ফেয়ারহ্যাম থেকে শ্রীমঙ্গল। দুই সাংসদের গল্প। ব্রিটেনের
ফেয়ারহ্যামের এমপি মার্ক হোবান। তিনি আবার ব্রিটিশ মন্ত্রী (অর্থ
মন্ত্রণালয়ের চার জুনিয়র মন্ত্রীর অন্যতম, যাঁর পদবি ফিন্যান্সিয়াল
সেক্রেটারি)। শ্রীমঙ্গলের এমপি আব্দুস শহীদ। তিনি আমাদের সরকারদলীয় চিফ
হুইপ। দুই এলাকার কতিপয় ভোটার প্রায় তিন মিলিয়ন পাউন্ডের একটি কথিত আত্মসাৎ ও প্রতারণার ঘটনার পক্ষবিপক্ষ। কোনো এমপির কাজ নয় কারও টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার। হোবান ও শহীদ কারও তা অজানা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুই সাংসদের মধ্যে আমরা একটি আকাশ পাতাল তফাত লক্ষ করতে পারি।
যুবকের নাম গোলাম রাশেদ চৌধুরী ওরফে হিমন (২৬)। তাঁর স্ত্রী ফরিদা। গত বছরের মাঝামাঝি লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনেন ওই দম্পতির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে লন্ডনের আদালতে মামলা হয়েছে। আগামী মাসে জুরিরা বসবেন এর বিচারে। ওই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা জামিনে আছেন।
নাজমুর রহমান ওরফে শানা ও মুহাম্মদ আলী সৈয়দ ওরফে দুলন। তাঁদের দাবি হিমনকে তাঁরা দেড় কোটি টাকা দেন সিলেটে চা-বাগান কেনা হবে বলে। হিমনের বাবা ইকবাল চৌধুরী একটি চা-বাগানে চাকরি করতেন। গতকাল লন্ডন থেকে দুলন ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা আব্দুস শহীদের হস্তক্ষেপ চেয়েছি ১৪ মাস আগেই। কারণ হিমন লন্ডনে থাকলেও আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, তাঁর বাবার কাছে প্রায় এক মিলিয়ন পাউন্ড গচ্ছিত আছে।’
হ্যাম্পশায়ারের পুলিশ বাহিনীর চিফ কনস্টেবল অ্যালেক্স মার্শাল শানাকে চিঠি লিখেছেন ৯ আগস্ট ২০১০। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, কীভাবে আপনি টাকা পরিশোধ করলেন? বাংলাদেশি নোটে না ব্রিটিশ পাউন্ডে? ১৬ আগস্ট ২০১০ শানার উত্তর: ‘সিলেটে একটি চা-বাগান কেনার জন্য আমি এবং আমার বন্ধু সৈয়দ ৯০ হাজার ৬০০ পাউন্ড প্রদান করেছি, বাংলাদেশি টাকায় যা ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এই দম্পতি আমাকে বলেছেন, সিলেটে চা-বাগান কেনার পরে একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হবে এবং অর্থের পরিমাণের অনুপাতে আমাদেরকে ওই কোম্পানির শেয়ার দেওয়া হবে।’
গত সোমবার শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শেখ লুৎফর রহমান ফোনে জানালেন, সালিস বৈঠক ডাকা হয়েছিল, কিন্তু সুরাহা হয়নি। কারণ হিমনের বাবা ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, এটা লন্ডনের বিষয়। তাঁর কোনো হাত নেই। এটা গত ৫ মার্চ ২০১০-এর কথা।
গতকাল অপরাহ্নে আমি হিমনের বাবার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে ফোনে আলাপ করি। তিনি সমিতিকে যা বলছিলেন, আমাকেও তা-ই বললেন। তাঁর দাবি, ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। হঠাৎ কখনো ফোন করে। তবে কথা শেষ না হতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথম আলোর শ্রীমঙ্গল সংবাদদাতা বিশ্বজ্যোতি চৌধুরীকে তাঁর শুশ্রূষা করতে হয়।
হাউজিং এস্টেট মৌলভীবাজারে ইকবাল চৌধুরীর টিনশেড বাড়ি। ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রথম আলোর সংবাদদাতাকে গতকাল বলেন, শ্বশুরবাড়িতে যে জমি পেয়েছিলেন, সম্প্রতি তা বিক্রি করেছেন। একটা গাড়ি ছিল, তা-ও বেচতে হয়েছে। এই অবস্থা অবশ্য মানতে নারাজ দুলন। তাঁর দাবি, ‘এসব লোক দেখানো।’ প্রমাণ থাকলে বাংলাদেশেও তো মামলা করতে পারেন, আমার এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর: সে জন্যই আমরা সাংসদ আব্দুস শহীদের সম্মতি ও সহযোগিতা চাইছি। এটা দরকারি। তাঁর ইঙ্গিত ভিন্ন। তবে তাঁদের অভিযোগ সত্য কি না, সেটা বিচার করতে আমরা বসিনি। মার্ক হোবান যে এলাকার সাংসদ, সেখানে অভিযুক্ত হিমন দম্পতিরও বাস।
জনপ্রতিনিধির সংবেদনশীলতা কেমন হতে পারে, তার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মার্ক হোবান। তাঁর কাছে মামুলি নালিশ করেছিলেন ভুক্তভোগী হিসেবে পরিচিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। চা-বাগান কেনা শুধু দুজনের বিষয়। আরও শতাধিক লোকের টাকা মারার অভিযোগ হিমনের বিরুদ্ধে। হোবান আমাদের চিফ হুইপের কাছ থেকে একটি পত্র পেতে প্রথম হাইকমিশনকে চিঠি লেখেন গত বছরের নভেম্বরে। এরপর গত ৮ জুন হাউস অব কমন্সের প্যাডে মার্ক হোবান শানাকে লিখেছেন, ‘নভেম্বর ২০১০ সালে দেওয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আবারও লিখছি যে, আমি আপনার উদ্বেগের বিষয়টি হ্যাম্পশায়ারের পুলিশ বাহিনীকে জানিয়েছি। আপনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান খানকে চিঠি লিখেছি। আপনার বন্ধু দুলন ৭ জুলাই ২০১০ সালে দেওয়া চিঠির কপি দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলের সাংসদ আব্দুস শহীদকে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আব্দুস শহীদ আপনার দরখাস্ত পেয়েছেন কি না। এবং আপনাদের টাকা উদ্ধারে তিনি কী করেছেন।’
মার্ক হোবানের এই চিঠি যদি সত্যিই তাঁর লেখা হয়, তাহলে একটি তদন্ত অবশ্যই হতে হবে। কারণ, ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ভুল করেও যদি একটি বিষয়ের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেন, তাহলে সে বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এই নীরবতা অমার্জনীয়। মার্ক হোবানের আকুতি: ‘বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে অব্যাহতভাবে যোগাযোগ করা সত্ত্বেও আমার অফিস বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে কোনো সাড়া পেতে ব্যর্থ হয়েছে। নভেম্বরের পর আমি ডিসেম্বরেও চিঠি লিখি। কিন্তু তা গোল্লায় গেছে। আমার স্টাফরা গত জানুয়ারি ও এপ্রিলে আমার মূল চিঠির উত্তর পেতে বহুবার ফোন করেও সাড়া পাননি। গত এপ্রিলে আমার কেস ওয়ার্কার পিটার কারস বাংলাদেশ হাইকমিশনের কল্যাণ দপ্তরের মাহফুজ হাসানের সঙ্গে কথা বলেন। মাহফুজ আশ্বস্ত করেন, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেওয়া আমার চিঠির জবাব কেন মেলেনি, তা খতিয়ে দেখা হবে। এরপর ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। আমি এই সপ্তাহে আবারও হাইকমিশনারকে চিঠি লিখেছি আমার মূল চিঠির জবাব পাইনি বলে। আমি তাঁকে ৮ জুলাইয়ের মধ্যে লিখিত উত্তর জানাতে অনুরোধ জানিয়েছি। আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমার এই চেষ্টা আমি চালিয়ে যাব।’
ব্রিটিশ মন্ত্রীর লেখা আরও একটি চিঠি আমাদের কাছে আছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি লিখেছেন, ‘আব্দুস শহীদ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তা জানতে আমি আবারও চিঠি লিখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত হাইকমিশনার জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, আপনি এবং অন্য ক্ষতিগ্রস্তরা ইংল্যান্ড কিংবা বাংলাদেশের আদালতে প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন। তাঁর মতে এটাই হলো ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ প্রশমনের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। উপরন্তু আমি বুঝতে পারি, বাংলাদেশের হাইকমিশনার এখন পর্যন্ত আপনাদের উদ্বেগের বিষয়ে আব্দুস শহীদ এমপির সহযোগিতা পেতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’
সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে, মার্ক হোবান এ রকমের একটি অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে সশরীরে এসেছেন এবং তা আমাদের হাইকমিশনারের বেঁধে দেওয়া সময়ে। এই বৈঠক ২০ অক্টোবর দুপুর ১২টায় হাইকমিশনে অনুষ্ঠিত হয়। হাইকমিশনার তখন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, আমি পোস্টবক্স মাত্র।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আব্দুস শহীদের সঙ্গে বিটিআরআই রেস্ট হাউসে সাক্ষাৎ করেছিলেন দুলন। তখন মৌলভীবাজারের ডিসিসহ স্থানীয় কর্মকর্তা ও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান খান মার্ক হোবানকে লিখেছেন, ‘আপনার চিঠি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে চিফ হুইপকে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম তাঁর তরফে জবাব আসবে। কিন্তু আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি।’
গতকাল এ বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে হাউস অব কমন্সের সঙ্গে চিফ হুইপের ঘনিষ্ঠতার বিবরণ পেলাম। গত বছর ঢাকায় এসেছিলেন ওয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মিস মেরিনা। তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ খোয়া যায়। বাংলাদেশের পুলিশকে দিয়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ১২০০ পাউন্ড উদ্ধার করিয়েছিলেন। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন আব্দুস শহীদও বিরোধী দলে। লন্ডনে তাঁরা একটি সভায় যৌথভাবে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর উত্তরে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, চিফ হুইপের দপ্তর করিৎকর্মা। সব মিলিয়ে এটা সন্দেহাতীত যে, হাউস অব কমন্সের একজন সদস্য বাংলাদেশ সংসদের একজন সদস্যের মধ্যে যোগাযোগ করতে চাইছেন। আর তিনি তা পারছেন না—এটা বাংলাদেশের জন্য কতটা অমর্যাদাকর ও পীড়াদায়ক, সে কথা আর যাকেই হোক আব্দুস শহীদকে বুঝিয়ে বলার কোনো দরকার নেই।
কিন্তু মুশকিল হলো, তিনি নিশ্চিত করেন, মার্ক হোবানের কাছ থেকে কোনো পত্র পাননি। জানতে চাইলাম, বাংলাদেশ হাইকমিশন কি তাহলে আমাদের ডোবাল? আপনাকেও ডোবাল? ফোন রাখার আগে তিনি বললেন, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
আমাদের চিফ হুইপের অফিস যে দক্ষ, তার প্রমাণ গতকাল সন্ধ্যার আগেই পেয়েছি। আব্দুস শহীদের ফোনালাপ শেষের ঘণ্টা না পেরোতেই তাঁর একান্ত সচিবের ফোন পাই। তিনি ২০১০ সালের জুলাইয়ের চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেন। বলেন, শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী সমিতির সালিস বৈঠক ছিল তাঁরই উদ্যোগের ফসল। তাহলে প্রশ্ন, তাঁর এই মহতী প্রয়াস কেন এত দিনে মার্ক হোবানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো হলো না? একান্ত সচিব আরও একটি তথ্য দিলেন। আমরা বিস্ময়ে তাজ্জব বনে গেলাম। লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে এই একটু আগেই (গতকালের অপরাহ্ন) ফ্যাক্স বার্তা এসেছে। অল্প সময়ের মধ্যে তার একটি কপি ফ্যাক্সে প্রথম আলোতেও পৌঁছাল। ব্রিটিশ মন্ত্রীর প্রথম চিঠি লেখার ১১ মাস এবং তার বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘুরে যাওয়ার চার দিন পরে হাইকমিশনার চিফ হুইপের কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছেন। তাতে লেখা, ‘বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি ব্রিটিশ মন্ত্রীর রয়েছে বিশাল শুভেচ্ছা। তিনি “একজন সাংসদ হয়ে আপনার কাছে এ বিষয়ে সহমর্মিতা” আশা করছেন। দয়া করে তাঁর অনুরোধের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে আমি আপনার প্রতি আহ্বান জানাই।’ এরপর আমরা আর মন্তব্য করতে চাই না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
যুবকের নাম গোলাম রাশেদ চৌধুরী ওরফে হিমন (২৬)। তাঁর স্ত্রী ফরিদা। গত বছরের মাঝামাঝি লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনেন ওই দম্পতির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে লন্ডনের আদালতে মামলা হয়েছে। আগামী মাসে জুরিরা বসবেন এর বিচারে। ওই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা জামিনে আছেন।
নাজমুর রহমান ওরফে শানা ও মুহাম্মদ আলী সৈয়দ ওরফে দুলন। তাঁদের দাবি হিমনকে তাঁরা দেড় কোটি টাকা দেন সিলেটে চা-বাগান কেনা হবে বলে। হিমনের বাবা ইকবাল চৌধুরী একটি চা-বাগানে চাকরি করতেন। গতকাল লন্ডন থেকে দুলন ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা আব্দুস শহীদের হস্তক্ষেপ চেয়েছি ১৪ মাস আগেই। কারণ হিমন লন্ডনে থাকলেও আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, তাঁর বাবার কাছে প্রায় এক মিলিয়ন পাউন্ড গচ্ছিত আছে।’
হ্যাম্পশায়ারের পুলিশ বাহিনীর চিফ কনস্টেবল অ্যালেক্স মার্শাল শানাকে চিঠি লিখেছেন ৯ আগস্ট ২০১০। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, কীভাবে আপনি টাকা পরিশোধ করলেন? বাংলাদেশি নোটে না ব্রিটিশ পাউন্ডে? ১৬ আগস্ট ২০১০ শানার উত্তর: ‘সিলেটে একটি চা-বাগান কেনার জন্য আমি এবং আমার বন্ধু সৈয়দ ৯০ হাজার ৬০০ পাউন্ড প্রদান করেছি, বাংলাদেশি টাকায় যা ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এই দম্পতি আমাকে বলেছেন, সিলেটে চা-বাগান কেনার পরে একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হবে এবং অর্থের পরিমাণের অনুপাতে আমাদেরকে ওই কোম্পানির শেয়ার দেওয়া হবে।’
গত সোমবার শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শেখ লুৎফর রহমান ফোনে জানালেন, সালিস বৈঠক ডাকা হয়েছিল, কিন্তু সুরাহা হয়নি। কারণ হিমনের বাবা ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, এটা লন্ডনের বিষয়। তাঁর কোনো হাত নেই। এটা গত ৫ মার্চ ২০১০-এর কথা।
গতকাল অপরাহ্নে আমি হিমনের বাবার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে ফোনে আলাপ করি। তিনি সমিতিকে যা বলছিলেন, আমাকেও তা-ই বললেন। তাঁর দাবি, ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। হঠাৎ কখনো ফোন করে। তবে কথা শেষ না হতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথম আলোর শ্রীমঙ্গল সংবাদদাতা বিশ্বজ্যোতি চৌধুরীকে তাঁর শুশ্রূষা করতে হয়।
হাউজিং এস্টেট মৌলভীবাজারে ইকবাল চৌধুরীর টিনশেড বাড়ি। ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রথম আলোর সংবাদদাতাকে গতকাল বলেন, শ্বশুরবাড়িতে যে জমি পেয়েছিলেন, সম্প্রতি তা বিক্রি করেছেন। একটা গাড়ি ছিল, তা-ও বেচতে হয়েছে। এই অবস্থা অবশ্য মানতে নারাজ দুলন। তাঁর দাবি, ‘এসব লোক দেখানো।’ প্রমাণ থাকলে বাংলাদেশেও তো মামলা করতে পারেন, আমার এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর: সে জন্যই আমরা সাংসদ আব্দুস শহীদের সম্মতি ও সহযোগিতা চাইছি। এটা দরকারি। তাঁর ইঙ্গিত ভিন্ন। তবে তাঁদের অভিযোগ সত্য কি না, সেটা বিচার করতে আমরা বসিনি। মার্ক হোবান যে এলাকার সাংসদ, সেখানে অভিযুক্ত হিমন দম্পতিরও বাস।
জনপ্রতিনিধির সংবেদনশীলতা কেমন হতে পারে, তার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মার্ক হোবান। তাঁর কাছে মামুলি নালিশ করেছিলেন ভুক্তভোগী হিসেবে পরিচিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। চা-বাগান কেনা শুধু দুজনের বিষয়। আরও শতাধিক লোকের টাকা মারার অভিযোগ হিমনের বিরুদ্ধে। হোবান আমাদের চিফ হুইপের কাছ থেকে একটি পত্র পেতে প্রথম হাইকমিশনকে চিঠি লেখেন গত বছরের নভেম্বরে। এরপর গত ৮ জুন হাউস অব কমন্সের প্যাডে মার্ক হোবান শানাকে লিখেছেন, ‘নভেম্বর ২০১০ সালে দেওয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আবারও লিখছি যে, আমি আপনার উদ্বেগের বিষয়টি হ্যাম্পশায়ারের পুলিশ বাহিনীকে জানিয়েছি। আপনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান খানকে চিঠি লিখেছি। আপনার বন্ধু দুলন ৭ জুলাই ২০১০ সালে দেওয়া চিঠির কপি দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলের সাংসদ আব্দুস শহীদকে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আব্দুস শহীদ আপনার দরখাস্ত পেয়েছেন কি না। এবং আপনাদের টাকা উদ্ধারে তিনি কী করেছেন।’
মার্ক হোবানের এই চিঠি যদি সত্যিই তাঁর লেখা হয়, তাহলে একটি তদন্ত অবশ্যই হতে হবে। কারণ, ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ভুল করেও যদি একটি বিষয়ের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেন, তাহলে সে বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এই নীরবতা অমার্জনীয়। মার্ক হোবানের আকুতি: ‘বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে অব্যাহতভাবে যোগাযোগ করা সত্ত্বেও আমার অফিস বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে কোনো সাড়া পেতে ব্যর্থ হয়েছে। নভেম্বরের পর আমি ডিসেম্বরেও চিঠি লিখি। কিন্তু তা গোল্লায় গেছে। আমার স্টাফরা গত জানুয়ারি ও এপ্রিলে আমার মূল চিঠির উত্তর পেতে বহুবার ফোন করেও সাড়া পাননি। গত এপ্রিলে আমার কেস ওয়ার্কার পিটার কারস বাংলাদেশ হাইকমিশনের কল্যাণ দপ্তরের মাহফুজ হাসানের সঙ্গে কথা বলেন। মাহফুজ আশ্বস্ত করেন, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেওয়া আমার চিঠির জবাব কেন মেলেনি, তা খতিয়ে দেখা হবে। এরপর ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। আমি এই সপ্তাহে আবারও হাইকমিশনারকে চিঠি লিখেছি আমার মূল চিঠির জবাব পাইনি বলে। আমি তাঁকে ৮ জুলাইয়ের মধ্যে লিখিত উত্তর জানাতে অনুরোধ জানিয়েছি। আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমার এই চেষ্টা আমি চালিয়ে যাব।’
ব্রিটিশ মন্ত্রীর লেখা আরও একটি চিঠি আমাদের কাছে আছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি লিখেছেন, ‘আব্দুস শহীদ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তা জানতে আমি আবারও চিঠি লিখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত হাইকমিশনার জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, আপনি এবং অন্য ক্ষতিগ্রস্তরা ইংল্যান্ড কিংবা বাংলাদেশের আদালতে প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন। তাঁর মতে এটাই হলো ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ প্রশমনের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। উপরন্তু আমি বুঝতে পারি, বাংলাদেশের হাইকমিশনার এখন পর্যন্ত আপনাদের উদ্বেগের বিষয়ে আব্দুস শহীদ এমপির সহযোগিতা পেতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’
সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে, মার্ক হোবান এ রকমের একটি অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে সশরীরে এসেছেন এবং তা আমাদের হাইকমিশনারের বেঁধে দেওয়া সময়ে। এই বৈঠক ২০ অক্টোবর দুপুর ১২টায় হাইকমিশনে অনুষ্ঠিত হয়। হাইকমিশনার তখন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, আমি পোস্টবক্স মাত্র।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আব্দুস শহীদের সঙ্গে বিটিআরআই রেস্ট হাউসে সাক্ষাৎ করেছিলেন দুলন। তখন মৌলভীবাজারের ডিসিসহ স্থানীয় কর্মকর্তা ও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান খান মার্ক হোবানকে লিখেছেন, ‘আপনার চিঠি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে চিফ হুইপকে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম তাঁর তরফে জবাব আসবে। কিন্তু আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি।’
গতকাল এ বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে হাউস অব কমন্সের সঙ্গে চিফ হুইপের ঘনিষ্ঠতার বিবরণ পেলাম। গত বছর ঢাকায় এসেছিলেন ওয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মিস মেরিনা। তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ খোয়া যায়। বাংলাদেশের পুলিশকে দিয়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ১২০০ পাউন্ড উদ্ধার করিয়েছিলেন। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন আব্দুস শহীদও বিরোধী দলে। লন্ডনে তাঁরা একটি সভায় যৌথভাবে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর উত্তরে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, চিফ হুইপের দপ্তর করিৎকর্মা। সব মিলিয়ে এটা সন্দেহাতীত যে, হাউস অব কমন্সের একজন সদস্য বাংলাদেশ সংসদের একজন সদস্যের মধ্যে যোগাযোগ করতে চাইছেন। আর তিনি তা পারছেন না—এটা বাংলাদেশের জন্য কতটা অমর্যাদাকর ও পীড়াদায়ক, সে কথা আর যাকেই হোক আব্দুস শহীদকে বুঝিয়ে বলার কোনো দরকার নেই।
কিন্তু মুশকিল হলো, তিনি নিশ্চিত করেন, মার্ক হোবানের কাছ থেকে কোনো পত্র পাননি। জানতে চাইলাম, বাংলাদেশ হাইকমিশন কি তাহলে আমাদের ডোবাল? আপনাকেও ডোবাল? ফোন রাখার আগে তিনি বললেন, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
আমাদের চিফ হুইপের অফিস যে দক্ষ, তার প্রমাণ গতকাল সন্ধ্যার আগেই পেয়েছি। আব্দুস শহীদের ফোনালাপ শেষের ঘণ্টা না পেরোতেই তাঁর একান্ত সচিবের ফোন পাই। তিনি ২০১০ সালের জুলাইয়ের চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেন। বলেন, শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী সমিতির সালিস বৈঠক ছিল তাঁরই উদ্যোগের ফসল। তাহলে প্রশ্ন, তাঁর এই মহতী প্রয়াস কেন এত দিনে মার্ক হোবানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো হলো না? একান্ত সচিব আরও একটি তথ্য দিলেন। আমরা বিস্ময়ে তাজ্জব বনে গেলাম। লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে এই একটু আগেই (গতকালের অপরাহ্ন) ফ্যাক্স বার্তা এসেছে। অল্প সময়ের মধ্যে তার একটি কপি ফ্যাক্সে প্রথম আলোতেও পৌঁছাল। ব্রিটিশ মন্ত্রীর প্রথম চিঠি লেখার ১১ মাস এবং তার বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘুরে যাওয়ার চার দিন পরে হাইকমিশনার চিফ হুইপের কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছেন। তাতে লেখা, ‘বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি ব্রিটিশ মন্ত্রীর রয়েছে বিশাল শুভেচ্ছা। তিনি “একজন সাংসদ হয়ে আপনার কাছে এ বিষয়ে সহমর্মিতা” আশা করছেন। দয়া করে তাঁর অনুরোধের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে আমি আপনার প্রতি আহ্বান জানাই।’ এরপর আমরা আর মন্তব্য করতে চাই না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন