামিন নাকচের পর ৩৩ জন নেতা ধরনা দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজকোর্টে। বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল হক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় জামিন নাকচ করে লিখেছেন, ‘প্রসিকিউশন পক্ষে বিজ্ঞ পিপি আসামির জামিনের ঘোর বিরোধিতা করে উল্লেখ করেন যে, অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে এবং অভিযোগপত্র গৃহীত হয়েছে।’ তিনি এমনভাবে বিচারিক আদেশ লিখেছেন, যাতে মনে হতে পারে তাঁর ঝোঁক নিরপেক্ষ নয়, রাষ্ট্রের প্রতি পক্ষপাতে স্পষ্ট, তাঁর বর্ণনায়, ‘আসামিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুঠোফোনে ঘটনা ঘটানোর বিষয়ে নির্দেশ দেয়, যা ঘটনাস্থলে ধৃত আসামিরা বর্ণনা করেছে। আসামিদের উক্ত রূপ নির্দেশের বক্তব্যের সিডি প্রসিকিউশন পক্ষের কাছে আছে। এবং আসামিদের টেলিফোনের বক্তব্য সব রেকর্ড করা আছে। এবং উক্ত রূপ বক্তব্য অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।’ পিপির বরাতে মহানগর দায়রা জজের এই বিবরণ কিন্তু অভিযোগপত্র সমর্থন করে না। অথচ পিপি ও বিচারকের সামনে অভিযোগপত্র ছাড়া আসামিদের বিষয়ে অন্য কোনো দলিল ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। বিচারকের তো উন্মুক্ত এজলাসের বাইরে গোপনে সিডি বা অন্য কোনো প্রমাণ দেখে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মহানগর দায়রা জজ তাঁর আদেশে পিপির বরাতে আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথক সিডি আছে, যাতে প্রমাণিত হবে যে আসামি কথিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। এমতাবস্থায় পিপি আসামির জামিনের বিরোধিতা করেন।’
আমরা বাস পোড়ানো ও ককটেল ফাটানোর দুটি মামলাই সাজানো হিসেবে গোড়া থেকেই সন্দেহ করে আসছি। কিন্তু এখন আমরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজের কাছ থেকে দালিলিকভাবে জানতে পারলাম, ‘অভিযোগপত্রে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ কীভাবে প্রমাণিত, তা সিডিতে ধারণ করা আছে।’
সেই কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রধান অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবুকে গতকাল ফোন করলাম। সিডি যখন আদালতে দেওয়া হয়েছে, তখন সেটা পাবলিক রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। এটা আর গোপনীয় বিষয় হতে পারে না। তাই খুব ভরসা করে তাঁর কাছে সিডির কপি চাইলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বিস্মিত করলেন। বললেন, অভিযোগপত্রের বাইরে আর কিছু তাঁর জানা নেই। সিডির কপি আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। তাঁর যুক্তি: এই সিডি তো জামিনের শুনানির সময় আদালতে দেওয়ার বিষয় নয়। যখন সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রশ্ন আসবে, তখন এটা আদালত শুনবেন।
আমি তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললাম, তাহলে বিচারকের আদেশে কীভাবে লেখা হলো, ‘আসামিদের উক্ত রূপ বক্তব্যের সিডি প্রসিকিউশন পক্ষের কাছে আছে।’ তিনি বললেন, এটা আদালতের বিষয়। আমি তখন তাঁকে প্রশ্ন করলাম, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পৃথক সিডি আছে, সেটা আপনি কোথায় পেলেন? পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, আমি সিডির বিষয় শুনিনি। দেখিওনি। বললাম, বিচারকেরা শুনেছেন? পিপি বললেন, না। প্রশ্ন করি, তাহলে এটা কোথায় আছে? তিনি বললেন, ‘এটা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে।’
আমরা অবশ্যই আশা করব, যে মামলাকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলীয় রাজনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে, সেই মামলার এত বড় অকাট্য প্রমাণ এখনো শুধু গোয়েন্দা সংস্থার হাতে থাকবে কেন। আদালতের কাছে যখন তাঁরা সিডির কথা প্রকাশ করেছে, তখন তার বিষয়বস্তু জাতির সামনে পুরোপুরি প্রকাশ করতে অসুবিধা কী।
মির্জা ফখরুলেরা এখনো কারাগারে। সুতরাং অভিযোগপত্রে বর্ণিত সিডির কথিত টেলিফোনের বিবরণে কী আছে, তা আমরা জানতে চাই। অভিযোগপত্র পাঠে মনে হয়, এখানে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে। সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মেশানো হয়েছে। অভিযোগপত্রটির লেখক ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য উত্তর বিভাগের জঙ্গি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ টিমের পুলিশ পরিদর্শক মো. নুরুল আমিন। তিনি শুধু লিখেছেন ‘ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও বোমাবাজি ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে হরতাল সফল করার নিমিত্তে আসামিরা পারস্পরিক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যে কথোপকথন করেছে তার রেকর্ডকৃত সিডি সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করি।’ এর মধ্যে আমরা পিপি ও বিচারিক আদেশের সিডিকথনের মিল পাই না।
আমরা দালিলিকভাবে অভিযোগপত্রের ভাষ্যের সঙ্গে পিপি ও বিচারিক আদেশের সিডিসংক্রান্ত ভাষ্যের অমিলটাই বেশি লক্ষ করি। অভিযোগপত্রে নির্দিষ্টভাবে এটা বলা হয়নি যে বাসটি (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২১০৯) পোড়ানোর বিষয়ে সিডিতে বক্তব্য রয়েছে। তাহলে অভিযোগপত্রে বিরোধীদলীয় ৪২ জন নেতাকে কী কথা বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তদন্তকালে সাক্ষ্য-প্রমাণে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাদৃষ্টে এজাহারে বর্ণিত আসামিগণ রতন, আমান, আব্বাস, দুলু, মিলন, আলম, গয়েশ্বর ও এ্যানি “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনা” দিয়েছেন।’
মির্জা ফখরুলসহ ৩৪ জন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাঁরা ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসযোগে ওই বাসটির গতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কন্ডাক্টর সোহান মিয়া ও হেলপার জসিমের সহায়তায় ৩২ জন নেতা বাসটি থামিয়ে তা ভাঙচুর করেন ও আগুন লাগান। অভিযোগপত্র দাখিলকারী নুরুল আমিন নির্দিষ্টভাবে আর কোনো বক্তব্য কিংবা তথ্য দাখিল করেননি। তিনি কিন্তু একা এ অভিযোগের দায়িত্ব নেননি। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং পিপির মতামত নিয়ে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নাম অভিযোগপত্রে নেই। তবে ৯ মে ২০১২, ১০২৪ নম্বর স্মারকসূত্র ধরে খুঁজলেই তা পাওয়া যাবে।
এটি যদি মিথ্যা মামলাই হবে, তাহলে কি আমরা দেখব, এজাহার ও অভিযোগপত্র প্রস্তুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দুই থেকে অনধিক পাঁচ বছর লাল দালানের ভাত খাচ্ছেন?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com