শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

খালেদার বাড়ি ছাড়া নিয়ে আইনগত নানা প্রশ্ন

বেগম খালেদা জিয়া বেগম খালেদা জিয়া
বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ভিড় করে আছে। বিশেষ করে এর আইনগত দিক নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে।
অনেকের প্রশ্ন, ২৯ নভেম্বরে কী হবে? আসলে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চাওয়া-সংক্রান্ত আবেদন অকার্যকর হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা নতুন করে আবেদন করতে পারেন। তাঁরা বলতে পারেন, বিচারাধীন থাকা অবস্থায় উচ্ছেদ করা হয়েছে। সুতরাং আগের মতো স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো অ্যান্টে) অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর যেমন ছিল, তেমনি অবস্থায় রাখার আদেশ দেওয়া হোক। আপিল আবেদনের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ির কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। আপিল বিভাগ অবশ্য এমন আবেদন নাকচও করতে পারেন।
অন্তত দুজন সাবেক প্রধান বিচারপতি মনে করেন, ১০ নভেম্বর বেগম জিয়ার আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ না চেয়ে বড় ভুল করেছিলেন। তবে সেই কারণে তাঁরা উচ্ছেদ-প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য বলেননি। তাঁরা মনে করেন, হাইকোর্টে সরকার যায়নি, গিয়েছিলেন ইজারাগ্রহীতা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষের মাধ্যমেই আদালত অবমাননার কারণ ঘটত না। আবার অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে স্থগিতাদেশ না থাকলেও আপিল হবে, এমন সম্ভাবনার কথা বলে সুবিধা নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।
তৃতীয় বিকল্প
খালেদা জিয়াকে ২০০০ সালে প্রথম নোটিশ দেওয়া হয়। তখন আইনি লড়াই দেখা যায়নি। ২০০৯-এর ২০ এপ্রিল দ্বিতীয়বার বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ১৬৫ কাঠার সামরিক ভূ-সম্পত্তি ইজারার চুক্তি গোড়া থেকেই বাতিল। আইনের চোখে এর কোনো মূল্য নেই। খালেদা জিয়া এই নোটিশের বিরুদ্ধে রিট করেন। গত ১৩ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ সরকারের দেওয়া নোটিশের বৈধতা সমুন্নত রাখেন। ৮ নভেম্বর খালেদার আইনজীবীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে চেম্বার জজের কাছে যান।
উল্লেখ্য, আপিলের অনুমতির জন্য চেম্বার জজের কাছে কেউ যান না। কারণ চেম্বার জজ তা শুনতে পারেন না। স্থগিতাদেশের আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে চেম্বার জজের সামনে সাধারণত তিনটি বিকল্প থাকে। প্রথমত, তিনি হাইকোর্টের তর্কিত আদেশ স্থগিত করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্থগিত কিংবা প্রত্যাখ্যান কোনোটি না করেও একটি আদেশ দিতে পারেন। আদালতপাড়ায় এর নাম ‘নো অর্ডার’। এটা আবেদনকারীর বিপক্ষে যায়। এর পরোক্ষ অর্থ আবেদন নাকচ হওয়া। তৃতীয় বিকল্প হলো, কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে প্রেরণ করা। ৮ নভেম্বর চেম্বার জজের কাছে ওই আবেদন করার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়। এর আগে একই দিন আপিল বিভাগে পৃথকভাবে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল পেশ করা হয়।
৯ নভেম্বর চেম্বার জজ মো. মোজাম্মেল হোসেন তৃতীয় বিকল্প বেছে নেন। তিনি বিষয়টি ১০ নভেম্বর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ধার্য করেন। ওই দিন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়।
কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় এসেছে যে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেন ওই দিন জোরালোভাবে স্থগিতাদেশ চাননি বা সে রকমের আদেশ পেতে পীড়াপীড়ি করেননি। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের অনেকের মতে, আবেদনকারীদের পক্ষে এটা একটি বিচ্যুতি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, স্থগিতাদেশ চাওয়া হলে আদালতের সামনে কী বিকল্প থাকত? তাঁদের মতে, প্রথমত এ ধরনের অবস্থায় হাইকোর্টের রায় সাধারণত আপিল বিভাগ স্থগিত করেন। এটাই সাধারণ রেওয়াজ। দ্বিতীয়ত, লিভ টু আপিলের শুনানি চলমান থাকলে ধরে নেওয়া হয় যে হাইকোর্টের রায় আপনাআপনি স্থগিত রয়েছে। লক্ষণীয় যে ১০ নভেম্বর সুনির্দিষ্টভাবে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়নি। আবার আপিল বিভাগও তাঁর আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে এ সংক্রান্ত আবেদন নাকচ করেননি। বরং লিভ টু আপিল ও স্থগিতাদেশ-সংক্রান্ত দুটি আবেদনের শুনানি ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি ওই দিন শুনানির শুরুতে জানতে চান, আপনারা কেন চেম্বার জজের কাছে গেলেন? জবাবে টি এইচ খান বলেন, হাইকোর্টের রায়ের একটি পর্যবেক্ষণ এর কারণ। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, আবেদনকারীকে ওই বাড়ি খালি করতে অন্তত ৩০ দিন সময় দিতে হবে। টি এইচ খান ইঙ্গিত দেন, এই ৩০ দিন অতিবাহিত হলে সরকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেন সেদিন স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চকিত হননি, সেটি রহস্যাবৃত। তবে কোনো ‘বিশেষ জরুরি অবস্থার’ উদ্ভব না ঘটলে এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে সরকার ২৯ নভেম্বরের আগে জবরদস্তি পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো অধিকার প্রয়োগ করে না।
উল্লেখ্য, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। বাড়ি খালি করতে অন্তত ৩০ দিন সময় দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মন্তব্যে। তিনি বলেন, ১২ তারিখের পর বাড়ি না ছাড়লে তা হবে আদালত অবমাননা। আইনজ্ঞদের অনেকেই এর সঙ্গে একমত হননি। তাঁরা মনে করেন, সরকার যদি ৩০ দিনের পরেও উচ্ছেদ অভিযানে যেত, তাহলেও আদালত অবমাননা ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হতো না। কারণ হাইকোর্টের রায়ে ৩০ দিনের বেশি সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। আপিল বিভাগও তাতে বাদ সাধেননি। অ্যাটর্নি জেনারেল পরে বলেন, আপিল বিভাগের রায় পক্ষে গেলে খালেদা জিয়া বাড়ি ফিরে পাবেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন তাড়াহুড়োর দরকার কি ছিল?
আবেদন বনাম প্রার্থনা: আপিল বিভাগের ১০ নভেম্বরের আদেশ আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। এর অবিকল তরজমা নিচে দেওয়া হলো: ‘আজ স্থগিতাদেশের জন্য একটি আবেদনসহ লিভ টু আপিলের শুনানি ধার্য আছে। আবেদনকারীর বিজ্ঞ কৌঁসুলি জনাব টি এইচ খান লিভ পিটিশনের শুনানি মুলতবি রাখতে প্রার্থনা করেছেন। এর উত্তরে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব মাহবুবে আলম নিবেদন করেন যে তিনি হাইকোর্টের রায় ও আদেশের কার্যকারিতার ওপর স্থগিতাদেশ চাওয়ার প্রার্থনার বিরোধিতা করছেন। এ সময় আদালত তাঁর নজরে আনেন যে আবেদনকারীর পক্ষে স্থগিতাদেশের কোনো প্রার্থনা করা হয়নি। যা হোক, এ বিষয়টি শুনানির জন্য ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হলো।’
এই আদেশ বিশ্লেষণে দেখা যায়, আদালত লিখিত আবেদন ও মৌখিক প্রার্থনার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। আপিল বিভাগের সামনে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করার লিখিত আবেদন ছিল। কিন্তু টি এইচ খান শুধু লিভ পিটিশনের আবেদন শুনানি মুলতবি করেছেন বলে আদালতের আদেশে দেখা যাচ্ছে। আদালতের প্রচলিত রীতি হলো, লিখিত আবেদনে যা-ই বলা থাকুক, যে বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব, শুনানিকালে সে মতে প্রতিকার চাইতে হবে। সেটা না চাওয়ার কারণে আদালতের হাতে স্থগিতাদেশের আবেদন থাকা সত্ত্বেও লেখা হয়েছে, আবেদনকারী স্থগিতাদেশ চাননি।
আবেদনে কী আছে: ৮ নভেম্বর চেম্বার জজের কাছে প্রথম হাইকোর্টের রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করা হয়। সেই আবেদনটিই অবিকল ১০ নভেম্বরে আপিল বিভাগের সামনে বিচারাধীন ছিল। এতে স্পষ্টতই আবেদনকারীকে অবিলম্বে ৬ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, বাড়ি ছাড়তে ২০০৯ সালের নোটিশের ওপর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৩ অক্টোবরে হাইকোর্ট তাঁর রায় ও আদেশে তা রদ করেন। আবেদনকারী আজ পর্যন্ত সেই বাড়িতে বসবাস করছেন। এখন হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণের সুযোগ নিয়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে বেপরোয়া পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। কারণ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘যা হোক, বিবাদীগণ এই তারিখ থেকে তর্কিত বাড়ি ছাড়তে অন্তত ৩০ দিন সময় দেবেন।’ যদিও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে আবেদনকারীর বিধিবদ্ধ অধিকার রয়েছে। আবেদনকারী এই বাড়িতে গত ২৯ বছর ধরে আছেন, তাই লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রাখা হোক। এখনই যদি হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করা হয়, তাহলে বেগম খালেদা জিয়া অপূরণীয় লোকসান ও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এবং আবেদনকারীর দায়ের করা সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল অর্থহীন হয়ে পড়বে। আর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা হলে বিবাদীদের কোনোভাবেই অধিকারহানি ঘটবে না। সুতরাং ১৩ অক্টোবর দেওয়া হাইকোর্টের রায় আপিলের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখতে সদয় আদেশ দিতে মর্জি হয়।
প্রধান বিচারপতির বাড়িতে: প্রধান বিচারপতির বাড়িতে গিয়ে প্রতিকার প্রার্থনার অধিকার খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ছিল। চার আইনজীবীর নাম উল্লেখ ছিল এমন একটি ‘সনদ’ জারি করা হয়। কিন্তু তাতে সুপ্রিম কোর্ট বারের পদ-পদবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘আইনজীবী সনদের’ বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন করে। বার সভাপতির প্যাডে সই করা ওই সনদে দাবি করা হয়, প্রধান বিচারপতি সুনির্দিষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত উচ্ছেদ ঘটবে না। এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির দপ্তর থেকে একটি ব্যাখ্যা খুবই প্রত্যাশিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন