চীন ও ভারতের মধ্যে একটি ‘পানিযুদ্ধ’ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তা নির্ধারণে এখনই সচেতন মহলের
চিন্তাভাবনা করা উচিত। বাংলাদেশ পানি নিয়ে এখন ভারতের সঙ্গে যে যুক্তিতে
কথা বলছে, সেই তেতো যুক্তিগুলোই তারা চীনের সঙ্গে ভবিষ্যতে মধুর করে তুলবে।
আর তখন তা চীনের কাছে তেতো লাগবে।
ড. মনমোহন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের (চীনা নাম সাংপো) ওপর বাঁধ নির্মাণে চিনের কাছ থেকে ভরসা পেয়েছেন। অনেকটা সেভাবেই তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এখন লিখিতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে ভরসা দিয়েছেন। রাজ্যসভায় গত ৪ আগস্ট ড. মনমোহন বলেছিলেন, ‘আমাদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে এমন কিছুই করা হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
ভারত সরকার তাই সাংপোতে বাঁধ নির্মাণে বাধা দেয়নি, প্রতিবাদ করেনি। ভারতও এখন বাংলাদেশের কাছে সেটাই আশা করছে। কিন্তু সেটা মনিপুর ও আসামের জনগণের মতো বাংলাদেশও মানতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীমালার নিম্নতম অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৃহৎ বাঁধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করাই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা, তিস্তার পরে টিপাইমুখকেও চীন ও ভারতের ধেয়ে আসা ‘পানিযুদ্ধের’ বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না।
বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের বহু পরিবেশবিদ বৃহৎ বাঁধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের সংগঠিত করার নেতৃত্ব ধরিত্রীর বিপন্নতম রাজধানী ঢাকাকেই দিতে হবে। টিপাইমুখ প্রশ্নে পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার অঙ্গীকার যেন লোকদেখানো বিষয়ে পরিণত না হয়। গত বছরের মার্চে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছিলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের একটি অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ চীন ও ভারতের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এ বিষয়ে ওই দুটি দেশের তরফে কিছু না জানলেও তিনি জানিয়েছিলেন, দুই দেশ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশকে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্মাণাধীন বাঁধ সম্পর্কেও চীনের কাছে তথ্য চাইতে হবে। ভারতীয় জনগণকে দেওয়া মনমোহন সিংয়ের ‘ভরসায়’ বাংলাদেশের চলবে না। চীনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এতটাই বিপুল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার তুলনা মানব ইতিহাসে নেই। গত ৪ মার্চ ২০১১ ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় পরিবেশ ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের নীতিনির্ধারণী পরিচালক পিটার বোশার্ড লেখেন, ‘যদি ওই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়, তাহলে অবধারিতভাবে চীনের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী এবং বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।’
চীনা বাঁধব্যাধি প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ লোককে স্থানচ্যুত করেছে। বাঁধ ভেঙে নিহত চীনা নাগরিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ছুঁয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে চীন এক লাখ ৪০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ভারত তার ১৬ রাজ্যে ১৬২ প্রকল্প করে ২০১৭ সালের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
ভারতের পানিসম্পদ ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞ ব্রমা চেলানী আন্তর্জাতিক নদীতে চীনের বাঁধ নির্মাণ এবং পানি প্রত্যাহারে কী সর্বনাশ ঘটাতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে তিনি শুধু ভারতের জাতীয় স্বার্থেই আলো ফেলছেন। উজানের চীনের বিরুদ্ধে ভাটির ভারতের যুক্তি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানেরও মনের কথা। আবার মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওসেরও মনের কথা। ভাটি অঞ্চলের দেশগুলো একই সুরে তাল মেলাতে পারে। তবে চীন পানি প্রত্যাহার শুরু না করলে ভারতকে হয়তো ভাটির দেশের উদ্বেগ নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যেত না।
এখনো মনে হচ্ছে, ভারত গঙ্গা ও তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যা করে চলেছে, তেমন ধরনের ত্রাহি মধুসূধন অবস্থায় চীন তাকে না ফেলা পর্যন্ত ভারতের হুঁশ হবে না।
এটা সন্দেহাতীত যে, চীন ও ভারতের মধ্য দিয়ে বহমান আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানিসম্পদ প্রশ্নে বাংলাদেশকে সব সময় তীক্ষ নজর রাখতে হবে। চীন ও ভারতে এমন অনেক মানবতাবাদী কণ্ঠস্বর রয়েছে, যাঁরা মানুষের দুঃখ-কষ্টকে শুধুই সীমান্তরেখা দিয়ে বিচার করেন না। তাঁরা পানি অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে চান। গত ১৯ আগস্ট ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় প্রাচী ভূচর চীন-ভারত-বাংলাদেশ জরুরি ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক পানি চুক্তি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। তাঁর প্রশ্ন, চীন কি তাতে সাড়া দেবে? আরও ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের প্রশ্ন আরেকটু জটিল: এমন প্রস্তাবে চীন ও ভারত কি বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেবে?
ড. মনমোহনের ওই আশ্বাসে ভারতীয় পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সন্তুষ্ট নন। তাঁরা দরজা বন্ধ করে ঘুম দেননি। ব্রমা চেলানির মন্তব্য, ‘চীন সর্বদাই তার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে নির্বাক। প্রতিবেশী দেশগুলোকে তথ্য প্রদান, প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে দিতে তারা অনিচ্ছুক। এমনকি বৃহৎ বাঁধের কাজও নিঃশব্দে শুরু করার অভ্যাস তাদের আছে।’ ভারেত কি কখনো আমাদের বলবে, ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারাজের উজানে ঠিক কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে? নদ-নদী ও পানিসংক্রান্ত তথ্য না দেওয়ার ভারতীয় রেকর্ড বরাবরই পানসে।
ভবিষ্যতের পানিযুদ্ধে চীন হবে প্রধান খেলুড়ে। বিধাতা চীনকে দুহাত ভরে উজাড় করে দিয়েছেন। অন্তত ১০টি আন্তর্জাতিক নদীর উৎস শুধু চীনা ভূখণ্ডে। ভারতের পক্ষে চীন প্রভাবিত এই অঞ্চলের পানিরাজনীতি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। একলা চলার দিন তার শেষ। ১৯৬০ সালে ইন্দাজ ট্রিটি সই করে পাকিস্তানের সঙ্গে পানিসংঘাত ভারত এড়িয়েছে।
গত মে মাসে দিল্লিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনারকে বললাম, ইন্দাজ মডেলে একটি চুক্তি বাংলাদেশেরও প্রাপ্য। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বললেন, ওটা করা ভারতের ভুল হয়েছিল। তাঁর কথায় অবাক হয়েছিলাম। তাঁর এই উপলব্ধি যে ভুল, সেটা ইন্ডিয়া টুডের গত আগস্টের সুপারিশে স্পষ্ট। পত্রিকাটি ব্রহ্মপুত্র প্রশ্নে ইন্দাজ মডেলে চীন ও তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে চুক্তি চাইছে। আমরা বলব, উহুঁ, শুধু ব্রহ্মপুত্র কেন, চীন ও ভারতের মধ্যে বয়ে চলা গঙ্গাসহ সব নদী নিয়ে ইন্দাজ মডেলে চুক্তি চাই। তবে প্রশ্ন হলো, সেটা কি চীন ভারতকে ভীষণ বেকায়দায় না ফেলা পর্যন্ত চিন্তা করতেও রাজি হবে?
২০৩০ সালের মধ্যে চীন ২৫ শতাংশ পানির ঘাটতিতে পড়বে। মুম্বাইভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপের সভাপতি সন্দীপ ওয়াজলেকার বলেছেন, ‘চীনে ছয় হাজারের বেশি হ্রদ শুকিয়ে গেছে। উত্তর চীনে হলুদ নদীর অববাহিকা ৩০ শতাংশ মরে গেছে এবং মরুকরণও শুরু হয়ে গেছে। সে কারণেই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নদীর পানি প্রত্যাহার ছাড়া চীনের সামনে বিকল্প খুব কমই থাকবে।’
চীনের ব্যাপকভিত্তিক পানি প্রত্যাহারের অর্থই হবে ভারতীয় পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনাকে আরও উসকে দেওয়া। দূরদর্শী ভারত সে কারণেই গঙ্গাচুক্তিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি ভাগ করেছে। তিন ‘যদি’র চুক্তি করেছে। এর মানে, ফারাক্কায় যদি ১০ বালতি পানি এসে জমা হয়, তাহলে বাংলাদেশ তিন বালতি পাবে। একই অবস্থা হবে অন্যান্য নদ-নদীর। তিস্তাচুক্তি শুধু মমতার খেয়ালীপনায় হচ্ছে না—এই ধারণার অনুসারীরা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন।
চীন ব্যাপকভিত্তিক পানি প্রত্যাহার করলে নদীতে পানি কমে যাবে। আর তখন উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বয়ে আসা প্রধান নদ-নদী তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারাবে। তখন সামান্য বৃষ্টি হলেই বিরাট বন্যার রূপ নেবে। ব্রহ্মপুত্র, বরাক কিংবা তিস্তা কোনো কিছুকেই ভালোভাবে চেনা যাবে না।
শুধু পানি প্রত্যাহারই নয়, এখন চীনের নদীর গতিপথ পাল্টানোর পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব ছাড়াও হিমবাহ গলার প্রলয়ঙ্করী পূর্বাভাস তো আছেই।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞ সন্দীপ ওয়াজলেকার যেভাবে ড. মনমোহনের আশ্বাসকেই চূড়ান্ত ধরেননি; একইভাবে মনমোহনের আশ্বাসকেও বাংলাদেশ চূড়ান্ত ধরে নিতে পারে না। এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়।
ওয়াজলেকারের মন্তব্য, ‘আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করতে পারে। এই সময়ের মধ্যে ভারতকে তার ঘর ঘোছাতে হবে।’ টিপাইমুখ নিয়ে কোনো বাঙালির একই ধারণার বশবর্তী হওয়া কি ভুল হবে? ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ব্রহ্মপুত্রের বিষয়ে চীনা নিশ্চয়তাকে ভারতের যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশও একই সুরে বলতে পারে, টিপাইমুখের বিষয়ে ভারতীয় নিশ্চয়তাকে বাংলাদেশের যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত হবে না।
বাংলাদেশের উচিত হবে একটি সর্বাত্মক পরিবেশ কূটনীতিতে শামিল হওয়া। বিশ্বকে বোঝাতে হবে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত হুমকি ছাড়াও বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ চীন ও ভারতের মতো দুই বৃহৎ শক্তির ধেয়ে আসা ‘পানিযুদ্ধে’ কিংবা তেমন হুমকিজনিত পরিস্থিতির অসহায় শিকার হতে চলেছে।
ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে, ‘ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা চলছে এবং সেটা বিশ্বের দুই বৃহত্তম সেনাবাহিনীর জ্বলনাঙ্ক (ফ্লাশ পয়েন্ট) হতে পারে। ২০০০ সালে ভারত চীনকে অভিযুক্ত করেছে যে, নদী বিষয়ে তারা তথ্য দেয়নি। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে চীনের প্রস্তাব দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করেছে। হিমালয়ে হিমবাহ গলার কারণে গঙ্গায় সৃষ্ট বন্যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অভিবাসন বেড়ে গেছে। ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তা রুখতে চাইছে।’
আমরা মনে করি, সরকারি পর্যায়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশ যদি একমত হয়, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা হওয়ার নয়। পানিসম্পদকে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে বিবেচনায় নিয়ে চীন ও ভারতের খেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর অববাহিকাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাইলে তিন দেশকেই এক টেবিলে বসতে হবে। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে ট্রাক টু (বেসরকারি) ডিপ্লোমেসি রয়েছে। দরকার ত্রিদেশীয় কূটনীতি। ড. আইনুন নিশাতের দেওয়া ত্রিদেশীয় নদী কমিশন গঠনের প্রস্তাবকে আমরা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মনে করি। বেগম খালেদা জিয়া মনমোহনকে শুধু নয়, চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এ বিষয়ে চিঠি লিখতে পারেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ২৮-১১-২০১১ড. মনমোহন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের (চীনা নাম সাংপো) ওপর বাঁধ নির্মাণে চিনের কাছ থেকে ভরসা পেয়েছেন। অনেকটা সেভাবেই তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এখন লিখিতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে ভরসা দিয়েছেন। রাজ্যসভায় গত ৪ আগস্ট ড. মনমোহন বলেছিলেন, ‘আমাদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে এমন কিছুই করা হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
ভারত সরকার তাই সাংপোতে বাঁধ নির্মাণে বাধা দেয়নি, প্রতিবাদ করেনি। ভারতও এখন বাংলাদেশের কাছে সেটাই আশা করছে। কিন্তু সেটা মনিপুর ও আসামের জনগণের মতো বাংলাদেশও মানতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীমালার নিম্নতম অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৃহৎ বাঁধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করাই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা, তিস্তার পরে টিপাইমুখকেও চীন ও ভারতের ধেয়ে আসা ‘পানিযুদ্ধের’ বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না।
বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের বহু পরিবেশবিদ বৃহৎ বাঁধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের সংগঠিত করার নেতৃত্ব ধরিত্রীর বিপন্নতম রাজধানী ঢাকাকেই দিতে হবে। টিপাইমুখ প্রশ্নে পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার অঙ্গীকার যেন লোকদেখানো বিষয়ে পরিণত না হয়। গত বছরের মার্চে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছিলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের একটি অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ চীন ও ভারতের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এ বিষয়ে ওই দুটি দেশের তরফে কিছু না জানলেও তিনি জানিয়েছিলেন, দুই দেশ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশকে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্মাণাধীন বাঁধ সম্পর্কেও চীনের কাছে তথ্য চাইতে হবে। ভারতীয় জনগণকে দেওয়া মনমোহন সিংয়ের ‘ভরসায়’ বাংলাদেশের চলবে না। চীনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এতটাই বিপুল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার তুলনা মানব ইতিহাসে নেই। গত ৪ মার্চ ২০১১ ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় পরিবেশ ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের নীতিনির্ধারণী পরিচালক পিটার বোশার্ড লেখেন, ‘যদি ওই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়, তাহলে অবধারিতভাবে চীনের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী এবং বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।’
চীনা বাঁধব্যাধি প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ লোককে স্থানচ্যুত করেছে। বাঁধ ভেঙে নিহত চীনা নাগরিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ছুঁয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে চীন এক লাখ ৪০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ভারত তার ১৬ রাজ্যে ১৬২ প্রকল্প করে ২০১৭ সালের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
ভারতের পানিসম্পদ ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞ ব্রমা চেলানী আন্তর্জাতিক নদীতে চীনের বাঁধ নির্মাণ এবং পানি প্রত্যাহারে কী সর্বনাশ ঘটাতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে তিনি শুধু ভারতের জাতীয় স্বার্থেই আলো ফেলছেন। উজানের চীনের বিরুদ্ধে ভাটির ভারতের যুক্তি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানেরও মনের কথা। আবার মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওসেরও মনের কথা। ভাটি অঞ্চলের দেশগুলো একই সুরে তাল মেলাতে পারে। তবে চীন পানি প্রত্যাহার শুরু না করলে ভারতকে হয়তো ভাটির দেশের উদ্বেগ নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যেত না।
এখনো মনে হচ্ছে, ভারত গঙ্গা ও তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যা করে চলেছে, তেমন ধরনের ত্রাহি মধুসূধন অবস্থায় চীন তাকে না ফেলা পর্যন্ত ভারতের হুঁশ হবে না।
এটা সন্দেহাতীত যে, চীন ও ভারতের মধ্য দিয়ে বহমান আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানিসম্পদ প্রশ্নে বাংলাদেশকে সব সময় তীক্ষ নজর রাখতে হবে। চীন ও ভারতে এমন অনেক মানবতাবাদী কণ্ঠস্বর রয়েছে, যাঁরা মানুষের দুঃখ-কষ্টকে শুধুই সীমান্তরেখা দিয়ে বিচার করেন না। তাঁরা পানি অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে চান। গত ১৯ আগস্ট ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় প্রাচী ভূচর চীন-ভারত-বাংলাদেশ জরুরি ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক পানি চুক্তি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। তাঁর প্রশ্ন, চীন কি তাতে সাড়া দেবে? আরও ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের প্রশ্ন আরেকটু জটিল: এমন প্রস্তাবে চীন ও ভারত কি বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেবে?
ড. মনমোহনের ওই আশ্বাসে ভারতীয় পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সন্তুষ্ট নন। তাঁরা দরজা বন্ধ করে ঘুম দেননি। ব্রমা চেলানির মন্তব্য, ‘চীন সর্বদাই তার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে নির্বাক। প্রতিবেশী দেশগুলোকে তথ্য প্রদান, প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে দিতে তারা অনিচ্ছুক। এমনকি বৃহৎ বাঁধের কাজও নিঃশব্দে শুরু করার অভ্যাস তাদের আছে।’ ভারেত কি কখনো আমাদের বলবে, ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারাজের উজানে ঠিক কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে? নদ-নদী ও পানিসংক্রান্ত তথ্য না দেওয়ার ভারতীয় রেকর্ড বরাবরই পানসে।
ভবিষ্যতের পানিযুদ্ধে চীন হবে প্রধান খেলুড়ে। বিধাতা চীনকে দুহাত ভরে উজাড় করে দিয়েছেন। অন্তত ১০টি আন্তর্জাতিক নদীর উৎস শুধু চীনা ভূখণ্ডে। ভারতের পক্ষে চীন প্রভাবিত এই অঞ্চলের পানিরাজনীতি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। একলা চলার দিন তার শেষ। ১৯৬০ সালে ইন্দাজ ট্রিটি সই করে পাকিস্তানের সঙ্গে পানিসংঘাত ভারত এড়িয়েছে।
গত মে মাসে দিল্লিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনারকে বললাম, ইন্দাজ মডেলে একটি চুক্তি বাংলাদেশেরও প্রাপ্য। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বললেন, ওটা করা ভারতের ভুল হয়েছিল। তাঁর কথায় অবাক হয়েছিলাম। তাঁর এই উপলব্ধি যে ভুল, সেটা ইন্ডিয়া টুডের গত আগস্টের সুপারিশে স্পষ্ট। পত্রিকাটি ব্রহ্মপুত্র প্রশ্নে ইন্দাজ মডেলে চীন ও তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে চুক্তি চাইছে। আমরা বলব, উহুঁ, শুধু ব্রহ্মপুত্র কেন, চীন ও ভারতের মধ্যে বয়ে চলা গঙ্গাসহ সব নদী নিয়ে ইন্দাজ মডেলে চুক্তি চাই। তবে প্রশ্ন হলো, সেটা কি চীন ভারতকে ভীষণ বেকায়দায় না ফেলা পর্যন্ত চিন্তা করতেও রাজি হবে?
২০৩০ সালের মধ্যে চীন ২৫ শতাংশ পানির ঘাটতিতে পড়বে। মুম্বাইভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপের সভাপতি সন্দীপ ওয়াজলেকার বলেছেন, ‘চীনে ছয় হাজারের বেশি হ্রদ শুকিয়ে গেছে। উত্তর চীনে হলুদ নদীর অববাহিকা ৩০ শতাংশ মরে গেছে এবং মরুকরণও শুরু হয়ে গেছে। সে কারণেই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নদীর পানি প্রত্যাহার ছাড়া চীনের সামনে বিকল্প খুব কমই থাকবে।’
চীনের ব্যাপকভিত্তিক পানি প্রত্যাহারের অর্থই হবে ভারতীয় পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনাকে আরও উসকে দেওয়া। দূরদর্শী ভারত সে কারণেই গঙ্গাচুক্তিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি ভাগ করেছে। তিন ‘যদি’র চুক্তি করেছে। এর মানে, ফারাক্কায় যদি ১০ বালতি পানি এসে জমা হয়, তাহলে বাংলাদেশ তিন বালতি পাবে। একই অবস্থা হবে অন্যান্য নদ-নদীর। তিস্তাচুক্তি শুধু মমতার খেয়ালীপনায় হচ্ছে না—এই ধারণার অনুসারীরা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন।
চীন ব্যাপকভিত্তিক পানি প্রত্যাহার করলে নদীতে পানি কমে যাবে। আর তখন উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বয়ে আসা প্রধান নদ-নদী তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারাবে। তখন সামান্য বৃষ্টি হলেই বিরাট বন্যার রূপ নেবে। ব্রহ্মপুত্র, বরাক কিংবা তিস্তা কোনো কিছুকেই ভালোভাবে চেনা যাবে না।
শুধু পানি প্রত্যাহারই নয়, এখন চীনের নদীর গতিপথ পাল্টানোর পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব ছাড়াও হিমবাহ গলার প্রলয়ঙ্করী পূর্বাভাস তো আছেই।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞ সন্দীপ ওয়াজলেকার যেভাবে ড. মনমোহনের আশ্বাসকেই চূড়ান্ত ধরেননি; একইভাবে মনমোহনের আশ্বাসকেও বাংলাদেশ চূড়ান্ত ধরে নিতে পারে না। এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়।
ওয়াজলেকারের মন্তব্য, ‘আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করতে পারে। এই সময়ের মধ্যে ভারতকে তার ঘর ঘোছাতে হবে।’ টিপাইমুখ নিয়ে কোনো বাঙালির একই ধারণার বশবর্তী হওয়া কি ভুল হবে? ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ব্রহ্মপুত্রের বিষয়ে চীনা নিশ্চয়তাকে ভারতের যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশও একই সুরে বলতে পারে, টিপাইমুখের বিষয়ে ভারতীয় নিশ্চয়তাকে বাংলাদেশের যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত হবে না।
বাংলাদেশের উচিত হবে একটি সর্বাত্মক পরিবেশ কূটনীতিতে শামিল হওয়া। বিশ্বকে বোঝাতে হবে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত হুমকি ছাড়াও বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ চীন ও ভারতের মতো দুই বৃহৎ শক্তির ধেয়ে আসা ‘পানিযুদ্ধে’ কিংবা তেমন হুমকিজনিত পরিস্থিতির অসহায় শিকার হতে চলেছে।
ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে, ‘ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা চলছে এবং সেটা বিশ্বের দুই বৃহত্তম সেনাবাহিনীর জ্বলনাঙ্ক (ফ্লাশ পয়েন্ট) হতে পারে। ২০০০ সালে ভারত চীনকে অভিযুক্ত করেছে যে, নদী বিষয়ে তারা তথ্য দেয়নি। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে চীনের প্রস্তাব দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করেছে। হিমালয়ে হিমবাহ গলার কারণে গঙ্গায় সৃষ্ট বন্যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অভিবাসন বেড়ে গেছে। ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তা রুখতে চাইছে।’
আমরা মনে করি, সরকারি পর্যায়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশ যদি একমত হয়, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা হওয়ার নয়। পানিসম্পদকে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে বিবেচনায় নিয়ে চীন ও ভারতের খেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর অববাহিকাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাইলে তিন দেশকেই এক টেবিলে বসতে হবে। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে ট্রাক টু (বেসরকারি) ডিপ্লোমেসি রয়েছে। দরকার ত্রিদেশীয় কূটনীতি। ড. আইনুন নিশাতের দেওয়া ত্রিদেশীয় নদী কমিশন গঠনের প্রস্তাবকে আমরা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মনে করি। বেগম খালেদা জিয়া মনমোহনকে শুধু নয়, চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এ বিষয়ে চিঠি লিখতে পারেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।