শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

চীন-ভারতের ‘পানিযুদ্ধ’ ও বাংলাদেশ



চীন ও ভারতের মধ্যে একটি ‘পানিযুদ্ধ’ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তা নির্ধারণে এখনই সচেতন মহলের চিন্তাভাবনা করা উচিত। বাংলাদেশ পানি নিয়ে এখন ভারতের সঙ্গে যে যুক্তিতে কথা বলছে, সেই তেতো যুক্তিগুলোই তারা চীনের সঙ্গে ভবিষ্যতে মধুর করে তুলবে। আর তখন তা চীনের কাছে তেতো লাগবে।
ড. মনমোহন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের (চীনা নাম সাংপো) ওপর বাঁধ নির্মাণে চিনের কাছ থেকে ভরসা পেয়েছেন। অনেকটা সেভাবেই তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এখন লিখিতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে ভরসা দিয়েছেন। রাজ্যসভায় গত ৪ আগস্ট ড. মনমোহন বলেছিলেন, ‘আমাদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে এমন কিছুই করা হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
ভারত সরকার তাই সাংপোতে বাঁধ নির্মাণে বাধা দেয়নি, প্রতিবাদ করেনি। ভারতও এখন বাংলাদেশের কাছে সেটাই আশা করছে। কিন্তু সেটা মনিপুর ও আসামের জনগণের মতো বাংলাদেশও মানতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীমালার নিম্নতম অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৃহৎ বাঁধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করাই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা, তিস্তার পরে টিপাইমুখকেও চীন ও ভারতের ধেয়ে আসা ‘পানিযুদ্ধের’ বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না।
বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের বহু পরিবেশবিদ বৃহৎ বাঁধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের সংগঠিত করার নেতৃত্ব ধরিত্রীর বিপন্নতম রাজধানী ঢাকাকেই দিতে হবে। টিপাইমুখ প্রশ্নে পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার অঙ্গীকার যেন লোকদেখানো বিষয়ে পরিণত না হয়। গত বছরের মার্চে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছিলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের একটি অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ চীন ও ভারতের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এ বিষয়ে ওই দুটি দেশের তরফে কিছু না জানলেও তিনি জানিয়েছিলেন, দুই দেশ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশকে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্মাণাধীন বাঁধ সম্পর্কেও চীনের কাছে তথ্য চাইতে হবে। ভারতীয় জনগণকে দেওয়া মনমোহন সিংয়ের ‘ভরসায়’ বাংলাদেশের চলবে না। চীনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এতটাই বিপুল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার তুলনা মানব ইতিহাসে নেই। গত ৪ মার্চ ২০১১ ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় পরিবেশ ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের নীতিনির্ধারণী পরিচালক পিটার বোশার্ড লেখেন, ‘যদি ওই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়, তাহলে অবধারিতভাবে চীনের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী এবং বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।’
চীনা বাঁধব্যাধি প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ লোককে স্থানচ্যুত করেছে। বাঁধ ভেঙে নিহত চীনা নাগরিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ছুঁয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে চীন এক লাখ ৪০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ভারত তার ১৬ রাজ্যে ১৬২ প্রকল্প করে ২০১৭ সালের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
ভারতের পানিসম্পদ ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞ ব্রমা চেলানী আন্তর্জাতিক নদীতে চীনের বাঁধ নির্মাণ এবং পানি প্রত্যাহারে কী সর্বনাশ ঘটাতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে তিনি শুধু ভারতের জাতীয় স্বার্থেই আলো ফেলছেন। উজানের চীনের বিরুদ্ধে ভাটির ভারতের যুক্তি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানেরও মনের কথা। আবার মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওসেরও মনের কথা। ভাটি অঞ্চলের দেশগুলো একই সুরে তাল মেলাতে পারে। তবে চীন পানি প্রত্যাহার শুরু না করলে ভারতকে হয়তো ভাটির দেশের উদ্বেগ নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যেত না।
এখনো মনে হচ্ছে, ভারত গঙ্গা ও তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যা করে চলেছে, তেমন ধরনের ত্রাহি মধুসূধন অবস্থায় চীন তাকে না ফেলা পর্যন্ত ভারতের হুঁশ হবে না।
এটা সন্দেহাতীত যে, চীন ও ভারতের মধ্য দিয়ে বহমান আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানিসম্পদ প্রশ্নে বাংলাদেশকে সব সময় তীক্ষ নজর রাখতে হবে। চীন ও ভারতে এমন অনেক মানবতাবাদী কণ্ঠস্বর রয়েছে, যাঁরা মানুষের দুঃখ-কষ্টকে শুধুই সীমান্তরেখা দিয়ে বিচার করেন না। তাঁরা পানি অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে চান। গত ১৯ আগস্ট ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় প্রাচী ভূচর চীন-ভারত-বাংলাদেশ জরুরি ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক পানি চুক্তি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। তাঁর প্রশ্ন, চীন কি তাতে সাড়া দেবে? আরও ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের প্রশ্ন আরেকটু জটিল: এমন প্রস্তাবে চীন ও ভারত কি বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেবে?
ড. মনমোহনের ওই আশ্বাসে ভারতীয় পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সন্তুষ্ট নন। তাঁরা দরজা বন্ধ করে ঘুম দেননি। ব্রমা চেলানির মন্তব্য, ‘চীন সর্বদাই তার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে নির্বাক। প্রতিবেশী দেশগুলোকে তথ্য প্রদান, প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে দিতে তারা অনিচ্ছুক। এমনকি বৃহৎ বাঁধের কাজও নিঃশব্দে শুরু করার অভ্যাস তাদের আছে।’ ভারেত কি কখনো আমাদের বলবে, ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারাজের উজানে ঠিক কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে? নদ-নদী ও পানিসংক্রান্ত তথ্য না দেওয়ার ভারতীয় রেকর্ড বরাবরই পানসে।
ভবিষ্যতের পানিযুদ্ধে চীন হবে প্রধান খেলুড়ে। বিধাতা চীনকে দুহাত ভরে উজাড় করে দিয়েছেন। অন্তত ১০টি আন্তর্জাতিক নদীর উৎস শুধু চীনা ভূখণ্ডে। ভারতের পক্ষে চীন প্রভাবিত এই অঞ্চলের পানিরাজনীতি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। একলা চলার দিন তার শেষ। ১৯৬০ সালে ইন্দাজ ট্রিটি সই করে পাকিস্তানের সঙ্গে পানিসংঘাত ভারত এড়িয়েছে।
গত মে মাসে দিল্লিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনারকে বললাম, ইন্দাজ মডেলে একটি চুক্তি বাংলাদেশেরও প্রাপ্য। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বললেন, ওটা করা ভারতের ভুল হয়েছিল। তাঁর কথায় অবাক হয়েছিলাম। তাঁর এই উপলব্ধি যে ভুল, সেটা ইন্ডিয়া টুডের গত আগস্টের সুপারিশে স্পষ্ট। পত্রিকাটি ব্রহ্মপুত্র প্রশ্নে ইন্দাজ মডেলে চীন ও তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে চুক্তি চাইছে। আমরা বলব, উহুঁ, শুধু ব্রহ্মপুত্র কেন, চীন ও ভারতের মধ্যে বয়ে চলা গঙ্গাসহ সব নদী নিয়ে ইন্দাজ মডেলে চুক্তি চাই। তবে প্রশ্ন হলো, সেটা কি চীন ভারতকে ভীষণ বেকায়দায় না ফেলা পর্যন্ত চিন্তা করতেও রাজি হবে?
২০৩০ সালের মধ্যে চীন ২৫ শতাংশ পানির ঘাটতিতে পড়বে। মুম্বাইভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপের সভাপতি সন্দীপ ওয়াজলেকার বলেছেন, ‘চীনে ছয় হাজারের বেশি হ্রদ শুকিয়ে গেছে। উত্তর চীনে হলুদ নদীর অববাহিকা ৩০ শতাংশ মরে গেছে এবং মরুকরণও শুরু হয়ে গেছে। সে কারণেই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নদীর পানি প্রত্যাহার ছাড়া চীনের সামনে বিকল্প খুব কমই থাকবে।’
চীনের ব্যাপকভিত্তিক পানি প্রত্যাহারের অর্থই হবে ভারতীয় পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনাকে আরও উসকে দেওয়া। দূরদর্শী ভারত সে কারণেই গঙ্গাচুক্তিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি ভাগ করেছে। তিন ‘যদি’র চুক্তি করেছে। এর মানে, ফারাক্কায় যদি ১০ বালতি পানি এসে জমা হয়, তাহলে বাংলাদেশ তিন বালতি পাবে। একই অবস্থা হবে অন্যান্য নদ-নদীর। তিস্তাচুক্তি শুধু মমতার খেয়ালীপনায় হচ্ছে না—এই ধারণার অনুসারীরা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন।
চীন ব্যাপকভিত্তিক পানি প্রত্যাহার করলে নদীতে পানি কমে যাবে। আর তখন উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বয়ে আসা প্রধান নদ-নদী তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারাবে। তখন সামান্য বৃষ্টি হলেই বিরাট বন্যার রূপ নেবে। ব্রহ্মপুত্র, বরাক কিংবা তিস্তা কোনো কিছুকেই ভালোভাবে চেনা যাবে না।
শুধু পানি প্রত্যাহারই নয়, এখন চীনের নদীর গতিপথ পাল্টানোর পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব ছাড়াও হিমবাহ গলার প্রলয়ঙ্করী পূর্বাভাস তো আছেই।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞ সন্দীপ ওয়াজলেকার যেভাবে ড. মনমোহনের আশ্বাসকেই চূড়ান্ত ধরেননি; একইভাবে মনমোহনের আশ্বাসকেও বাংলাদেশ চূড়ান্ত ধরে নিতে পারে না। এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়।
ওয়াজলেকারের মন্তব্য, ‘আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করতে পারে। এই সময়ের মধ্যে ভারতকে তার ঘর ঘোছাতে হবে।’ টিপাইমুখ নিয়ে কোনো বাঙালির একই ধারণার বশবর্তী হওয়া কি ভুল হবে? ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ব্রহ্মপুত্রের বিষয়ে চীনা নিশ্চয়তাকে ভারতের যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশও একই সুরে বলতে পারে, টিপাইমুখের বিষয়ে ভারতীয় নিশ্চয়তাকে বাংলাদেশের যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত হবে না।
বাংলাদেশের উচিত হবে একটি সর্বাত্মক পরিবেশ কূটনীতিতে শামিল হওয়া। বিশ্বকে বোঝাতে হবে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত হুমকি ছাড়াও বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ চীন ও ভারতের মতো দুই বৃহৎ শক্তির ধেয়ে আসা ‘পানিযুদ্ধে’ কিংবা তেমন হুমকিজনিত পরিস্থিতির অসহায় শিকার হতে চলেছে।
ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে, ‘ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা চলছে এবং সেটা বিশ্বের দুই বৃহত্তম সেনাবাহিনীর জ্বলনাঙ্ক (ফ্লাশ পয়েন্ট) হতে পারে। ২০০০ সালে ভারত চীনকে অভিযুক্ত করেছে যে, নদী বিষয়ে তারা তথ্য দেয়নি। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে চীনের প্রস্তাব দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করেছে। হিমালয়ে হিমবাহ গলার কারণে গঙ্গায় সৃষ্ট বন্যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অভিবাসন বেড়ে গেছে। ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তা রুখতে চাইছে।’
আমরা মনে করি, সরকারি পর্যায়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশ যদি একমত হয়, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা হওয়ার নয়। পানিসম্পদকে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে বিবেচনায় নিয়ে চীন ও ভারতের খেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর অববাহিকাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাইলে তিন দেশকেই এক টেবিলে বসতে হবে। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে ট্রাক টু (বেসরকারি) ডিপ্লোমেসি রয়েছে। দরকার ত্রিদেশীয় কূটনীতি। ড. আইনুন নিশাতের দেওয়া ত্রিদেশীয় নদী কমিশন গঠনের প্রস্তাবকে আমরা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মনে করি। বেগম খালেদা জিয়া মনমোহনকে শুধু নয়, চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এ বিষয়ে চিঠি লিখতে পারেন।
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ২৮-১১-২০১১

বিএনপির চেয়ারপারসনের চীনা-চমক



চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বেগম খালেদা জিয়া চীনা সামরিক বাহিনীর সংবাদপত্রের খবর, ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ভারত তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর ভারত তার বিরোধপূর্ণ চীন সীমান্তে বৃহত্তম সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে। এখানে মোতায়েন থাকবে এক লাখ সেনা।
রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চায়না ইনস্টিটিউটস অব কনটেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের বিশেষজ্ঞ ফু জিয়াও কিয়াং ওই চীনা দৈনিককে বলেছেন, ‘ভারতের এই সমরসজ্জা চীনকে সামলানোর বৃহত্তর পশ্চিমা পরিকল্পনার অংশ। পশ্চিমারা চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সংঘাত উসকে দিয়ে সুবিধা নিতে চাইছে।’ তবে ওই সংবাদপত্র বলেছে, ভারতের এক লাখ বাড়তি সেনা মোতায়েনের কারণ সামরিকের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। (হিন্দু, ১০ নভেম্বর, ২০১১)
এই প্রেক্ষাপট অসত্য নয়, আবার এটাই নিরেট চিত্র নয়। সার্কে চীনের বৃহত্তর ভূমিকা রাখার আগ্রহকে চীন-ভারতের বিবাদের আলোকেই বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশ সফররত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনাকালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সার্কে চীনের ‘পূর্ণ সদস্যলাভ’ আশা করেছেন। কিন্তু চীন নিজে তা বলেনি। পাঁচ বছর আগে ভারত আফগানদের সার্কে আনতে চাইলে পাকিস্তান চীনকে পর্যবেক্ষক করে। তখন ভারতের ‘বিস্ময়কর আগ্রহে’ সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও তাতে সামিল হয়। এখন চীন সার্কের নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলনের অতিরিক্ত একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক হতে চাইছে। সর্বসম্মসত সিদ্ধান্ত ছাড়া এর বাস্তবায়ন অসম্ভব। নতুন সদস্য করতে সার্কের গঠনতন্ত্র শুধরাতে হবে। সুতরাং এ অবস্থায় অন্তর্নিহিত ভারত-বিরোধিতার সুরে অর্থহীন চীনপ্রীতি অনভিপ্রেত।
বিএনপি নেতা ড. আবদুল মঈন খানের মন্তব্য, ‘সার্কের একটি বৃহৎ শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট রাষ্ট্রকে অব্যাহতভাবে দমিত রাখছে।’ তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওই আলোচনায় অংশ নেন, টেলিফোনে জানতে চাই, সার্কের পূর্ণ সদস্য হতে চীনের কি প্রস্তাব ছিল, নাকি এটা বিএনপির আগ বাড়ানো উদ্ভাবনী প্রস্তাব? ড. খান এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা জানান।
মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় অন্ধ ভারত-বিরোধিতার মধ্য দিয়ে বিএনপির জন্ম হয়েছিল। দিল্লি-ওয়াশিংটন বদলেছে। বিএনপি বদলায়নি। জাতীয় স্বার্থে এই বদলটা দরকার।
বহুল আলোচিত বিগ ফোর (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) রিপোর্টের পূর্বাভাস হচ্ছে, ২০৩২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর ভারত হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তাঁরা দুই (ভারত ও চীনের) ডানায় উড়তে চান। বাংলাদেশকেও ‘দুই ডানায়’ ওড়া রপ্ত করতে হবে, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও মন জোগাতে হবে।
১৯৭৭ সালের দিকে জিয়াউর রহমান যখন চীনের সঙ্গে দোস্তি করেছিলেন, তখন তাঁর ভারতবিরোধী নীতি ছিল উগ্র। সে সময়ের ভারত-চীনের মাত্র দুই মিলিয়ন ডলারের দুমুখী বাণিজ্যটা ২০১০ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলার (এর ২৫ বিলিয়নই দিল্লির প্রতিকূলে) অতিক্রম করেছে। ২০১৫ সালে এটা তারা ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি এখনও এক বিলিয়ন ডলার নয়। চীনের জানিদোস্ত পাকিস্তান ২০১০ সালে চীন থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার আমদানি করেছে। রপ্তানি মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও গত ডিসেম্বরে চার শ ব্যবসায়ী নিয়ে ভারতে তাঁর সুপারডুপার হিট সফরে যান। চীনা ও ভারতীয়রা তখন ১৬ বিলিয়ন (ভারতে ২০০৮ সালের মার্কিন এফডিআইর সমান) ডলারের ব্যবসায় চুক্তি সই করেছিলেন।
ঢাকা ও ইসলামাবাদ যথাক্রমে দিল্লি ও বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রগাঢ় উষ্ণতা নিয়েও এ ধরণের একটি শীর্ষ সফর কল্পনা করতে অক্ষম। গুজরাটের বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন যাচ্ছেন। একে সামনে রেখে গুজরাটে ২৫০০ কোটি রুপি বিনিয়োগে গ্রিনপার্ক বানাতে চীনারা সমঝোতা স্মারক সই করল গত সপ্তাহে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দিল্লির দোস্তির কারণেও চীন-ভারতের বাণিজ্যের বাড়বাড়ন্তে ঘাটতি পড়েনি। সুতরাং ভারতকে দেখিয়ে দেওয়ার মনমানসিকতা থেকে যাঁরা ঢাকায় সার্কে চীনের অন্তর্ভুক্তি চাইছেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
সার্কে চীনের বৃহত্তর ভূমিকা রাখার বিষয়ে ভারতের শীতল মনোভাবের সরকারি বক্তব্য আমাদের নজরে আসেনি। বরং সার্কের আদ্দুসিটি ঘোষণায় ‘ডায়লগ পার্টনার’ ইস্যু আলোচনা করতে ভারতের সম্মতি লক্ষণীয়। সার্কের এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক দ্য স্ট্রেইট টাইমসকে বলেছেন, ‘চীন আসিয়ানের মতো সার্কের আট সদস্যের সঙ্গে বছরে একটি অতিরিক্ত শীর্ষ সম্মেলনে বসতে আগ্রহী। তাদের এই আগ্রহ ভারতকে অসন্তুষ্ট করেছে; এবং আমরা বেশির ভাগ সদস্যই চুপচাপ দেখে যাচ্ছি। কারণ, আমরা দিল্লিকে অসন্তুষ্ট করতে চাই না।’ চীন ও ভারত পূর্ণ সদস্য না হয়েও আসিয়ানে একাকার হচ্ছে। চীন আসিয়ান প্লাস থ্রি-র সদস্য। চীন ও ভারত সেখানে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সেরেছে। বিশ্ব দাবাখেলার মধ্য দিয়ে এভাবে সবাইকে নিয়েই আসিয়ানের জয়যাত্রা অব্যাহত। তার কমন মার্কেট হচ্ছে ২১০৫তে।
আরও বহু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে ভারত ও চীন একত্রে সক্রিয় রয়েছে। ১৯৯৬-এ সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন এসসিও চীনসহ পাঁচটি দেশ নিয়ে গঠিত হয়। কথা ছিল, সাংহাই সীমান্ত সন্নিহিত দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট হবে এটি। চার বছর পর এর পর্যবেক্ষক হয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও ইরান। ভারত এখন এই সংস্থার পূর্ণ সদস্যপদ পেতে উদগ্রীব। চীন ভারতকে সদস্যভুক্ত করতে রাজি হয়েছে।
মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্নপ্রসূত ইস্ট এশিয়া সামিটেও (ইএএস) একই চিত্র। আসিয়ানের ১০টি দেশ ছাড়া এতে ভারত ও চীন আছে। তবে প্রফেসর এস ডি মুনি তাঁর এক গবেষণাপত্রে দেখান, চীন প্রথমে ভারতকে নিতে ‘দ্বিধান্বিত’ থাকলেও পরে রাজি হয়েছে। উইকিলিকস সূত্রে পাওয়া মার্কিন কনসাল ব্লেকের ২০০৫ সালের দিল্লির বার্তায় লেখা: ‘চীন যেহেতু ইএএসে ভারতের পূর্ণ সদস্যপদ কবুল করেছে, দিল্লি তাই সার্কে চীনের পর্যবেক্ষক মর্যাদা মানছে।’
আমরা কানেকটিভিটির কথা বলি। এবং সেখানে এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির অবস্থান প্রায় অভিন্ন। ১৯৯৯ সালে কুনমিংয়ে বেসরকারিভাবে গঠিত হয় বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি ফোরাম। গত জানুয়ারিতে এ ফোরাম কুনমিং-মান্ডালে-ঢাকা-কলকাতা অর্থনৈতিক করিডর প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার করেছে। ওই সম্মেলনে ভারতীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এরিক গনজালেস (ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত) চীনা সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নকে স্বাগত জানান। যদিও এখন জানা যায়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রস্তাবমতে চীনকে দিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে একটা অস্বস্তিতে আছে। এর আগে শেখ হাসিনার সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সোফা’ চুক্তি করতে পারেনি ভারতের আপত্তির কারণে। এখন দিল্লি-ওয়াশিংটন সাধারণত একই সোফায় বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে হংকং থেকে ফিলিপ বাউরিং লিখেছিলেন: ভূরাজনৈতিক অবস্থানই বাংলাদেশকে তার বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের ওপর বড় নির্ভরশীল করেছে। তবে ভারত এটা বুঝতে শুরু করেছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে দাদাগিরি করলে তার নিজের অন্যান্য সমস্যা আরও নিকৃষ্ট হতে পারে (নিউইয়র্ক টাইমস, ১১ জানুয়ারি ২০১০)।
এটা বড় পরিহাসের হবে যে চীন ও ভারত সব কৌশলগত সমীকরণ, সব সন্দেহ-সংশয় বজায় রেখেই শত শত বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করবে; আসিয়ানে, এসসিওতে, ইএএসে মেলবন্ধন গড়ে তুলবে আর তাদের একান্ত প্রতিবেশীরা সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তাদের দেশের বিনিয়োগ (এফডিআই) চীন কিংবা ভারতে নয়, শুধুই আসিয়ানের জন্য। বারাক ওবামা হনলুলুর অ্যাপেক বৈঠকে আসিয়ান নেতাদের তোয়াজ করলেন। আন্তপ্রশান্ত অর্থনৈতিক জোন গঠনের রূপকল্প দিলেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খিদে মেটাতে মঙ্গলবার চীনের বাণিজ্য ও মুদ্রানীতির বিরুদ্ধে ওবামা তীব্র খেদোক্তি করেছেন। এ রকম প্রায় অসার তর্জনগর্জনকে আমরা সম্ভবত বেশি মনে রাখি। ২০১০ সালে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ৯১ বিলিয়ন ডলার, আর চীন থেকে তার আমদানি কত? ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ১৯ বিলিয়ন ডলার। ভারত থেকে আমদানিটা চীনের তুলনায় বারো ভাগের এক ভাগ মাত্র ২৯ বিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ড. দেলোয়ার হোসেন যদিও মনে করেন, ‘সার্কে চীনের সদস্যপদ বিবেচনার সময় এখনই নয়। ভারত ও অন্যরা এর বিরোধিতা করবে।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাই ঘটুক তাতে আমাদের কী এসে যায়? ড্রাগন ও হাতির কসরৎ আমরা কি চেয়ে চেয়ে দেখব?
তবে সার্ক খাঁচায় ঢুকতে ‘ড্রাগনের’ নয়া আগ্রহ আমাদের নানা কারণে কৌতূহলীও করে। মূল কারণ পানিসম্পদ। আমরা গত চার দশক পানি নিয়ে শুধু ভারতের সঙ্গে আলোচনা করেছি। শিগগির এই চিত্রটি বদলাতে পারে। দেখা যাবে, চীনের ‘পানি প্রভুত্ব’ নিয়ে সোচ্চার হতে ভারত অভিন্ন অববাহিকার বাংলাদেশ ও নেপালকে কাছে পেতে চাইছে। মেটগে ব্রহ্মপুত্রের ওপরে চীন ৩৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির জন্য বাঁধ তৈরি করবে। বিশ্বের বৃহত্তম ‘থ্রি জর্জেস ড্যামের’ চেয়ে উচ্চতায় সেটা দ্বিগুণ হবে। তিস্তা মরে যাবে। দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক ব্রমা চেলানি লিখেছেন, ‘চীন কখনো তার প্রতিবেশীর সঙ্গে পানিচুক্তি করেনি। চীনের কাছ থেকে সর্বাগ্রে তার পানিনীতি আশা করি, সে জন্য তার সার্কের পূর্ণ সদস্য হওয়ার দরকার নেই।’ মওদুদ আহমদ লেখককে বলেন, ‘নেপালি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পানিসম্পর্কিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নিশ্চিত করেন যে চীন সার্কের পূর্ণ সদস্য হতে চায়নি। চীনাদের আস্থাভাজন রাশেদ খান মেনন লেখককে বলেন, ‘তারা কখনোই সদস্য হতে চায়নি।’ মনে হচ্ছে, বিএনপি নেত্রী নতুন এক চীনা-চমক দিলেন।
দুই দল বুঝলে দেশের মঙ্গল, মাতবরের মাথায় ছাতি ধরে নিজের কদর বাড়ানোর কৌশল বাসী হয়ে গেছে। যে কারো প্রতি অন্ধ অনুরাগ আত্মঘাতী।
মোদ্দা কথা হল দুই দলকেই পররাষ্ট্রনীতিতে অভিন্ন অবস্থান নিতে হবে, গলাগলি না হলেও গালাগালির ভিত্তিতে নয়। ই-মেইলে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান ড. আলী রীয়াজের মন্তব্য, ‘এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সমীকরণ দীর্ঘস্থায়িত্ব পাবে।’
অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ১৪ নভেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্য ও পানিসম্পদ নিয়ে মতবিনিময় করছিলেন। এ সময় তাঁর মন্তব্য, ‘বৃহৎ রাষ্ট্রের তরফে সুবিধা পেতে দুর্বল রাষ্ট্রের উচ্চতর ধীশক্তি, কূটনেতিক উৎকর্ষ থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ এখানটাতেই মার খাচ্ছে নয় কি?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com 
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ১৭-১১-২০১১

দীপু মনির সঙ্গে হিনা রাব্বানির ‘দুর্ঘটনা


দীপু মনি, হিনা রাব্বানি তিস্তা নিয়ে ড. মনমোহনের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকের অগ্রগতির খবর ঢাকায় পৌঁছার আগেই বাংলাদেশ ভারতের কারণে পাকিস্তানের কাছে এক ইস্যুতে একরকম হেরে গেছে। এতে পাকিস্তানের ইতিহাসের কনিষ্ঠতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের খুব খুশি হওয়ারই কথা। কারণ, তিনি ভাবতে পারেন যে দীপু মনিকে এক রাউন্ড হারিয়ে দিতে পেরেছেন। এতে হিনা তাঁর পাশে দিল্লিকে পেয়েছেন।
দীপু মনি শেষ পর্যন্ত দেখলেন, দিল্লি তাঁর পাশে নেই। আর হিনা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সঙ্গে তাঁর দেশের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি তুলে ধরেন এভাবে—পাকিস্তানকে ইইউর বাণিজ্যছাড় প্রদান পরিকল্পনায় বাংলাদেশের আপত্তির বিষয়টি তিনি বড়জোর একটি ‘দুর্ঘটনা’ মনে করেন।
৮ ও ৯ নভেম্বর রয়টার্সের দুটি প্রতিবেদন পড়ে অবাক হয়েছিলাম। এ এমনভাবে লেখা, যার অবিকল অনুবাদ পড়ে কারও মনে হতে পারে, বাংলাদেশের হলোটা কী! ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বন্যাদুর্গত পাকিস্তানের জন্য বাণিজ্যসুবিধা দিতে চায়। আর বাংলাদেশ তাতে খামোখা বাগড়া দিচ্ছে। জেনেভায় দুই দিন আগে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে, তাতে আপত্তি তুলেছে ঢাকা। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ঈষৎ আহত বোধ করতে পারে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ এলডিসির ৪৮টি দেশের অন্যতম। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি দেশগুলো ইইউর বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক বেচতে পারে। এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো বাড়তি অনুকম্পা নয়। পাকিস্তান ও ভারত এলডিসি নয়, মর্যাদায় তারা এলডিসির ওপরে—উন্নয়নশীল। কিন্তু পাকিস্তান এখন এলডিসির ভান ধরতে চাইছে।
বাংলাদেশ গত অর্থবছরে ইইউতে প্রায় সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র রপ্তানি করেছিল, যা ছিল তার মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আসে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে উন্নয়নশীল দেশের গোত্রভুক্ত। এ কারণে ইইউ যখন তার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মিত্র পাকিস্তানকে মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ভারত তাতে সম্মতি দেয়নি। অনেকে মনে করেছিলেন, ভারতের আপত্তি নীতিগত। কারণ, পাকিস্তান বা কোনো একটি দেশকে বিধি ভেঙে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও একই ধরনের সুবিধা আশা করতে পারে। কিন্তু সেই ভারত হঠাৎ মন পাল্টাল।
পাকিস্তানের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি এ বছরের জুলাইয়ে ভারতে গিয়ে বেশ নজর কেড়েছিলেন। এর তিন মাস আগে ভারত সফরে যান ইউসুুফ রাজা গিলানি। গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহমিনা জানজুয়া সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে আশ্বস্ত করেছেন যে ৭০টি আইটেমে বিশেষ শুল্কসুবিধা দিতে ইইউর পরিকল্পনার বিরোধিতা তাঁরা করবেন না। হিনার কাছেও দিল্লি তা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাহমিনা আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘এখনো বাধা যায়নি। কারণ, অন্যান্য দেশেরও আপত্তি রয়েছে।’
২০১০ সালে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা হয়। দুই কোটি মানুষ বন্যাদুর্গত হয়। ২০১০-১১ সালে দেশটির জিডিপির ২ শতাংশ ও ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি মার খায়। বেকারত্ব ১০ শতাংশ বাড়ে বলেও অনুমিত হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ইইউর শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তানকে বিশেষ বাণিজ্যসুবিধার নামে সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত শুধু ইইউ পার্লামেন্টেই নয়, ডব্লিউটিওতেও অনুমোদিত হতে হবে। সোমবারে জেনেভায় সেই বৈঠকই বসেছিল।
ইইউভুক্ত পোশাক উৎপাদনকারী ইতালি, ফ্রান্স ও পর্তুগালও বিশেষ বাণিজ্যসুবিধার নামে সহায়তা প্রদান নীতির বিরোধিতা করে। তবে পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। শ্রীলঙ্কা চুপচাপ ছিল। ইইউ তাদেরও একবার এ ধরনের সুবিধা দিয়েছিল। ভারতের যুক্তি ছিল প্রথাগত, কিন্তু ঠুনকো নয়। ভারত বলেছিল, বন্যাদুর্গত পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান অবশ্যই সমর্থনযোগ্য; কিন্তু তা বৈষম্যমূলক বাণিজ্যসুবিধার ছদ্মাবরণে কেন। ভারতীয় একজন বাণিজ্য নেগোশিয়েটর বলেছিলেন, এটা একটা ভয়ংকর দৃষ্টান্ত স্থাপন এবং তা মুক্ত বাণিজ্যনীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে। তাঁর কথায়, ‘এটা বাণিজ্য ভিন্নমুখীকরণ। শ্রীলঙ্কা কিংবা বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের কী হবে? পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্বিপাকে পড়েছে বলে তাদেরও এর মাশুল গুনতে হবে?’ (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ এপ্রিল ২০১১)
বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও মাশুল গুনতে হবে। তাকে এখন ইইউর বাজারে পাকিস্তানের সঙ্গে তেজি প্রতিযোগিতা উতরিয়ে তবে বিদেশি মুদ্রা ঘরে আনতে হবে। কিন্তু ভারত প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণে না নামলে বাংলাদেশের হয়তো আপত্তি করার কথা ছিল না। এমনও নয় যে ওই সময়ে তাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করছিল; বরং গত বছরের মার্চের ‘মোহালি চেতনায়’ (ক্রিকেট খেলা দেখা) মনমোহন-গিলানি তখন উদ্ভাসিত। ভারত ‘নীতিগত’ অবস্থান থেকে বিরোধিতা করলেও বিশ্ব কিন্তু পাক-ভারতের চির বৈরিতার আলোকেই তা পরখ করেছে। সে কারণে মালদ্বীপের আদ্দু সিটি থেকে পাঠানো রয়টার্স প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে, তাই ভারত সংকেত দিয়েছে যে তারা আর ইইউর পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করবে না। কিন্তু বদনামটা পড়ল যেন বাংলাদেশের কাঁধেই। ব্রাসেলস ডেটলাইনে রয়টার্স ৮ নভেম্বরে আরও একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়: ‘কূটনীতিকেরা মঙ্গলবার ব্রাসেলসে বলেছেন, বন্যাবিধ্বস্ত পাকিস্তানের জন্য ইইউর বাণিজ্যসুবিধার নামে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইউরোপ ও পাকিস্তান বহুদিন ধরে আশায় ছিল যে তারা জেনেভায় সোমবারে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য কূটনীতিকদের বৈঠকে ওই প্রস্তাব অনুমোদন করে নেবে। কিন্তু একটি বাংলাদেশি অভিযোগ তা কার্যকরভাবে প্রতিহত করেছে। বাংলাদেশ একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে বলে যে এ বিষয়ে তাদের উৎকণ্ঠা আছে।’
ঢাকা যখন দেখল ইইউ অটল, ভারতও তার পাশে নেই, তখনো তারা কেন বাধা দিল, আবার কেনই বা দ্রুত পিছটান দিল—তা আমরা জানি না। তবে রয়টার্স ৯ নভেম্বর মালদ্বীপ থেকে পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েসের একটি দ্বিধান্বিত ও দ্ব্যর্থক উদ্ধৃতি প্রকাশ করেছে। তাঁর উক্তি—‘সার্কের উপরি হিসেবে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে এখানে কথা বলেছেন। আমি জেনেভায় খতিয়ে দেখব...। আমি যতদূর জানি, আমাদের এটা (অভিযোগ) প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা।’ এ উক্তি হয়তো সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি কিংবা পররাষ্ট্রসচিব অসতর্ক ছিলেন।
বিজিএমইএর সভাপতি মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে ৯ নভেম্বর ফোনে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ কেন এবং কী বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, তা তিনি শুনেছেন। কিন্তু বিস্তারিত জানা নেই। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেনি।’ পাকিস্তানিরা যদিও বলছে যে প্রস্তাবিত ইইউ-সুবিধা মাত্র দুই বছরের জন্য। সে কারণে বাংলাদেশকে তেমন খেসারত দিতে হবে না। কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিরাট উদ্বেগজনক।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার কারণ হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ ঠিক আপত্তি তোলেনি। তবে গোড়াতেই এ বিষয়ে কথা তুলে কিছুটা হলেও তার লাভ হয়েছে।’ পাকিস্তান শূন্য শুল্কসুবিধা পেলে ইউরোপে বাংলাদেশের বিরাট বাজার হাতছাড়া হতে পারে। তাই বাংলাদেশ, বিশেষ করে তার সর্বাধিক রপ্তানিপ্রবণ আটটি আইটেমে (তৈরি পোশাক) সংরক্ষণ চেয়েছিল। ছয়টিতে তা নিশ্চিত করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব পণ্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বিনা শুল্কে ঢুকবে। কিন্তু তার বেশি হলেই পাকিস্তানকে শুল্ক দিতে হবে।
গত ১২ অক্টোবরে প্রকাশিত এক পাকিস্তানি সমীক্ষামতে আট আইটেমের (ওভেন ও নিটেড গার্মেন্টসসহ) ৭৪ ক্যাটাগরিতে পাকিস্তান ২০০৯ সালে ৮৫৫ মিলিয়ন ইউরোর পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রস্তাবিত সুবিধা পেলে তারা প্রায় ২৫০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরোর অতিরিক্ত রপ্তানি বাড়াতে পারবে। এর অনেকটা বাংলাদেশের ভাগ থেকেই যেতে পারে।
আশা করি, আমরা অচিরেই এ বিষয়ে সরকারের একটি ব্যাখ্যা পাব। তবে আপাতত জিজ্ঞাসা হলো, সোমবারের জেনেভায় বাংলাদেশ দুর্ঘটনার শিকার, না দুর্ঘটনার উদ্গাতা? ঢাকায় সরকারি সূত্রের দাবি, ডব্লিউটিওর ৭ নভেম্বরের সভায় বাংলাদেশ নয়, বরং ব্রাজিলের আপত্তির কারণে সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু এ খবর কোথাও দেখিনি। হিনা রাব্বানি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে তারা (ঢাকা) আমাদের অবহিত করেছে যে এটা আসলে একটা দুর্ঘটনা বৈ কিছু নয়।’ এ বক্তব্য সঠিক হলে বলা যায়, ডা. দীপু মনি হিনা রাব্বানির সঙ্গে একটা ‘কূটনৈতিক দুর্ঘটনায়’ নিপতিত হয়েছেন। পাকিস্তানের গণমাধ্যমও বলেছে, ভারত নয়, আটকে দিল বাংলাদেশ।
সবচেয়ে লক্ষণীয়, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে বন্ধু বাংলাদেশকে ‘ত্যাগ করে’ চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে কালক্ষেপণ করেনি। ২ নভেম্বর পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা ভারতকে বহু প্রতীক্ষিত দ্বিপক্ষীয় বিশেষ বাণিজ্যসুবিধা (এমএফএন মর্যাদা) প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর মধ্যে একটা লেনদেন আঁচ করা যায়। এই আঁচ আমাদের গায়ে লাগছে—এমন এক বাতাবরণে ঢাকা যেন দিল্লির সঙ্গে ‘লেনদেন’ কূটনীতি বিসর্জন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com 
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ১১-১১-২০১১

খালেদার বাড়ি ছাড়া নিয়ে আইনগত নানা প্রশ্ন

বেগম খালেদা জিয়া বেগম খালেদা জিয়া
বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ভিড় করে আছে। বিশেষ করে এর আইনগত দিক নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে।
অনেকের প্রশ্ন, ২৯ নভেম্বরে কী হবে? আসলে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চাওয়া-সংক্রান্ত আবেদন অকার্যকর হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা নতুন করে আবেদন করতে পারেন। তাঁরা বলতে পারেন, বিচারাধীন থাকা অবস্থায় উচ্ছেদ করা হয়েছে। সুতরাং আগের মতো স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো অ্যান্টে) অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর যেমন ছিল, তেমনি অবস্থায় রাখার আদেশ দেওয়া হোক। আপিল আবেদনের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ির কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। আপিল বিভাগ অবশ্য এমন আবেদন নাকচও করতে পারেন।
অন্তত দুজন সাবেক প্রধান বিচারপতি মনে করেন, ১০ নভেম্বর বেগম জিয়ার আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ না চেয়ে বড় ভুল করেছিলেন। তবে সেই কারণে তাঁরা উচ্ছেদ-প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য বলেননি। তাঁরা মনে করেন, হাইকোর্টে সরকার যায়নি, গিয়েছিলেন ইজারাগ্রহীতা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষের মাধ্যমেই আদালত অবমাননার কারণ ঘটত না। আবার অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে স্থগিতাদেশ না থাকলেও আপিল হবে, এমন সম্ভাবনার কথা বলে সুবিধা নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।
তৃতীয় বিকল্প
খালেদা জিয়াকে ২০০০ সালে প্রথম নোটিশ দেওয়া হয়। তখন আইনি লড়াই দেখা যায়নি। ২০০৯-এর ২০ এপ্রিল দ্বিতীয়বার বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ১৬৫ কাঠার সামরিক ভূ-সম্পত্তি ইজারার চুক্তি গোড়া থেকেই বাতিল। আইনের চোখে এর কোনো মূল্য নেই। খালেদা জিয়া এই নোটিশের বিরুদ্ধে রিট করেন। গত ১৩ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ সরকারের দেওয়া নোটিশের বৈধতা সমুন্নত রাখেন। ৮ নভেম্বর খালেদার আইনজীবীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে চেম্বার জজের কাছে যান।
উল্লেখ্য, আপিলের অনুমতির জন্য চেম্বার জজের কাছে কেউ যান না। কারণ চেম্বার জজ তা শুনতে পারেন না। স্থগিতাদেশের আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে চেম্বার জজের সামনে সাধারণত তিনটি বিকল্প থাকে। প্রথমত, তিনি হাইকোর্টের তর্কিত আদেশ স্থগিত করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্থগিত কিংবা প্রত্যাখ্যান কোনোটি না করেও একটি আদেশ দিতে পারেন। আদালতপাড়ায় এর নাম ‘নো অর্ডার’। এটা আবেদনকারীর বিপক্ষে যায়। এর পরোক্ষ অর্থ আবেদন নাকচ হওয়া। তৃতীয় বিকল্প হলো, কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে প্রেরণ করা। ৮ নভেম্বর চেম্বার জজের কাছে ওই আবেদন করার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়। এর আগে একই দিন আপিল বিভাগে পৃথকভাবে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল পেশ করা হয়।
৯ নভেম্বর চেম্বার জজ মো. মোজাম্মেল হোসেন তৃতীয় বিকল্প বেছে নেন। তিনি বিষয়টি ১০ নভেম্বর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ধার্য করেন। ওই দিন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়।
কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় এসেছে যে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেন ওই দিন জোরালোভাবে স্থগিতাদেশ চাননি বা সে রকমের আদেশ পেতে পীড়াপীড়ি করেননি। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের অনেকের মতে, আবেদনকারীদের পক্ষে এটা একটি বিচ্যুতি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, স্থগিতাদেশ চাওয়া হলে আদালতের সামনে কী বিকল্প থাকত? তাঁদের মতে, প্রথমত এ ধরনের অবস্থায় হাইকোর্টের রায় সাধারণত আপিল বিভাগ স্থগিত করেন। এটাই সাধারণ রেওয়াজ। দ্বিতীয়ত, লিভ টু আপিলের শুনানি চলমান থাকলে ধরে নেওয়া হয় যে হাইকোর্টের রায় আপনাআপনি স্থগিত রয়েছে। লক্ষণীয় যে ১০ নভেম্বর সুনির্দিষ্টভাবে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়নি। আবার আপিল বিভাগও তাঁর আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে এ সংক্রান্ত আবেদন নাকচ করেননি। বরং লিভ টু আপিল ও স্থগিতাদেশ-সংক্রান্ত দুটি আবেদনের শুনানি ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি ওই দিন শুনানির শুরুতে জানতে চান, আপনারা কেন চেম্বার জজের কাছে গেলেন? জবাবে টি এইচ খান বলেন, হাইকোর্টের রায়ের একটি পর্যবেক্ষণ এর কারণ। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, আবেদনকারীকে ওই বাড়ি খালি করতে অন্তত ৩০ দিন সময় দিতে হবে। টি এইচ খান ইঙ্গিত দেন, এই ৩০ দিন অতিবাহিত হলে সরকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেন সেদিন স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চকিত হননি, সেটি রহস্যাবৃত। তবে কোনো ‘বিশেষ জরুরি অবস্থার’ উদ্ভব না ঘটলে এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে সরকার ২৯ নভেম্বরের আগে জবরদস্তি পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো অধিকার প্রয়োগ করে না।
উল্লেখ্য, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। বাড়ি খালি করতে অন্তত ৩০ দিন সময় দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মন্তব্যে। তিনি বলেন, ১২ তারিখের পর বাড়ি না ছাড়লে তা হবে আদালত অবমাননা। আইনজ্ঞদের অনেকেই এর সঙ্গে একমত হননি। তাঁরা মনে করেন, সরকার যদি ৩০ দিনের পরেও উচ্ছেদ অভিযানে যেত, তাহলেও আদালত অবমাননা ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হতো না। কারণ হাইকোর্টের রায়ে ৩০ দিনের বেশি সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। আপিল বিভাগও তাতে বাদ সাধেননি। অ্যাটর্নি জেনারেল পরে বলেন, আপিল বিভাগের রায় পক্ষে গেলে খালেদা জিয়া বাড়ি ফিরে পাবেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন তাড়াহুড়োর দরকার কি ছিল?
আবেদন বনাম প্রার্থনা: আপিল বিভাগের ১০ নভেম্বরের আদেশ আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। এর অবিকল তরজমা নিচে দেওয়া হলো: ‘আজ স্থগিতাদেশের জন্য একটি আবেদনসহ লিভ টু আপিলের শুনানি ধার্য আছে। আবেদনকারীর বিজ্ঞ কৌঁসুলি জনাব টি এইচ খান লিভ পিটিশনের শুনানি মুলতবি রাখতে প্রার্থনা করেছেন। এর উত্তরে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব মাহবুবে আলম নিবেদন করেন যে তিনি হাইকোর্টের রায় ও আদেশের কার্যকারিতার ওপর স্থগিতাদেশ চাওয়ার প্রার্থনার বিরোধিতা করছেন। এ সময় আদালত তাঁর নজরে আনেন যে আবেদনকারীর পক্ষে স্থগিতাদেশের কোনো প্রার্থনা করা হয়নি। যা হোক, এ বিষয়টি শুনানির জন্য ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হলো।’
এই আদেশ বিশ্লেষণে দেখা যায়, আদালত লিখিত আবেদন ও মৌখিক প্রার্থনার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। আপিল বিভাগের সামনে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করার লিখিত আবেদন ছিল। কিন্তু টি এইচ খান শুধু লিভ পিটিশনের আবেদন শুনানি মুলতবি করেছেন বলে আদালতের আদেশে দেখা যাচ্ছে। আদালতের প্রচলিত রীতি হলো, লিখিত আবেদনে যা-ই বলা থাকুক, যে বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব, শুনানিকালে সে মতে প্রতিকার চাইতে হবে। সেটা না চাওয়ার কারণে আদালতের হাতে স্থগিতাদেশের আবেদন থাকা সত্ত্বেও লেখা হয়েছে, আবেদনকারী স্থগিতাদেশ চাননি।
আবেদনে কী আছে: ৮ নভেম্বর চেম্বার জজের কাছে প্রথম হাইকোর্টের রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করা হয়। সেই আবেদনটিই অবিকল ১০ নভেম্বরে আপিল বিভাগের সামনে বিচারাধীন ছিল। এতে স্পষ্টতই আবেদনকারীকে অবিলম্বে ৬ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, বাড়ি ছাড়তে ২০০৯ সালের নোটিশের ওপর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৩ অক্টোবরে হাইকোর্ট তাঁর রায় ও আদেশে তা রদ করেন। আবেদনকারী আজ পর্যন্ত সেই বাড়িতে বসবাস করছেন। এখন হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণের সুযোগ নিয়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে বেপরোয়া পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। কারণ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘যা হোক, বিবাদীগণ এই তারিখ থেকে তর্কিত বাড়ি ছাড়তে অন্তত ৩০ দিন সময় দেবেন।’ যদিও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে আবেদনকারীর বিধিবদ্ধ অধিকার রয়েছে। আবেদনকারী এই বাড়িতে গত ২৯ বছর ধরে আছেন, তাই লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রাখা হোক। এখনই যদি হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করা হয়, তাহলে বেগম খালেদা জিয়া অপূরণীয় লোকসান ও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এবং আবেদনকারীর দায়ের করা সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল অর্থহীন হয়ে পড়বে। আর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা হলে বিবাদীদের কোনোভাবেই অধিকারহানি ঘটবে না। সুতরাং ১৩ অক্টোবর দেওয়া হাইকোর্টের রায় আপিলের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখতে সদয় আদেশ দিতে মর্জি হয়।
প্রধান বিচারপতির বাড়িতে: প্রধান বিচারপতির বাড়িতে গিয়ে প্রতিকার প্রার্থনার অধিকার খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ছিল। চার আইনজীবীর নাম উল্লেখ ছিল এমন একটি ‘সনদ’ জারি করা হয়। কিন্তু তাতে সুপ্রিম কোর্ট বারের পদ-পদবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘আইনজীবী সনদের’ বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন করে। বার সভাপতির প্যাডে সই করা ওই সনদে দাবি করা হয়, প্রধান বিচারপতি সুনির্দিষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত উচ্ছেদ ঘটবে না। এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির দপ্তর থেকে একটি ব্যাখ্যা খুবই প্রত্যাশিত।

খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা

বিস্ময়কর তথ্যটি আগেই বলে নিই। গতকালের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর খবর পরিবেশনা দেখে আদালতে কী ঘটে গেছে তা বোঝা যাবে না। এই ঘটনা প্রমাণ দেয় যে আমাদের রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের কোনোটিই দাঁড়ায়নি।
বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও আপিল বিভাগের অপর দুই বিচারক বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। এর প্রায় ২০ ঘণ্টা ব্যবধানে ২৯ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দুই বড় দল সমর্থক আইনজীবীদের উত্তেজনাপূর্ণ উপস্থিতিতে আপিল বিভাগে শুরু হলো সেনানিবাসের বাড়িসংক্রান্ত লিভ টু আপিলসহ চারটি আবেদনের ওপর শুনানি। বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা চাইলেন আগে আপিল বিভাগ অবমাননা মামলার শুনানি হবে। প্রধান বিচারপতি চাইলেন সবই শুনানি হবে। তবে শুরু হোক লিভ পিটিশন শুনানির মধ্য দিয়ে। কোনটি আগে হবে সে বিষয়ে ৯০ মিনিট কেটে গেল। এরপর দেশবাসী জানলেন, উত্থাপন না করায় আপিল বিভাগ বেগম খালেদা জিয়ার লিভ পিটিশন খারিজ করে দিয়েছেন। ২৯ ও ৩০ নভেম্বরের রাতজুড়ে ধুন্দুমার টিভি টক শো হলো। কিন্তু তাতে জনগণ জানলেন না বেগম খালেদা জিয়ার বিস্ময়কর অনাস্থার তথ্য। গতকালের বাংলাদেশের খবরের কাগজগুলোর শিরোনাম দেখে তাঁরা জানলেন না, অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কী করে গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হয়। সত্যি এটা সব সম্ভবের দেশ, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। মানুষ ভাবছে, আদালত অবমাননার শুনানি আগে হলে কী হতো। বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বিলাপ করছেন, তাঁদের আবেদন শোনার কেউ নেই। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল জানাচ্ছেন, ৯০ মিনিট সংলাপ হলো অথচ তাঁরা লিভ পিটিশনের শুনানি শুরু করতে চাইলেন না। এটা আমি কখনো শুনানি। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিস্ময়, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর অনাস্থার বিষয়ে আদালতে কোনো বক্তব্য রাখেনি। প্রতিপক্ষকে বাগে পেয়েও তারা ঘাটাতে যায়নি। নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এটা রাষ্ট্রের ব্যাধি, যা তারা গোপন রাখতে চায়।
তবুও সবচেয়ে বিস্ময়কর আপিল বিভাগের নীরবতা। আমরা এটা কোনোক্রমেই স্বাভাবিক মনে করি না। যত রকমের রীতি বা প্রক্রিয়া বা কেতাগত যুক্তি দেওয়া হোক না কেন, প্রকাশ্য আদালতে এই তথ্য গোপন রাখার অর্থ দেশবাসীকে অন্ধকারে রাখা। কর্মকর্তারা না জানালে আপিল বিভাগের বিচারকেরা কীভাবে জানবেন? এই প্রশ্ন তোলা হলে আমরা তা নাকচ করে দিতে পারি না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এটুকু বলব যে বেগম খালেদা জিয়া কোর্ট ফি দিয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন এবং তা আপিল বিভাগের বিচার শাখা গ্রহণ করেছে, তাই স্রেফ রীতির দোহাই মানা কঠিন। পরে অবশ্য সে সংক্রান্ত হলফনামায় সুপ্রিম কোর্টের খোদ রেজিস্ট্রার আশরাফুল ইসলাম সই দেন, সে কারণে বলি, আদালত তা উপেক্ষা করতে পারেন কি। আমরা মনে করি, আপিল বিভাগ প্রশাসনের কাছ থেকে এই তথ্য এবং সে সংক্রান্ত ব্যাখ্যা জানার অধিকার জনগণের আছে। ২৯ নভেম্বর তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ শুনানি হলো, আর তাতে সব পক্ষ কার্যত নীরবতা পালন করল। যদিও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি গতকাল রাতে বললেন, ‘আমরা এ-সংক্রান্ত আবেদনের প্রতি ওই দিন প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। মওদুদ অনাস্থার আবেদন হাতে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু প্রধান বিচারপতি তাঁকে কথা বলার সুযোগ দেননি।’ বিষয়টিকে আমরা জনস্বার্থ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মনে করি না। কারণ মাঝপথে আচানক অনাস্থা ব্যক্ত করলে খালেদা জিয়ার স্ববিরোধিতা প্রকট হতো। টি এইচ খান ও রফিক উল হক এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। কিন্তু তাঁরা তো অনাস্থার আবেদনে পক্ষ হয়েছেন। তাঁরাই তো মওদুদের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। দেশবাসী তাই জানতে পারল না, মওদুদের আবেদনে কী ছিল। বার সভাপতির কথায়, প্রধান বিচারপতি মওদুদকে অসৌজন্যমূলকভাবে বসিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে বিচারকদের প্রতি অনাস্থার বিষয়টি প্রকাশ্য আদালতে একেবারেই বিবেচনায় না নিয়ে নৈতিকভাবে গতকাল লিভ টু আপিলের শুনানির সুযোগ ছিল। আমি অবাক হতে প্রস্তুত যে ২৯ নভেম্বরের দৈনিক কার্যতালিকায় কী করে ওই দুটি আবেদন একই সঙ্গে না এসে পারল? এর বিষয়বস্তু তো সাদামাটা ছিল না। এর চেয়ে গুরুতর আর কী হতে পারে?
সুতরাং প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী দল এবং রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারীরা ২৯ নভেম্বরে আর যাই হোক, নৈতিকতাপূর্ণ আইনের অনুশীলন করেছিলেন, এটা মানতে বড় বাধে।
এতে বিএনপির ঘোষণামতে ‘আইনি ও রাজনৈতিক মোকাবিলার’ আরেকটি বিচিত্র রূপ আমরা দেখলাম। একই সঙ্গে আমরা রাষ্ট্র ও আদালতের নীরবতার রূপও দেখলাম। তবে জনগণের একটা লাভ হলো। বিচারপতি কে এম হাসান সম্পর্কে আওয়ামী লীগ তার অবস্থান স্পষ্ট করতে দেরি করেছিল। এবার অনেক আগেই স্পষ্ট হলো। তাই ২৮ নভেম্বর এক অর্থে একটি রেড লেটার ডে। কারণ বেগম খালেদা জিয়া এদিন কার্যত লিখিতভাবে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতিও অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন।
বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান যে স্ববিরোধী তা আমরা বেগম জিয়ার হলফনামায় লক্ষ করি। তাঁর সারকথা হচ্ছে, জিয়ার স্ত্রী হিসেবে তিনি ওই বাড়ি পেয়েছিলেন। বিচারপতি খায়রুল হকসহ তিন বিচারপতি জিয়াকে যেহেতু অবৈধ শাসক বলেছিলেন, তাই তাঁদের কাছে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না। তাঁর এই অবস্থান সংগত কি না সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু তাঁর মনে যে এই ছিল তা তিনি আগে প্রকাশ করেননি কেন? কেন তিনি এই বিচারকদের কাছে লিভ চাইলেন? কেন চেম্বার জজের কাছে স্টে চাইলেন? কেন তাঁর আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ছুটে গেলেন? বিচারপ্রার্থী মামলার যেকোনো পর্যায়ে অনাস্থা দিতে পারেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া যে কারণ দেখান, তার উদ্ভব ঘটে অনেক আগেই। তার কেন হঠাৎ মনে পড়ল?
বেগম খালেদা জিয়া তাঁর আবেদনে বলেন, ওই সময় দেশে সংসদ ছিল না। তাই তাঁকে সামরিক আইনের আওতায় দেশ শাসন করতে হয়েছিল। সামরিক আইন জিয়া নয়, মোশতাক জারি করেছিলেন। তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগও হাতছাড়া করেননি। তাঁর যুক্তি: ‘জিয়া শুধু সামরিক ফরমান দিয়ে দেশে গণতন্ত্রই আনেননি, তাঁকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের কথা সংযোজন করতে হয়েছিল।’ শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী’ এ রকম দাবি কবে, কোথায় করেছিল?
বেগম খালেদা জিয়া বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায় মূল্যায়ন করেন। তাঁর ভাষায়, হাইকোর্টের রায়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে একজন জবরদখলকারী হিসেবে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান জনগণের কল্যাণে যা কিছুই করেছেন, তা ভ্রান্ত ও অবৈধ। অথচ এই বক্তব্য অসত্য। কারণ বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ ব্যতিরেকে জিয়ার আর সব কর্মকাণ্ডই জনশৃঙ্খলার স্বার্থে মার্জনা করেছিলেন। তবুও বেগম খালেদা জিয়া তাঁর স্বামী-সম্পর্কিত মন্তব্যের কারণেই ‘স্বার্থের সংঘাত’ দেখলেন। জিয়া থেকে বাড়ি। তাই জিয়ার নিন্দা মানে খালেদার বাড়ির নিন্দা।
২৮ নভেম্বর একই দিনে আমরা খালেদা জিয়াকে দুটি আলাদা আবেদন দাখিল করতে দেখি। এই দুটি নিয়ে আপিল বিভাগে তাঁর আবেদন দাঁড়িয়েছিল অর্ধ ডজন। অনাস্থা ছাড়া তিনি পৃথক একটি আবেদনে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিলের মুলতবি চান। মনে হতে পারে আপিল বিভাগে বিএনপির পুরো অবস্থানটাই ছিল অধিকতর রাজনৈতিক। বেগম খালেদা জিয়া পরিচ্ছন্ন হাতে আপিল বিভাগে এসেছিলেন, আমরা তার প্রমাণ পাই না।
গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলাম। জানতে পারি যে আপিল বিভাগ ২৯ নভেম্বর দেওয়া পূর্ণাঙ্গ লিখিত আদেশ চূড়ান্ত করার কাজ করছেন। এর ঘষামাজা চলছে। অনাস্থা জ্ঞাপনের আবেদনটি আপিল বিভাগের বিচার শাখা গ্রহণ করেছে ২৮ নভেম্বর দুইটা ৩৫ মিনিটে। এ জন্য সোনালী ব্যাংকে নগদ দুই হাজার টাকার ফি জমা পড়েছে। শুনলাম তাঁর এই আবেদন আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার বাড়িসংক্রান্ত মামলার নথিভুক্ত হয়নি গতকালও। এমনকি এই আবেদন বিজ্ঞ বিচারপতিদের কাছে পৌঁছেছে—এমনটাও নাকি দালিলিকভাবে বলা যাবে না। সিভিল পিটিশন মুলতবি করার আবেদনটি দাখিল করা হয় ২৮ নভেম্বর। তবে দুটি আবেদনই ডায়েরিভুক্ত হয় একদিন পর ২৯ নভেম্বর। অনাস্থা জ্ঞাপন আবেদনের ডায়েরি নম্বর ১৯২৯। মুলতবি করার আবেদনের ডায়েরি নম্বর ১৯২৮।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ২৯ নভেম্বরের শুনানিকালে যখন বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ন্যায়বিচারের কথা বলছিলেন, তখন যদি বলা হতো যে আমাদের ওপর আপনাদের তো আস্থা নেই, তা হলে কেন এসেছেন? এর জবাব কী হতো তা জানা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। হয়তো এ রকম একটি বাক্যে আদালতের উত্তেজনাকর হইচইপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা এড়ানো সম্ভব হতো। মুখোশটা খসে পড়ত।
বেগম খালেদা জিয়া অনাস্থা কেন দিলেন? সেটা কতটা রাজনৈতিক, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, ভিন্ন বিতর্ক। তবে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো আপিল বিভাগের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনও করলেন, আর পুরো জাতি জানল যে আমাদের আপিল বিভাগ বেগম জিয়ার আবেদন শুনতে চাননি। এখানে কার লাভ হলো। আমাদের মতে, এই ঘটনায় উভয় পক্ষের রাজনীতি জয়যুক্ত হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর ওই দুটি আবেদনের কথা জানত না, সেটা মানা যায় না। আপিল বিভাগ প্রশাসন জানতেন না, সেটাও মানা যায় না। সুতরাং যে বিষয় নিয়ে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও হরতালের কর্মসূচি রয়েছে, যেখানে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করা হয়েছে; সে রকম একটি বিষয় বিচার প্রশাসন প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেননি, তা স্বাভাবিক মনে হয় না। গতকাল ৩০ নভেম্বরে আদালত অবমাননাসংক্রান্ত শুনানির দিন ধার্য ছিল। এর অবশ্য কোনো শুনানি হয়নি। তা হলে কি ভবিষ্যতে কোনো দিন বিএনপি যখন ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার’ উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পাবে, তখন তারা এই আবেদন দুটিকে সামনে আনবে?
আসলে পুরো বিষয়টি বিচার বিভাগের ভঙ্গুরত্ব প্রমাণ করে। এত বড় একটা পরিহাস ধারণ করা সত্যি কঠিন যে বেগম খালেদা জিয়া হাইকোর্টের রায় অমান্য করে সারা দেশের বারে বিক্ষোভ দেখানোর কর্মসূচি পালন করলেন। সুুপ্রিমকোর্ট আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁকে বিব্রত করেননি। পুনর্বার বেগম খালেদা জিয়া আপিল বিভাগকে অনাস্থায় রেখে আপিল বিভাগ অবমাননা করার জন্য প্রতিকার চাইলেন। তারও কোনো বিহিত হলো না। উভয় ক্ষেত্রে আদালতের এই আপসে আমরা এই রাষ্ট্রের নির্বাহীর সঙ্গে বিচার বিভাগের চিরন্তন আপসের প্রতিফলন দেখি। আদালত নির্বাহী বিভাগকে বিব্রত করেন না। কারণ আদালত নিজেদের বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। আপসের এই চোরাগলিতে এই রাষ্ট্রের নৈতিকতা ও আইনের শাসন মার খেয়ে চলেছে।
সামরিক শাসনকে অবৈধ বলার বিষয়টি নতুন কোনো উদ্ভাবন ছিল না। তবে বাহাত্তরের সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদকে সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে পুনরুজ্জীবিত করেছেন, সেটা নিয়ে একটা জোরালো বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক আছে এবং থাকবে। কিন্তু এটাও সত্য যে মোশতাক, সায়েম ও জিয়াকে ‘জবরদখলকারী’ হিসেবে উল্লেখ শুধু বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহা করেননি। আরো অনেক বিজ্ঞ বিচারকরা করেছেন।
হাইকোর্টের দেওয়া সেনাশাসনবিরোধী রায় আপিল বিভাগ কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথার্থই সমুন্নত রেখেছেন। যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম এবং ছুটিতে থাকা বিচারপতি আবদুল মতিনকে আমরা কখনো আওয়ামীপন্থী হিসেবে বলাবলি করতে শুনি না। বরং তাঁদের কখনো বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। বিচারপতি টি ইসলাম আইনজীবী থাকাকালে জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী হিসেবে একাধিক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। বিচারপতি মতিনকে ‘আপন’ মনে করতে না পারায় তাঁকে ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েও প্রধান বিচারপতি করা হলো না। এই দুজনই কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হকের সামরিক শাসনবিরোধী রায় সমর্থন করেছেন।
বেগম খালেদা জিয়া আসলে একটি বাড়ি রক্ষা করতে গিয়ে নতুন করে পুরোনো ক্ষত উন্মোচন করলেন। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির স্ববিরোধিতা ও অসাধুতার প্রলেপ এখনো অত্যন্ত প্রকট। অনেক বুদ্ধিজীবী জিয়াকে ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহি-জনতার বিদ্রোহ’ থেকে উঠে আসা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতে চান। আমরা তাঁদের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তাঁদের স্পষ্ট করা দরকার যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ের কর্মকাণ্ডের বৈধতা কিংবা অবৈধতার দায় তাঁরা কতটা কীভাবে নেবেন কিংবা নেবেন না। সেনানিবাসের বাড়ির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার অনাস্থাকে আমরা শুধু ‘তিন বিচারপতির ব্যক্তিগত বিষয়’ হিসেবে দেখতে পারলে কিছুটা আশ্বস্ত হতাম। কিন্তু তিনি তো আদালতে হলফনামা দিয়ে ইতিহাসের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলেন। শুধু জিয়াকে নয়, তিনি মোশতাক ও সায়েমকে অবৈধ বলাও মানতে পারেননি।
রাষ্ট্রপক্ষ এবং আদালত বেগম খালেদা জিয়ার এই অবস্থানকে সামনে আনলে দেশের জনগণ পক্ষ-বিপক্ষ চিনতে পারবে। প্রকৃত ইস্যু বুঝতে পারবে। আদালত অবমাননার আবেদনের একতরফা নিষ্পত্তি হতে পারে। সেই আদেশে আমরা এর প্রতিফলন আশা করব। ২৯ নভেম্বর লিভ পিটিশন খারিজসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যেও আমরা বেগম জিয়ার অনাস্থার বিষয়টির উল্লেখ আশা করব। দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙ্গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি করার পর বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, বিএনপি তাঁর অধীনে নির্বাচনে যাবে না। বেগম খালেদা জিয়ার হলফনামা সেই সত্যই বহন করে। তবে অমায়িক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান একটি ‘না’ উচ্চারণ করতে অনেক বিলম্ব করেছিলেন। সংবিধান সংশোধন করে বয়স বাড়ানোর পর পরই যখন বিতর্ক ওঠে তখনই তিনি ‘না’ বলতে পারতেন। আমরা আশা করব, প্রধান বিচারপতি এখনই এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করবেন। প্রধান বিচারপতির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা ঝুলিয়ে রাখার বোঝা সুপ্রিম কোর্ট আর বহন করতে পারছে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
০১-১২-২০১০

ব্রিটিশ মন্ত্রী কেন বাংলাদেশ হাইকমিশনে

ফেয়ারহ্যাম থেকে শ্রীমঙ্গল। দুই সাংসদের গল্প। ব্রিটেনের ফেয়ারহ্যামের এমপি মার্ক হোবান। তিনি আবার ব্রিটিশ মন্ত্রী (অর্থ মন্ত্রণালয়ের চার জুনিয়র মন্ত্রীর অন্যতম, যাঁর পদবি ফিন্যান্সিয়াল সেক্রেটারি)। শ্রীমঙ্গলের এমপি আব্দুস শহীদ। তিনি আমাদের সরকারদলীয় চিফ হুইপ। দুই এলাকার কতিপয় ভোটার প্রায় তিন মিলিয়ন পাউন্ডের একটি কথিত আত্মসাৎপ্রতারণার ঘটনার পক্ষবিপক্ষ। কোনো এমপির কাজ নয় কারটাকা উদ্ধার করে দেয়ার। হোবানশহীদ কারতা অজানা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেদুই সাংসদের মধ্যে আমরা একটি আকাশ পাতাল তফাত লক্ষ করতে পারি।
যুবকের নাম গোলাম রাশেদ চৌধুরীরফে হিমন (২৬)। তাঁর স্ত্রী ফরিদা। গত বছরের মাঝামাঝি লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনেনই দম্পতির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে লন্ডনের আদালতে মামলা হয়েছে। আগামী মাসে জুরিরা বসবেন এর বিচারে।ই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা জামিনে আছেন।
নাজমুর রহমানরফে শানামুহাম্মদ আলী সৈয়দরফে দুলন। তাঁদের দাবি হিমনকে তাঁরা দেড় কোটি টাকা দেন সিলেটে চা-বাগান কেনা হবে বলে। হিমনের বাবা ইকবাল চৌধুরী একটি চা-বাগানে চাকরি করতেন। গতকাল লন্ডন থেকে দুলন ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা আব্দুস শহীদের হস্তক্ষেপ চেয়েছি ১৪ মাস আগেই। কারণ হিমন লন্ডনে থাকলেআমাদের কাছে প্রমাণ আছে, তাঁর বাবার কাছে প্রায় এক মিলিয়ন পাউন্ড গচ্ছিত আছে।’
হ্যাম্পশায়ারের পুলিশ বাহিনীর চিফ কনস্টেবল অ্যালেক্স মার্শাল শানাকে চিঠি লিখেছেন ৯ আগস্ট ২০১০। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, কীভাবে আপনি টাকা পরিশোধ করলেন? বাংলাদেশি নোটে না ব্রিটিশ পাউন্ডে? ১৬ আগস্ট ২০১০ শানার উত্তর: ‘সিলেটে একটি চা-বাগান কেনার জন্য আমি এবং আমার বন্ধু সৈয়দ ৯০ হাজার ৬০০ পাউন্ড প্রদান করেছি, বাংলাদেশি টাকায় যা ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এই দম্পতি আমাকে বলেছেন, সিলেটে চা-বাগান কেনার পরে একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হবে এবং অর্থের পরিমাণের অনুপাতে আমাদেরকেই কোম্পানির শেয়ার দেয়া হবে।’
গত সোমবার শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শেখ লুৎফর রহমান ফোনে জানালেন, সালিস বৈঠক ডাকা হয়েছিল, কিন্তু সুরাহা হয়নি। কারণ হিমনের বাবা ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, এটা লন্ডনের বিষয়। তাঁর কোনো হাত নেই। এটা গত ৫ মার্চ ২০১০-এর কথা।
গতকাল অপরাহ্নে আমি হিমনের বাবার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে ফোনে আলাপ করি। তিনি সমিতিকে যা বলছিলেন, আমাকেতা-ই বললেন। তাঁর দাবি, ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। হঠাৎ কখনো ফোন করে। তবে কথা শেষ না হতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথম আলোর শ্রীমঙ্গল সংবাদদাতা বিশ্বজ্যোতি চৌধুরীকে তাঁর শুশ্রূষা করতে হয়।
হাউজিং এস্টেট মৌলভীবাজারে ইকবাল চৌধুরীর টিনশেড বাড়ি। ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রথম আলোর সংবাদদাতাকে গতকাল বলেন, শ্বশুরবাড়িতে যে জমি পেয়েছিলেন, সম্প্রতি তা বিক্রি করেছেন। একটা গাড়ি ছিল, তা-বেচতে হয়েছে। এই অবস্থা অবশ্য মানতে নারাজ দুলন। তাঁর দাবি, ‘এসব লোক দেখানো।’ প্রমাণ থাকলে বাংলাদেশেতো মামলা করতে পারেন, আমার এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর: সে জন্যই আমরা সাংসদ আব্দুস শহীদের সম্মতিসহযোগিতা চাইছি। এটা দরকারি। তাঁর ইঙ্গিত ভিন্ন। তবে তাঁদের অভিযোগ সত্য কি না, সেটা বিচার করতে আমরা বসিনি। মার্ক হোবান যে এলাকার সাংসদ, সেখানে অভিযুক্ত হিমন দম্পতিরবাস।
জনপ্রতিনিধির সংবেদনশীলতা কেমন হতে পারে, তার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মার্ক হোবান। তাঁর কাছে মামুলি নালিশ করেছিলেন ভুক্তভোগী হিসেবে পরিচিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। চা-বাগান কেনা শুধু দুজনের বিষয়। আরশতাধিক লোকের টাকা মারার অভিযোগ হিমনের বিরুদ্ধে। হোবান আমাদের চিফ হুইপের কাছ থেকে একটি পত্র পেতে প্রথম হাইকমিশনকে চিঠি লেখেন গত বছরের নভেম্বরে। এরপর গত ৮ জুন হাউস অব কমন্সের প্যাডে মার্ক হোবান শানাকে লিখেছেন, ‘নভেম্বর ২০১০ সালে দেয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আবারলিখছি যে, আমি আপনার উদ্বেগের বিষয়টি হ্যাম্পশায়ারের পুলিশ বাহিনীকে জানিয়েছি। আপনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান খানকে চিঠি লিখেছি। আপনার বন্ধু দুলন ৭ জুলাই ২০১০ সালে দেয়া চিঠির কপি দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলের সাংসদ আব্দুস শহীদকে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আব্দুস শহীদ আপনার দরখাস্ত পেয়েছেন কি না। এবং আপনাদের টাকা উদ্ধারে তিনি কী করেছেন।’
মার্ক হোবানের এই চিঠি যদি সত্যিই তাঁর লেখা হয়, তাহলে একটি তদন্ত অবশ্যই হতে হবে। কারণ, ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ভুল করেযদি একটি বিষয়ের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেন, তাহলে সে বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এই নীরবতা অমার্জনীয়। মার্ক হোবানের আকুতি: ‘বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে অব্যাহতভাবে যোগাযোগ করা সত্ত্বেআমার অফিস বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে কোনো সাড়া পেতে ব্যর্থ হয়েছে। নভেম্বরের পর আমি ডিসেম্বরেচিঠি লিখি। কিন্তু তা গোল্লায় গেছে। আমার স্টাফরা গত জানুয়ারিএপ্রিলে আমার মূল চিঠির উত্তর পেতে বহুবার ফোন করেসাড়া পাননি। গত এপ্রিলে আমার কেসয়ার্কার পিটার কারস বাংলাদেশ হাইকমিশনের কল্যাণ দপ্তরের মাহফুজ হাসানের সঙ্গে কথা বলেন। মাহফুজ আশ্বস্ত করেন, গত নভেম্বরডিসেম্বরে দেয়া আমার চিঠির জবাব কেন মেলেনি, তা খতিয়ে দেখা হবে। এরপর ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর পায়া যায়নি। আমি এই সপ্তাহে আবারহাইকমিশনারকে চিঠি লিখেছি আমার মূল চিঠির জবাব পাইনি বলে। আমি তাঁকে ৮ জুলাইয়ের মধ্যে লিখিত উত্তর জানাতে অনুরোধ জানিয়েছি। আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, উত্তর না পায়া পর্যন্ত আমার এই চেষ্টা আমি চালিয়ে যাব।’
ব্রিটিশ মন্ত্রীর লেখা আরএকটি চিঠি আমাদের কাছে আছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি লিখেছেন, ‘আব্দুস শহীদ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তা জানতে আমি আবারচিঠি লিখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত হাইকমিশনার জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, আপনি এবং অন্য ক্ষতিগ্রস্তরা ইংল্যান্ড কিংবা বাংলাদেশের আদালতে প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন। তাঁর মতে এটাই হলো ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ প্রশমনের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। উপরন্তু আমি বুঝতে পারি, বাংলাদেশের হাইকমিশনার এখন পর্যন্ত আপনাদের উদ্বেগের বিষয়ে আব্দুস শহীদ এমপির সহযোগিতা পেতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’
সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে, মার্ক হোবান এ রকমের একটি অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে সশরীরে এসেছেন এবং তা আমাদের হাইকমিশনারের বেঁধে দেয়া সময়ে। এই বৈঠক ২০ অক্টোবর দুপুর ১২টায় হাইকমিশনে অনুষ্ঠিত হয়। হাইকমিশনার তখন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, আমি পোস্টবক্স মাত্র।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আব্দুস শহীদের সঙ্গে বিটিআরআই রেস্ট হাউসে সাক্ষাৎ করেছিলেন দুলন। তখন মৌলভীবাজারের ডিসিসহ স্থানীয় কর্মকর্তানেতারা উপস্থিত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান খান মার্ক হোবানকে লিখেছেন, ‘আপনার চিঠি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে চিফ হুইপকে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম তাঁর তরফে জবাব আসবে। কিন্তু আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি।’
গতকাল এ বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে হাউস অব কমন্সের সঙ্গে চিফ হুইপের ঘনিষ্ঠতার বিবরণ পেলাম। গত বছর ঢাকায় এসেছিলেনয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মিস মেরিনা। তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ খোয়া যায়। বাংলাদেশের পুলিশকে দিয়ে তাঁর হারিয়ে যায়া ১২০০ পাউন্ড উদ্ধার করিয়েছিলেন। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন আব্দুস শহীদবিরোধী দলে। লন্ডনে তাঁরা একটি সভায় যৌথভাবে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর উত্তরে এটা স্পষ্ট হয়েঠে, চিফ হুইপের দপ্তর করিৎকর্মা। সব মিলিয়ে এটা সন্দেহাতীত যে, হাউস অব কমন্সের একজন সদস্য বাংলাদেশ সংসদের একজন সদস্যের মধ্যে যোগাযোগ করতে চাইছেন। আর তিনি তা পারছেন না—এটা বাংলাদেশের জন্য কতটা অমর্যাদাকরপীড়াদায়ক, সে কথা আর যাকেই হোক আব্দুস শহীদকে বুঝিয়ে বলার কোনো দরকার নেই।
কিন্তু মুশকিল হলো, তিনি নিশ্চিত করেন, মার্ক হোবানের কাছ থেকে কোনো পত্র পাননি। জানতে চাইলাম, বাংলাদেশ হাইকমিশন কি তাহলে আমাদের ডোবাল? আপনাকেডোবাল? ফোন রাখার আগে তিনি বললেন, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
আমাদের চিফ হুইপের অফিস যে দক্ষ, তার প্রমাণ গতকাল সন্ধ্যার আগেই পেয়েছি। আব্দুস শহীদের ফোনালাপ শেষের ঘণ্টা না পেরোতেই তাঁর একান্ত সচিবের ফোন পাই। তিনি ২০১০ সালের জুলাইয়ের চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেন। বলেন, শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী সমিতির সালিস বৈঠক ছিল তাঁরই উদ্যোগের ফসল। তাহলে প্রশ্ন, তাঁর এই মহতী প্রয়াস কেন এত দিনে মার্ক হোবানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো হলো না? একান্ত সচিব আরএকটি তথ্য দিলেন। আমরা বিস্ময়ে তাজ্জব বনে গেলাম। লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে এই একটু আগেই (গতকালের অপরাহ্ন) ফ্যাক্স বার্তা এসেছে। অল্প সময়ের মধ্যে তার একটি কপি ফ্যাক্সে প্রথম আলোতেপৌঁছাল। ব্রিটিশ মন্ত্রীর প্রথম চিঠি লেখার ১১ মাস এবং তার বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘুরে যায়ার চার দিন পরে হাইকমিশনার চিফ হুইপের কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছেন। তাতে লেখা, ‘বাংলাদেশব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি ব্রিটিশ মন্ত্রীর রয়েছে বিশাল শুভেচ্ছা। তিনি “একজন সাংসদ হয়ে আপনার কাছে এ বিষয়ে সহমর্মিতা” আশা করছেন। দয়া করে তাঁর অনুরোধের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে আমি আপনার প্রতি আহ্বান জানাই।’ এরপর আমরা আর মন্তব্য করতে চাই না।

 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

পঞ্চদশ সংশোধনী আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য

পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কারণ, এর মাধ্যমে শুধু সংসদের সার্বভৌমত্ব নয়, সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ-ক্ষমতাও প্রকারান্তরে সীমিত করা হয়েছে। আড়াই বছর ধরে আমাদের যেসব কথা শুনে কান ঝালাপালা হয়েছে তা হলো, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের অযোগ্য। সামরিক শাসকেরা মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করেছেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তা উদ্ধার করেছেন। কিন্তু বাস্তবে জনগণকে আবারও বিরাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর সংবিধান তৈরির ইতিহাসে যা হয়তো কেউ কখনো কল্পনা করেনি, সামরিক শাসকেরাও করেননি, বর্তমান সংসদ ঠিক সেই কাণ্ড করেছে। তারা পাইকারি হারে সংবিধানের ৫০টির বেশি অনুচ্ছেদকে চিরকালের জন্য ‘সংশোধনের অযোগ্য’ ঘোষণা করেছে। এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে দুনিয়ার সংবিধানবিষয়ক পণ্ডিতেরা হয়তো হাসাহাসির সুযোগ পাবেন।
মৌলিক কাঠামো ভারতীয় বিচারকদের বহুল ব্যবহূত একটি ডকট্রিন। তবে কোন বিষয়গুলো মৌলিক কাঠামো, সে বিষয়ে তাঁরা কখনো একমত হতে পারেননি। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট অষ্টম সংশোধনীতে তা প্রথম অনুসরণ করেন; কিন্তু তাঁরাও যথারীতি একমত হতে পারেননি। এটা সম্ভবত একমত হওয়ার বিষয়ও নয়। অষ্টম সংশোধনীতে মৌলিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি দ্বাদশ সংশোধনীতে পাল্টে সংসদীয় পদ্ধতি হয়ে যায়। বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সংবিধানের ২১ অনন্য বৈশিষ্ট্যের তালিকা তৈরি করেন। নির্দিষ্ট না করে তিনি তাঁর রায়ে বলেছিলেন, এর মধ্যে ‘কতিপয়’ সংশোধনের অযোগ্য। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আটটি মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করেছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে তা গুরুত্বহীন। আর বিচারপতি এ টি এম আফজাল তো এর পুরোপুরি বিরোধী।
৫০-এর চিরযৌবন প্রাপ্তি: পঞ্চম সংশোধনীতে জিয়াউর রহমান তাঁর পছন্দের মাত্র চারটি অনুচ্ছেদ রক্ষা করতে গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ গণভোট বাতিল করে। কিন্তু জিয়ার কৌশলটা ঠিকই নেয়। প্রথমবারের মতো সংবিধানের প্রায় ৫০টি অনুচ্ছেদকে তারা চিরকালের জন্য ‘সংশোধনের অযোগ্য’ করেছে। তবে জিয়া ও এরশাদ যা করেননি, আওয়ামী লীগ তা-ই করল। বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মকে তারা অনন্তকালের জন্য সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
সংবিধানের নতুন ৭খ অনুচ্ছেদ বলেছে, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য। ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ১১টি আছে], দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ১৮টি আছে], নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ২৩টি আছে] এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’ কেন এই বিধান? এর সঙ্গে কি তাহলে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কোনো সম্পর্ক আছে? এর উত্তর হলো, না। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বাগাড়ম্বর রাজনীতির সম্পর্ক আছে। বিসমিল্লাহ, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম, জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতার প্রতিকৃতি, সাতই মার্চের ভাষণ—এ ধরনের যা আছে, তার সবটাই ‘সংশোধনের অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিধানের জন্য হয়তো রক্ষাকবচের দরকার ছিল।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংসদে বিল পাসের আগমুহূর্তে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ‘কেশবানন্দ ভারতী মামলা’র দোহাই দেন। ১৯৭৩ সালের এই মামলাতেই ভারত প্রথম ‘ডকট্রিন অব বেসিক স্ট্রাকচার’ প্রয়োগ করে। আইনমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ইন্দিরা গান্ধী আদালতের রিভিউ-ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। কিন্তু এই মামলায় সেই সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হয়। কথা সত্য। কিন্তু আইনমন্ত্রী ও তাঁর সরকার এখন যে কাণ্ড করলেন, তা ইন্দিরাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম, অর্থাৎ গাছের ও তলার দুটোই চাই। তাই ওই দুটোকে একসঙ্গে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো করা হয়েছে। প্রকারান্তরে আইনমন্ত্রী নিজেই কৌশলে আদালতের রিভিউ-ক্ষমতা হরণে ব্রতী হলেন। কেশাবানন্দ মামলার রায়মতেই তাই নতুন সংশোধনী বাতিলযোগ্য কি না, তা যাচাইযোগ্য মনে করি।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে ওই কেশবানন্দে দেওয়া ভারতের প্রধান বিচারপতি এস এম সিক্রি বর্ণিত পাঁচটি মৌলিক কাঠামোর উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও গণতন্ত্রী সরকার, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণ এবং সংবিধানের ফেডারেল চরিত্র। এই মামলার বিচারকসংখ্যা যে ১৩, বিল পাসের দিন আইনমন্ত্রী সেটাও শুনিয়েছেন। কিন্তু তিনি আংশিক বলেছেন। পুরো গল্প হলো, মৌলিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ওই ১৩ জন রায় প্রদানে একমত হননি। তাঁরা বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন (৯: ৪)। এমনকি মৌলিক কাঠামোর তালিকা তৈরিতেও তাঁরা একমত হতে পারেননি। বিচারপতি শিলাত ও গ্রোভার ওই পাঁচটি ছাড়াও জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা, মৌলিক অধিকারভাগে বর্ণিত ব্যক্তির মর্যাদা, কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগের ম্যান্ডেটকে ‘সাংবিধানিক কাঠামোর মূল উপাদান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। অন্যদিকে বিচারপতি ওয়াই বি চন্দ্রচুঁড় (পরে প্রধান বিচারপতি) শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক কাঠামো বলেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি লেখেন, রাষ্ট্রের একটি বেসিক পিলার হচ্ছে, The State shall have no religion of its own (রাষ্ট্রের নিজের কোনো ধর্ম থাকবে না)। সরকার হয়তো জনগণকে বোকাই ভাবে, না হলে আইনমন্ত্রী একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম আখ্যা দিয়ে কোন মুখে সংসদে দাঁড়িয়ে কেশবানন্দ মামলা ও তাঁর ১৩ বিচারকের ঐতিহাসিক রায়টির কথা মুখে আনেন?
সবচেয়ে লক্ষণীয়, বিচারপতি খায়রুল হকও তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন যে, These cannot be catalogued but can only be illustrated। অর্থাৎ মৌলিক কাঠামোর তালিকা করা চলে না। এটা শুধু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অথচ আইনমন্ত্রী এর দোহাই দিয়ে জাতিকে ৫০+ মৌলিক কাঠামোর একটি দীর্ঘতম তালিকা উপহার দিয়েছেন। এটা শতাব্দীর রসিকতা।
সংবিধান বলেছে, ৫০টি অনুচ্ছেদে ‘সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।’ ‘অন্য কোন পন্থায়’ বলে কি তাঁরা আদালতকেও বাঁধেননি? উপরন্তু তাঁরা ওই ৫০টির বাইরেও অনির্দিষ্টসংখ্যক ‘সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো’ আবিষ্কার করেছেন। এমনকি ৭খ অনুচ্ছেদটিকেও মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করে এটিও সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, সংবিধানের অর্ধশতাধিক অনুচ্ছেদ চির অযোগ্য ঘোষণার চেয়ে জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত গণভোট প্রথা ছিল অধিকতর গ্রহণযোগ্য। জিয়াকে গালি দিতে দিতে তাঁর বহু কিছু নতুন করে ধারণ করেছে পঞ্চদশ সংশোধনী। তাই সামরিক ফরমানের গন্ধ মুছতে গণভোট মুছে দেওয়ার নীতি কপটতা। আওয়ামী লীগ হাস্যকরভাবে ভবিষ্যতের দুয়ারে তালা মেরেছে কিংবা ঘড়ির কাঁটা বন্ধ করেছে।
বিল পাসের সকালে বিশেষ কমিটির দুজন সদস্যকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তাঁরা দ্রুত একমত হন যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হতে পারে না। তাঁরা দুজনেই জানেন যে সংবিধানেই লেখা আছে, মূলনীতিগুলো আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রদ্রোহ ও দণ্ডবিধি: এবার আসুন দেখি, অবৈধ ক্ষমতা বন্ধে কী করা হয়েছে। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদকে ঘাড়ে রেখে ভবিষ্যতের এরশাদ মার্কা ব্যক্তিদের বিচারে ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’ নিশ্চিত করেছে সরকার। কিন্তু তাতেও গোঁজামিল। সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে কার্যত ‘নতুন অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আপিল বিভাগের নির্দেশনা ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর সংবিধান দেখে ৭ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ওই সব দেশ এমন অপরাধকে ‘হাইট্রিজন’ বা ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেছে। রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান। সেখানে আমাদের দণ্ডবিধির ১২৪ক আছে। পাকিস্তান তাই হাইট্রিজনকে সেডিশনের চেয়ে গুরুতর অপরাধ সংজ্ঞায়িত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অবশ্য এই বিধান বুটের তলায় রেখে ভুট্টোকে ফাঁসি দিতে জিয়াউল হককে বেগ পেতে হয়নি।
সংসদে পেশ করা বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে ৭ক অনুচ্ছেদে ‘সংসদের আইন দ্বারা’ কথাটি ছিল। কিন্তু বিলে তা তুলে ‘প্রচলিত আইনে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ক্ষমতা জবরদখল ‘নতুন অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হলো না। এখন এক দেশে একই নামের অপরাধের দুই রকম সংজ্ঞা ও দুই ধরনের শাস্তি বহাল হলো। দণ্ডবিধির রাষ্ট্রদ্রোহ আর সংবিধানের রাষ্ট্রদ্রোহ এখন যে এক নয়, এটাও একটা কৌতুকপ্রদ ঘটনা।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষে বলা আছে, ‘সেডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহ হলো সাধারণ মানুষকে দাঙ্গা, হাঙ্গামা বা গণ-অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করিতে পারে এরূপ কথা বলা বা লেখা। দণ্ডবিধি ১২৪(ক) ধারা অনুসারে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারকে, যেকোনো প্রণালীতে রাষ্ট্রপতি বা সরকারের যেকোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার জন্য বা প্রয়োগ করা হইতে বিরত করিবার জন্য প্রলুব্ধ বা বাধ্য করিবার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতিকে বা সরকারকে আক্রমণ করেন বা অবৈধভাবে বাধা প্রদান করেন কিংবা অবৈধভাবে বাধাদানের উদ্যোগ করেন, অথবা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগের ভান করিয়া ভয়াভিভূত করিবার উদ্যোগ করেন, সে ব্যক্তি ৭ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
এখন সংবিধানের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ ধরন ও সংজ্ঞা দণ্ডবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। একই দেশে দুই রকম ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ আইন ও বিচার চলতে পারে কি? সর্বোচ্চ শাস্তির অর্থ নিয়েও দুই রকম মত পাওয়া গেছে। বিল পাসের পরপরই প্রশ্নের জবাবে বিশেষ কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বলেন, ‘সর্বোচ্চ দণ্ডের অর্থ হলো মৃত্যুদণ্ড।’ কিন্তু বিশেষ কমিটির অপর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বললেন, ‘এটা দণ্ডবিধির আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা বুঝতে হবে।’ এই ব্যাখ্যা সঠিক হলে অবৈধ ক্ষমতা দখলের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মাত্র সাত বছর। আর যদি মৃত্যুদণ্ড বোঝায়, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াবে—এই রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার হবে কোন আইনের আওতায়। সংশয় এখানেই শেষ নয়।
পাকিস্তানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদটির অবিকল হলো ৭ক অনুচ্ছেদের প্রথম দফা। এরপর আর কোনো কথা থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই ৭ক-তে দ্বিতীয় দফা কেন যুক্ত করা হলো। এতে বলা আছে, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে।’ এ ধরনের বিধান অন্যত্র নেই। নাগরিকের আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে টানাটানির কারণ এমনও হতে পারে, সংবিধানে যা নতুন ঢোকানো হয়েছে এর নিন্দুকদের ভয় দেখানোর জন্য। বিশেষ কমিটির সদস্যরা এর আগে আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর কথা আমাদের শুনিয়েছিলেন। কিন্তু নকল করার সময় পাকিস্তানকে অনুসরণ করেন। অথচ আর্জেন্টিনার সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদটি অধিকতর সুরক্ষিত। এর কথা হলো, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা সংবিধান স্থগিত করলেও তা কার্যকর হবে না; সংবিধান বহাল থাকবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহতভাবে টিকে থাকবে। তাঁদের অবৈধ কর্ম চিরকালের জন্য বাতিল বলে গণ্য হবে। তাঁরা কখনোই কোনো পাবলিক অফিস ভোগ করতে পারবেন না, চিরকালের জন্য ক্ষমার অযোগ্য থাকবেন। ৩৬(৪) অনুচ্ছেদ এ-ও বলেছে, জবরদখলকারী শক্তির বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার অধিকার থাকবে।
আমরা দেখলাম, বড় বড় কথা বলে আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে একটা অস্পষ্ট ও গোঁজামিলের বিধান জুড়ে দিল। তবে আপাতত আমাদের বড় আগ্রহের বিষয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর নামে মৌলিক কাঠামো হরণ-প্রক্রিয়ার বৈধতার প্রশ্নটি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুমীমাংসিত মৌলিক কাঠামো এবারও সংবিধানে সৃষ্টি করা হলো না। আইনমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’কেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আমরা তার স্বীকৃতি পেলাম না। পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ-ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াসটি অবশ্য রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত রিটের শুনানিতে যাচাইযোগ্য। ড. কামাল হোসেনকে সবটা খুলে বললাম। তিনি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জুলাইয়ে আদালতে যাবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে তাঁর একটি প্রশ্ন দিয়েই আজকের লেখাটি শেষ করি।
ড. কামাল হোসেনের প্রশ্নটি এ রকম: ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেবে না। ২ক অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। একসঙ্গে এই দুটি বিষয় কী করে মৌলিক কাঠামো হতে পারে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

বুটের তলায় দলিত ও দণ্ডিত ইউসুফ

পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট ও বিচারে দণ্ডিত ইউসুফের স্বজনদের সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে কথা হয় নীলফামারীর গ্রামের বাড়িতে। কথা হয় আরও অনেকের সঙ্গে। ২৫ বছরের এই যুবক ভূমিহীন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দু-এক শতক জমির ওপর তাঁদের বাঁশের বেড়া, ছিন্ন টিনের চালা। তাঁর বাবা মো. আলী নেথা বানিয়াপাড়া মসজিদে ইমামতি করেন। বেতন ৬০০ টাকা। একটি মক্তব চালিয়ে পান মুষ্টির চাল। বড় ভাই আবদুল হালিম কটকটি ফেরি করেন। গ্রামের লোকেরা বলেছেন, ফিতরা ও জাকাতের টাকায় লেখাপড়া হয়েছে ইউসুফ আলীর। আলিম পাস করার পর দু-তিন বছর আগে মতিঝিলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে একটি ছোট চাকরি পেয়েছেন। তিনি ব্যাংককর্মী নন।
এখন তদবির করতে ওই পরিবারের কারও ঢাকায় আসা সহজ কথা নয়। তাঁরা পারিবারিকভাবে জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করেন। আবদুল হালিম জোর দিয়ে বলেন, ‘ভাত খাবার পয়সা পাই না, আবার দল করব!’ ইউসুফের মা হালিমা আমাকে বলেছেন, ‘মোর ভালো ছাওয়া কষ্ট করি লেখাপড়া করছে।’ টিভিতে ঘটনা জানার পর থেকে তাঁরা বিপর্যস্ত।
ইউসুফ আলীর ওপর পুলিশি নির্যাতনের বিচার হয়নি। বিচার হয়েছে নির্যাতিতের। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এটি একটি করুণ চিত্র। নির্বাচিত সংসদ সামরিক আদালতের মডেলে ২০০৯ সালে যে আদালত গঠন করেছিল, সেই আদালত তাঁর বিচার করেছেন। কর্নেল তাহেরের বিচারের ক্ষেত্রে সামরিক বিধানেরও লঙ্ঘন ঘটেছিল। মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না, কিন্তু ভূতাপেক্ষ আইন দিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ইউসুফের দশা কিছুটা তাহেরের মতোই। ‘ক্যাঙারু কোর্ট’-এর আইনও লঙ্ঘিত হয়েছে।
সামরিক শাসন চলে গেলেই সামরিক খাসলত বদলে যায় না। ইউসুফ আলীর ওপর নির্যাতন শেষে তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে তা-ই প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থায় বিচার বিভাগ পৃথক্করণে আমলাদের আক্রোশ প্রশমিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। তখন নির্বাহী হাকিমদের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে শুধু অর্থদণ্ডের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান নির্বাচিত সরকার সেনা-সমর্থিত সরকারকে লজ্জা দিয়ে আমলাদের দিয়ে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদানের বিধান চালু করে, যা সংবিধানের চরম লঙ্ঘন। বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের আদালতব্যবস্থা দেখা যায় না। আক্ষরিক অর্থেই একে সামরিক আদালতের সঙ্গে তুলনা করা চলে। জরুরি অবস্থায় শেরেবাংলা নগরে স্থাপিত আদালতগুলোকে আমাদের রাজনীতিকেরা হরহামেশা ক্যাঙারু কোর্ট বলতেন। কিন্তু তাঁদের হাত দিয়েই বিরোধী দল দলনে অন্য রকম ক্যাঙারু কোর্ট চালু হয়েছে। এই আদালতে কোনো সাক্ষ্য লাগে না। অভিযুক্তের আইনজীবী থাকে না। পুরো বিচারব্যবস্থাই অভিযুক্ত ব্যক্তির তথাকথিত স্বেচ্ছা-জবানবন্দিনির্ভর। কেউ দোষ স্বীকার করলেই তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে, অস্বীকার করলে নয়; নিয়মিত মামলা দায়ের করা যায়।
পত্রপত্রিকায় ইউসুফ আলীকে নির্যাতন ও মতিঝিল থানায় বসে তাঁর বিচার করার খবর বেরিয়েছে। গতকাল প্রথম আলোতে ‘তাঁকে এক বছরের সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পুলিশ জানিয়েছে, থানায় আনার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ কামাল হোসেনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ইউসুফকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন।
গতকাল দুপুরে আমি মতিঝিল থানায় ফোন করি। জানতে চাইলে এসআই গোলাম হাফেজ বলেন, থানায় কোনো কোর্ট বসেনি। ঘটনাস্থলেই আদালত তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অপরাধবিষয়ক সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, মতিঝিল অঞ্চলের সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে তথাকথিত ওই আদালত বসেছিল।
ওই কার্যালয় ঘটনাস্থল মতিঝিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রধান অফিস থেকে কমপক্ষে আধা কিলোমিটার দূরে। এই একটিমাত্র তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের ওপর ইউসুফ আলীর ওপর কী ধরনের অবিচার করা হয়েছে, তা প্রমাণযোগ্য।
২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে কোনো অভিযুক্তকে দণ্ডদানের ক্ষেত্রে কতগুলো শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ওই আইনের ৪ নম্বর ধারা বলেছে, কোর্ট ‘কতিপয় অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নেবে’। ইউসুফ আলী যে অপরাধই করে থাকুন না কেন, তা কি নির্বাহী হাকিমের ‘সম্মুখে সংঘটিত কিংবা উদ্ঘাটিত’ হয়েছিল? এই শর্ত পূরণ না হলে ‘তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করে’ অভিযুক্তকে দণ্ড আরোপ করা কীভাবে সম্ভব? নির্বাহী হাকিম যদি প্রত্যক্ষদর্শী হন, তাহলেও তিনি শাস্তি দিতে পারবেন না। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তা স্বীকার করতে হবে। এখন এ স্বীকারোক্তি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কি না, তা অনুধাবনে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আলোকচিত্রই যথেষ্ট। অবশ্য আমাদের শাসক তারকা নেতারা তা বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত!
ইউসুফ আলীর ওপর নির্যাতন চালানোর পর তাঁর কাছ থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ পাওয়ার যে বিবরণ নির্বাহী হাকিম শেখ কামাল হোসেন লিপিবদ্ধ করেছেন, তা জবরদস্তি ও বানোয়াট বলে ধরে নেওয়া চলে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা আছে, ‘এই আইনের অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করিবার সময় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গৃহীত হইবার পরপরই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সংক্ষিপ্ত অভিযোগ লিখিতভাবে গঠন করিয়া উহা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি গঠিত অভিযোগ স্বীকার করেন কি না তাহা জানিতে চাহিবেন এবং স্বীকার না করিলে তিনি কেন স্বীকার করেন না উহা বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানিতে চাহিবেন।’
ইউসুফকে হাতে ব্যান্ড বাঁধা এক পুলিশ বুট দিয়ে তাঁর বুক দলিত-মথিত করেছে। এই আলোকচিত্র সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে ওই নির্বাহী হাকিম ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ওই শর্তাদি পূরণ করেননি, সাজানো বয়ান লিখেছেন।
বিষয়টি গত শুক্রবার ক্ষমতাসীন দলের সম্পাদকমণ্ডলী ও ঢাকায় অবস্থানরত কেন্দ্রীয় নেতাদের জরুরি বৈঠকে আলোচিত হয়েছিল। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা হতভাগ্য ইউসুফ আলীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। গতকাল প্রথম আলো জানাচ্ছে, ‘ওই বৈঠকে বলা হয়, এ ঘটনা সত্য হয়ে থাকলে তা সরকারের জন্য বিব্রতকর। তবে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এটা কারসাজিমূলক অথবা পরিকল্পিত। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কেউ ষড়যন্ত্রমূলক এটা করতে পারে। কারণ, হরতালের দিন বিরোধী দলের এ রকম কোনো পিকেটিং ছিল না যে পুলিশকে কঠোর কোনো ব্যবস্থায় যেতে হবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। ঘটনার সত্যতা জানতে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।’
আমরা আসলে কোনো অংশেই ওই তারকাখচিত মহতী সভার বিজ্ঞ সদস্যদের মতোই ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে খাটো করতে পারি না। খটরমটর হয়তো এর পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণে। ষড়যন্ত্র হলে তা অন্তত দুই কিসিমের হয়েছে। ওই নাদান পুলিশ সরকারের ভাবমূর্তি নস্যাৎ করতে কিংবা তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে তাঁর বুটজুতা দিয়ে ইউসুফের বক্ষ বিদীর্ণে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অতঃপর নির্বাহী হাকিম নির্যাতিত ইউসুফ আলীর বক্ষপিঞ্জরে আদালতের হাতুড়ির ঘা বসিয়েছিলেন। পুলিশ যদি ইউসুফ আলীর বুক বুট দিয়ে পলিশ করে অপরাধ করে থাকে, তাহলে নির্বাহী হাকিমকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে।
এখন সত্যিই কী ঘটেছিল, সেটা সরকারের কোনো শরবত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে আদৌ কখনো জানা যাবে, তেমনটা ভরসা করা কঠিন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে কদিন আগে দেখা হয়েছিল। বললাম, ‘ঢাল-তলোয়ার কবে আপনার হাতে আসবে? লড়াইয়ের ময়দানে কবে নামতে পারবেন?’ তিনি অভয় দিলেন। বললেন, ‘প্রয়োজনীয় লোকবল প্রায় হাতে পেয়ে যাচ্ছি আর কি।’ ওই তারকা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা যদি দেখি তদন্তের দন্তই বরং উৎপাটিত হচ্ছে, তাহলে অবাক হব না। তবে যেন মানবাধিকার কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অগ্রাধিকার দেয়। বাসি বলে যেন পায়ে না দলে।
আমরা অবিলম্বে ইউসুফের মুক্তি ও তাঁকে হেনস্তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার চাই।

পাদটীকা: আমলাচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতব্যবস্থা অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে, কিন্তু তা চালাবেন বিচারিক হাকিমেরা। পাকিস্তানে আসিফ আলী জারদারি বিরোধী দলকে ঠেঙাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। অনেকটাই বাংলাদেশ মডেলে। তবে বাংলাদেশের শাসকদের লজ্জায় ফেলেছেন জারদারি। তিনি সমালোচনার মুখে ওই অধ্যাদেশ বাতিল করেছেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

ডিসিদের স্বপ্নের ক্যাঙারু কোর্ট

ডিসিরা দেশে কার্যত একটি সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছেন। সুপ্রিম কোর্টের অধীনেই এই রিপাবলিকের বিচারিক ক্ষমতার শতভাগ অনুশীলন ঘটবে—এটা মানতে আমলাতন্ত্রের দারুণ আপত্তি। এ জন্য বিচার বিভাগ পৃথক্করণ বানচাল করতে তাঁরা সর্বাত্মকভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু এটা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
শক্তিশালী প্রশাসন ক্যাডার কিন্তু অসফল নয়। তাঁদের ঝুড়িতে ইতিমধ্যে অনেক সাফল্য জমা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অধ্যাদেশের একটি তফসিল আছে। এই তফসিলের মেদ ক্রমে বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁরা সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচারের দাবি জানিয়ে ছিলেন। এখনই কিছু না ঘটলেও নিশ্চিন্তে থাকা যাবে না। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাইনি। কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে আসবে। আর যদি ডিসিদের চাপে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থার জন্ম দেওয়া হয়, তাহলে আম ও ছালা দুটোই যাবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ডিসিদের দাবি নিয়ে সরকার ভাবছে না। এতে সান্ত্বনার কিছু নেই। কারণ, ডিসিদের স্বপ্ন ক্রমে বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ছিল তাঁদের জন্য এক সান্ত্বনা পুরস্কার। আমাদের কাছে এটা বিষবৃক্ষ। এই বৃক্ষ বিস্তৃত হয়ে চলেছে। বিষবৃক্ষ একটি নয়, দুটি। একটির নাম ভ্রাম্যমাণ আদালত। অন্যটি ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারায় সংযোজিত ৪ উপধারা। এর অধীনে নির্বাহী হাকিমদের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা বা কগনিজেন্স পাওয়ার অর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ২০০৭ সালের অধ্যাদেশে ছিল না।
ওই দুটি বিষবৃক্ষই বিচার বিভাগ পৃথক্করণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) নীতির পরিপন্থী। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের লঙ্ঘন। এ মামলাটি আপিল বিভাগে চলমান। আদালত অবমাননার জন্য আমলারা এখনো কাঠগড়াবিদ্ধ। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা কাঁচি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে নিচ্ছেন সাধারণতন্ত্রের (ড. আনিসুজ্জামান রিপাবলিকের অনুবাদ প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে সম্প্রতি সাধারণতন্ত্র ব্যবহার করেছেন) বিচারিক ক্ষমতা।
তাঁরা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে নিত্যনতুন আইন ঢোকাচ্ছেন। আর তক্কে আছেন, কখন কোন সুযোগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারার ৪ উপধারার আওতায় কগনিজেন্স পাওয়ার গলাধঃকরণের। ওই মোবাইল কোর্ট আইন এবং ওই ৪ উপধারাটি অসাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক উৎ স।
জরুরি অবস্থায় ডিসিদের তড়পানিটা কমজোরি ছিল। এখন তীব্রতা পাচ্ছে। মোবাইল কোর্টে তাঁরা গোড়াতে শুধু অর্থদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা পান। তফসিলের পেটে ছিল দুই ডজন আইন। নির্বাচিত আমলে তাঁরা অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা বাগিয়ে নেন। এটা করে দেশে ‘দ্বৈত বিচারের’ পর ‘দ্বৈত দণ্ডনীতি’ চালু করা হয়েছে। আর এখন পারলে তাঁরা পুরো দণ্ডবিধিটাই ওই তফসিলের পেটে চালান করে দেন। বর্তমানে শতাধিক আইন আছে। আরও তাঁরা বাড়াবেন। এখন নাকি তাঁরা কগনিজেন্স পাওয়ারের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন।
কগনিজেন্স পাওয়ার মানে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা আছে, কগনিজেন্স পাওয়ার একটি বিচারিক ক্ষমতা। এটা সর্বতোভাবেই বিচার-প্রক্রিয়ার অংশ। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই অভিমত দেন। তাহলেই প্রশ্ন, ডিসিরা ও তাঁদের অধীন নির্বাহী হাকিমরা কি বিচারক? ওঁরা বিচারক না হলে ওঁদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে কেন?
নির্বাহী বিভাগ প্রশাসন চালাবে। বিচার বিভাগ বিচার করবে। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও শাসনগোষ্ঠী এই মন্ত্র মানতে নারাজ। সে কারণে বিচার বিভাগ পৃথক্করণবিরোধী শক্তি বিয়াম মিলনায়তনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বিচারিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে ডিসিদের তর্জনগর্জন সেই বিদ্রোহের সুতোয় বাঁধা। সেই থেকে তাঁরা ওত পেতে আছেন। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, খাবলা মেরে বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন।
নির্বাচনী অপরাধের বিচার বিচারিক হাকিমদেরই করার কথা। কিন্তু গোপনে কোনো আলোচনা ছাড়াই জরুরি অবস্থায় নির্বাচনী আইনে ঠিকই ঢুকে পড়ে প্রশাসন ক্যাডার। বিচারকার্যের মাতব্বরিটা আমলাদের হাতেও থাকা চাই।
সম্প্রতি ডিসিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬০ ও ২৬২ ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশের তফসিলের পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার আবদার করেছেন। কিন্তু সিআরপিসির সংশোধন ছাড়া এটা করা যাবে না। অবশ্য তাতে কী। কী করে সংসদে হাঁ জয়যুক্ত করাতে হয়, সেটা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। ওটা আমলাতন্ত্রের নখদর্পণে। সরকারি দলকে টোপ দেওয়া সহজ। সামনে নির্বাচন। ডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। তাঁরা বলতেই পারেন, ওটা আমাদের দিন। দেখুন আমরা কী করি। কারণ, তখন নির্বাহী হাকিমরা ‘নির্বাচনে ঘুষ’, ‘এক ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির ভোট দেওয়ার’ মতো নির্বাচনী অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচার করতে পারবেন।
সত্যি বলতে কি, আমলাচালিত কোর্টকে ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হয় না। ক্যাঙারু কোর্টে যিনি প্রসিকিউটর, তিনিই বিচারক। মোবাইল কোর্টেও তা-ই; বরং ক্যাঙারু কোর্টে আসামি আইনজীবীর সুবিধা পান। মোবাইল কোর্টে তা-ও লাগে না। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে ক্যাঙারু কোর্টগুলো আরও বুনো হয়ে উঠতে পারে। সিআরপিসিতে ১৯০ ধারার ৪ উপধারাটির সংযোজন তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি ছুরিকাঘাত। এটা এক অব্যাহত হুমকি। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে দেশে রাতারাতি একটি ব্যাপকভিত্তিক সমান্তরাল বিচার বিভাগের জন্ম নেবে। মুহূর্তেই দেশের আদালতপাড়ার চিত্র বদলে যাবে। খুনখারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই, টেন্ডার-সন্ত্রাস কিংবা বাড়ি দখল—অপরাধ যতই জঘন্য হোক, ডিসিরা এ-সংক্রান্ত অভিযোগ, মামলা ইত্যাদি আমলে নিতে শুরু করবেন। এর সবচেয়ে বড় মজা ও মওকা হবে জামিন দেওয়া। মন্ত্রীদের টেলিফোনে কত দিন তাঁর জামিন প্রদানের সুখবঞ্চিত!
বিচারের জন্য প্রস্তুত বা রেডি ফর ট্রায়াল বলে একটা কথা আছে। ওই ৪ উপধারা বলেছে, নির্বাহী হাকিমরা শুধু বিচারের জন্য কোনো মামলা বিচারিক হাকিমদের কাছে পাঠাবেন। এর আগেই অনেকগুলো পর্যায় পেরোতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তদন্ত ও জামিন। একই সঙ্গে একই ক্ষমতা দেশের বিচারিক আদালতগুলোরও থাকবে। সুতরাং, পুলিশ ও টাউটরা মিলে একই মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ডিসি অফিস ও আদালত চত্বর দুই স্থানে লাইন লাগাবে। যেখানে সুবিধা পাবে, সেখানে তারা মামলা ঠুকতে পারবে। মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষরা এখন সাত ঘাটের পানি খেলে তখন খাবে চৌদ্দ ঘাটে।
আমরা অবশ্যই মনে রাখব, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হওয়া সত্ত্বেও আদালত থেকে দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে—এমন আস্থা জনমনে সৃষ্টি হয়নি। সে জন্য যথা ওষুধ লাগবে। বিচার-বস্ত্র ডিসিদের হরণ করতে দেওয়া যাবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রহ কিংবা সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, তাঁদের আগ্রহের মামলাগুলো থেকে তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী তাঁরা আদালতে বেশ প্রতিকার পান। একইভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী অনেক কম প্রতিকার পান। এ অবস্থায় যখন আমরা বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছি, তখন আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বে আরেকটি সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।
সরকার এটা চাইলে সহজেই করতে পারবে। বিরোধী দল এ নিয়ে লোক-দেখানো হট্টগোল করলেও রাস্তায় পিকেটিং করবে না, হরতাল দেবে না; পুলিশের সঙ্গে কেউ ধস্তাধস্তির ঝুঁকিও নেবেন না। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মোবাইল কোর্টকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন তখনই, যখন হরতালের পিকেটাররা মোবাইল কোর্টের মার খাচ্ছিলেন।
বর্তমান সংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতারা আমাদের অনেক ক্যারিকেচার দেখতে বাধ্য করছেন। সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের পুরোটাই অনন্তকালের জন্য সংশোধন অযোগ্য। এমনকি এগুলো হচ্ছে মৌলিক কাঠামো। সাধু সাধু। অন্যদিকে ক্যাঙারু কোর্টের এমন অনেক বিধান আছে, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের ৩৫ অনুচ্ছেদের ভয়াবহ লঙ্ঘন। সংবিধান বলছে, কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো যাবে না। কিন্তু ওটাই প্রকৃতপক্ষে ক্যাঙারু কোর্ট চালানোর মূলমন্ত্র।
সাম্প্রতিককালে হরতালের পিকেটারদের যাঁদের জেল দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের রায়ে নির্বাহী হাকিমরা লিখেছেন, তাঁরা সবাই দোষ স্বীকার করেছেন। এত বড় একটা ধাপ্পা ও প্রতারণাপূর্ণ বিচারব্যবস্থার নাম ভ্রাম্যমাণ আদালতব্যবস্থা। এর একটা জনপ্রিয় মুখোশ রয়েছে। নির্বাহী হাকিমরা মিডিয়া (এম্বেডেড) টিম নিয়ে, পুলিশ নিয়ে ভেজালবিরোধী অভিযান কিংবা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেমে পড়েন। গরম গরম শাস্তির বিবরণ ছাপার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটি অংশ বুঝে হোক, না-বুঝে হোক আদিখ্যেতা দেখিয়ে থাকে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের বিরুদ্ধে সারা দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি যিনি দিয়েছিলেন, তিনি নাম কামিয়েছিলেন গরম গরম শাস্তি দিয়ে।
সামনে রমজান মাস। পুরান ঢাকার অনেক গলি-ঘুপচিতে ভেজাল সেমাই, মসলা ইত্যাদি হরেক রকম খাদ্য তৈরি হবে। এসবের বিরুদ্ধে ঘটা করে বিচার-ভ্রমণ শুরু হবে। দৃশ্যটা অনেকটা কোরবানির হাটে সাজগোজ করে গরু নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের মতো। একদল লোক পেছন পেছন হল্লা করে ছোটে। লোকজন মজা পায়। ভেজালবিরোধী অভিযানের দৃশ্যটাও অনেকটা তা-ই। গরম গরম পেঁয়াজু খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি গরম গরম শাস্তি দেওয়ার দৃশ্য অবলোকন করার আমেজও অন্য রকম।
আমরা সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি বিবেচনায় মোবাইল কোর্ট নামের দ্বৈত বিচারব্যবস্থার অবসান চাই। ১৯০ ধারার ৪ উপধারার অবিলম্বে বাতিল চাই। সামারি ট্রায়ালের ক্ষমতা দাবি করাকে ডিসিদের পক্ষে গুরুতর পেশাগত অসদাচরণ বলে দেখা উচিত। বিচার বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। মোবাইল কোর্টের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের অবিলম্বে শুনানি আশা করি। ভারত ডিসিদের দ্বারা জজিয়তি না করিয়ে যদি সুশাসন ও প্রবৃদ্ধি দুটোই দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অক্ষম হবে কেন। আওয়ামী লীগের এটা মনে রাখা ভালো যে, তারা প্রশাসন ক্যাডারের স্বপ্নের ক্যাঙারু কোর্ট এবং ওই ৪ উপধারা বাতিল না করলে এসব অস্ত্র বিএনপি বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে। এক মাঘে শীত যায় না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mৎ khanbd@gmail.com

সুপ্রিম কোর্টে ‘ঘুষ’, টিআইবি ও মাহমুদুল ইসলাম

টিআইবির ধারণাসূচক দুর্নীতি-সম্পর্কিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি দ্বারা প্রত্যাখ্যানে অবাক হইনি। আমরা ভুলিনি, আমাদের দেশটি একাদিক্রমে পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। তখনো এই সুপ্রিম কোর্ট উদাস থেকেছেন। আমরা ব্যথিত যে বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে তর্ক হলে, ঢালাও অভিযোগ হলে ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও বিচার প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু আমরা কী করে ভুলি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকেছে কুম্ভকর্ণ হয়ে। ‘মহাপ্রলয়’, ‘কাচের ঘর’, ‘তোলা আদায়’ কত কথা বলা হলো। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি এবার বললেন, সুপ্রিম কোর্ট এ সমাজসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এতদিন বাদে এতটুকু ইঙ্গিত যথেষ্ট নয়। তবে এ রকম জরিপের ভিত্তিতে বিচার বিভাগকে ‘সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত’ আখ্যা দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমরা সমর্থন করি। আর প্রতিবেদনের সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য দিক হলো, যে সমাজে ‘অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত’ সেখানে ‘শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রহণ ফলপ্রসূ নাও হতে পারে’ মর্মে মন্তব্য করা। আমরা এখানে বিচার বিভাগীয় সার্বভৌম ক্ষমতার অতিশয় জরুরি প্রয়োগ দেখতে চাই।
টিআইবির প্রতিবেদন অবশ্যই নিরেট তথ্যনির্ভর নয়। এমনকি তা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানসম্মত নাও হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কে কী করেছেন, তার জবাবদিহি অবশ্যই পেতে হবে। সাধারণ জ্ঞান এটা বলে না যে কোন বিচারক কার কাছ থেকে কয় টাকা ঘুষ নিয়েছেন, সে তথ্য কেউ সহজে প্রকাশ করবেন। অতঃপর দায়িত্বপ্রাপ্তরা টুপ করে ক্রিকেটীয় মৌতাতে ক্যাচ ধরবেন।
ওই কমিটির কাছে দুর্নীতি বা করাপশন যেন টাকা-পয়সাসর্বস্ব একটা বিষয়। মার্কিন পণ্ডিত হেনরি ক্যাম্পবেল ব্লাকের অভিধানে লেখা, দুর্নীতি মানে ক্ষমতার অপব্যবহার। দায়িত্বের, এখতিয়ারের অপব্যবহারও দুর্নীতি। আইনের অপব্যাখ্যাও দুর্নীতি। ‘গুড ফেইথ’ ছাড়া যে যা করবেন তা-ই দুর্নীতি। আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙতে, থেঁতলাতে আমরা দেখি। এই আইন কখনো সংসদের এবং আদালতেরও তৈরি করা। মুখ বদলায়, আইনের প্রয়োগ বদলায়। মুখ চিনে খাদিম কথাটি অনেকেই জানেন। তাঁরা জানবেন, মুখ চিনে আইন নামের খাদ্যও বিলানোর যোগ্য। এসবই দুর্নীতি। অতিরঞ্জন হলেও বলব, এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কাছে আর্থিক দুর্নীতি তুচ্ছ। আমরাও টিআইবির ধারণা জরিপের সীমাবদ্ধতা দেখি। কারণ, তারা বিচার বিভাগের দুর্নীতিকে শুধুই টাকার অঙ্কে পরিমাপ করতে প্রয়াস পেয়েছে।
২০০৭ সালে আমরা যখন ‘হাতির পাঁচ পা’ দেখছিলাম, তখন টিআই বিশ্ব করাপশন রিপোর্ট ২০০৭ প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখানো হয় হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিচার বিভাগ বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। ৭৭ ভাগ উত্তরদাতার মতে ভারত ও ৫৫ ভাগের মতে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত। টিআইবির সমকক্ষ হলো টিআইপি। ২০১০ সালের টিআইপির খানা জরিপে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে হাইকোর্টের রায়ে তিরস্কৃত আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রীর মতো ওই দুটি দেশের কেউ বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া দেখাননি। সুপ্রিম কোর্ট কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন সে কারণে আমাদের বিমূঢ় করেছে। তাঁরা লিখেছেন, ‘এতে বিচার বিভাগের মান-মর্যাদাকে দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বাংলাদেশ তথা দেশবাসীকে সারা বিশ্বের সামনে হেয় করেছে।’ ওই দুই দেশের সুপ্রিম কোর্ট কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। এমনকি ওই দেশ দুটির আইনবিদেরাও আমাদের অনেকের মতো ঝাঁঝালো হননি। ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী রাম জ্যাঠমালিনীর মন্তব্য ছিল, ‘মনে হয় না পরিস্থিতি এতটা খারাপ। সমাজের অন্যান্য অংশের তুলনায় বিচারকেরা ভালো। তবে তাঁরা ফেরেশতা নন। তাঁরা এই সমাজেরই অংশ।’ এমনকি বিজেপির সাবেক আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এ ধরনের ‘ঢালাও মন্তব্য অন্যায্য’ উল্লেখ করেও বলেন, ‘ঘর ঠিক করতে সুপ্রিম কোর্টকে পদ্ধতি বার করতে হবে।’
পাকিস্তানের পত্রপত্রিকাতেও আমরা একই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখি। ভারতের সংসদ বুঝতে পেরেছে, অভিশংসন নামের কাগুজে বাঘ কাজ দেয় না। উচ্চ আদালতের দুর্নীতি রোধে তারা সম্প্রতি জবাবদিহি বিল এনেছে। সুপ্রিম কোর্টে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা শাস্তি বা নিন্দাযোগ্য। কিন্তু সব সময় অপসারণযোগ্য নয়। পাকিস্তানের দ্রোহী প্রধান বিচারপতি ইফতিখার আহমেদ চৌধুরী বিচার বিভাগ থেকে দুর্নীতি দূর করতে জিহাদে আছেন।
অথচ টিআইবির রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন অবস্থান নিলেন। আমরা কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু তার ফলাফল আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় তফাত থাকল না। এমনকি রাজনীতিবিদদের টেক্কা দিয়ে দুজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যেন লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে টিআইবির কর্মকর্তাদের বিচার চেয়েছেন।
এতকাল সবাই জেনেছেন বার ও বেঞ্চ হলো হরিহর আত্মা। এক ইগলের দুই ডানা। আইনজীবীরা কোর্ট অফিসার। এখন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি বলল, আইনজীবীরা বিচার বিভাগের অংশ নন। তাঁরা বলেছে, ‘আইনজীবী, আইনজীবীদের ক্লার্ক/মোহরার এবং দালালকে কখনোই বিচার বিভাগের অংশ বলে গণ্য করা যায় না। বিচার বিভাগ বলতে প্রথমেই বিচারক এবং তৎপর বিচারালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব কর্মচারী কাজ করে, তাদের বোঝায়।’ কর্মচারীদের অভিভাবকত্ব বিচারকেরা নানাভাবে করেন। যেমন সুপ্রিম কোর্ট কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি আপিল বিভাগের বিচারপতি এস কে সিনহা। ১৫৭০ সদস্যের এই ট্রাস্টে ঝাড়ুদার থেকে বেঞ্চ অফিসারসহ আদালতের সব স্টাফ আছেন।
আমাদের বরেণ্য আইনবিদ মাহমুদুল ইসলাম ও তাঁর যোগ্য সহকর্মী প্রবীর নিয়োগী ২০০৬ সালে প্রকাশ করেন দ্য ল অব সিভিল প্রসিডিউর। এর ভূমিকায় মাহমুদুল ইসলাম যা লিখেছেন (পৃ.২ ও ৩), তা একাই এক শ। তিনি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং নন্দিত অ্যামিকাস কিউরি। টিআইবির রিপোর্ট বোমা হলে তাঁর পর্যবেক্ষণ পরমাণু বোমা। তাঁর কথায়: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের থেকে শুরু করে রায় কিংবা আদেশের জাবেদা অনুলিপি সরবরাহ করার প্রতিটি পর্যায়ে আদালতের স্টাফদের ঘুষ দিতে হয়। অল্পসংখ্যক বিচারক ডায়েরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে দৈনন্দিন কার্যতালিকায় একটি মামলা ভুক্ত করার জন্য বেঞ্চ অফিসার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আদায় করে থাকেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার এক সমাবেশে বলেছিলেন, গুলশান-বারিধারায় বাড়ি কী করে হলো জবাব পাওয়া যাবে কি। আমরা জবাব পাইনি। টিআইবির কর্মকর্তাদের চা পানে ডেকেছে কমিটি। কিন্তু ঘরের কাছের লোকদের কাছে তাঁরা জানতে চায়নি। ২৩ নভেম্বর ২০০৯। বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালাতে যে ঘুষ লাগে সেটা সেদিন সম্ভবত ইতিহাসে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়েছিল। দুজন আইনজীবী আদালতকে জানান যে ‘এক শ্রেণীর বেঞ্চ অফিসার মামলা তালিকাভুক্ত করতে ঘুষ নিচ্ছেন।’ অথচ তালিকায় কোন মামলা কীভাবে থাকবে, কোন ক্রমিকে তা মুদ্রিত হবে, সেটা নিরঙ্কুশভাবে বিচারকের এখতিয়ার। ওই দিন তাঁরা নির্দিষ্টভাবে তথ্য দেন যে তাঁদের এক মক্কেলকে একটি জামিন আবেদনের দ্রুত শুনানির জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙল। কিন্তু এর কোনো তদন্ত হতে দেখলাম না। প্রতিকার দেখলাম না। মাহমুদুল ইসলামও লিখেছেন, ‘এই বিষয়ে একবার একটা ঝগড়া হলো। একজন বেঞ্চ অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মধ্যে মারাত্মক বিবাদ হলো। কিন্তু বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি সমস্যার দিকে তাঁর মন না দিয়ে দোষারোপ করলেন আইনজীবীকেই।’ অবশ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম উল্লিখিত দুই মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে গণ জামিনের একটি ঘটনার তদন্ত করিয়েছিলেন। সেই রিপোর্ট চাপা পড়ে আছে। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দায়িত্ব নিয়ে মিনিটে মিনিটে জামিনের আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমরা অনুমান করি, ওই তদন্তে প্রাপ্ত ফলাফলই তাঁর উষ্মার উৎস। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না তুলে শুধু আক্ষেপে লাভ কী। নিম্ন আদালতে ‘তোলা আদায়ের’ বিচিত্র তথ্য আমরা জানি। কিন্তু বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা কমিটির সুপারিশমতে ‘বিচারব্যবস্থার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের স্বার্থে অতিশয় জরুরি এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’ কে নেবেন?
মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যোগ্য বিচারকের সংখ্যা খুবই কম এবং তাঁদের মধ্যে খুবই অল্পসংখ্যক বিচারক আছেন, যাঁরা তাঁদের কাজের জন্য গর্ব করতে পারেন। তাঁদের চারিত্রিক অখণ্ডতা ও সততা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিচার প্রশাসনের ওপর জনগণের যে আস্থা ছিল, তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। একজন বিচারকের অর্জন গুরুতররূপে নিচে নেমেছে।’ এখানে স্মরণ করুন আমার আগের লেখা, বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির হার কমছে। এবং মনে রাখুন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরাই বারের সদস্য। আজ যিনি বারে, কাল বেঞ্চে। শুধু শপথ নিলেই মাই লর্ড।
মাহমদুল ইসলাম লেখেন, ‘আইনের বিষয়ে বারের সদস্যরা আর কোনোভাবেই উত্তমরূপে সমৃদ্ধ নন। বিশেষ করে তাঁরা যেসব মামলা পরিচালনা করেন, সেই সংশ্লিষ্ট আইন এবং তাঁদের যুক্তিতর্কের নির্ভুলতায় ঘাটতি চলছে। আইনজীবীদের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ এই ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ের লোকেরা’ কিংবা যারা ‘দুষ্টের দমন করেন না’ (প্রধান বিচারপতি বর্ণিত) তাঁদের জন্য বিচারক হওয়ার দরজা কিন্তু বন্ধ নেই।
হাইকোর্টের জামিনের আদেশ জেলখানায় পৌঁছাতে ঘুষ লাগবেই। দৈনন্দিন কার্যবিবরণীতে ক্রমিক ভেঙে মামলা তুলতে বেঞ্চ অফিসারকে ঘুষ দেওয়া লাগবেই। অসাধু মামলাকারীরা আদালতের স্টাফদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘুষ দেবেনই। এখন প্রশ্ন হলো, বার ও বেঞ্চের অন্তত পরোক্ষ অনুমোদন কিংবা ঔদাসীন্য ছাড়া এটা সম্ভব কি না? এর জবাবও মাহমুদুল ইসলাম দিয়েছেন ‘এই ঘটনার সবচেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত দিক হচ্ছে, কতিপয় ক্ষেত্রে আইনজীবীরাও এ ধরনের পদক্ষেপকে (ঘুষ প্রদান) অনুমোদন দিয়ে থাকেন। তাঁরা তাঁদের মক্কেলদের ঘুষ প্রদানে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেন। আদালতের স্টাফরা অদক্ষ এবং তাঁরা এমনই একটা ভয়ানক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে নিয়েছেন, যাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ না দিলে বিলম্বের ঘটনা ঘটবেই। আদালতের স্টাফরা ঘুষ দাবি করতে এতটাই বেপরোয়া হয়েছেন যে তাঁদের যেটা কর্তব্য, সেটা সম্পাদনেও তাঁরা ঘুষ নিচ্ছেন এবং এমন কিছু ক্ষেত্রেও তাঁরা ঘুষ নিচ্ছেন, যা করা তাঁদের উচিত নয়।’ এখানে ‘যা করা তাঁদের উচিত নয়’, সেটা করতেও তাঁরা যে ঘুষ নিচ্ছেন, সে কথার নিহিত তাৎপর্য পাঠকেরা আশা করি অনুধাবন করবেন। ইউএনবির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক ফারুক কাজীর ২০০৯ সালের রিপোর্টের একটি বাক্য মনে পড়ল। একজন তরুণ আইনজীবী তাঁকে বলেন, ‘ঘুষের টাকার ভাগ অনেকেই পেয়ে থাকেন।’ পত্রপত্রিকায় এটা ছাপা হয়েছে।
বিচার বিভাগের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবির প্রতিবেদনকে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। আবার বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে কমিটি করা হলো। আমরা একে স্বাগত জানাই। এ কমিটি ‘দুর্নীতির কারণ’ অনুসন্ধান করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বঙ্গভবনে বিচারপতি সিনহাকে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়। সেটা দেশবাসী জানল। এখন নির্বাচিত সরকারের আমলে জানল উল্টো। তিনিই হলেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুর্নীতির কারণ অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি। এটা সেনাশাসন ও নির্বাচিত শাসনের মৌলিক পার্থক্যের সূচক কি না। যার ভিত্তিতে সেদিন তাঁর বিষয়ে ‘অন্যায্য’ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা তো সরকারযন্ত্রে আছেন। এর জবাবদিহি কে করবে?
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা কমিটির প্রশ্ন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি হতে শুরু করে আপিল বিভাগের বর্তমানে কর্মরত চারজন বিচারপতি আমরা ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যরা এবং বাকি ৮৯ বিচারপতির কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ বা হয়রানির অভিযোগ আছে কি? আমরা মনে করি, এ রকমের একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া অসমীচীন, অসংগত। এর মধ্য দিয়ে কমিটি তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের প্রতি সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ঘুষ ধরা-ছোঁয়া যায়, কিন্তু হয়রানি যায় না। অনেক সময় এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আবু সাফার মামলায় পুরো আপিল বিভাগ আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেটা ছিল হয়রানির একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ড. কামাল হোসেন ধরনা দিয়ে নাটকীয়ভাবে সঠিক রায় ছিনিয়ে এনেছিলেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি রিভিউ আবেদন করারও সুযোগ পাননি। আপিল বিভাগ বলেছিলেন, তাঁকে শাস্তিদানের কারণ শিগগিরই তাঁরা জানাবেন। কিন্তু তাঁর তো জেল খাটার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। অথচ তিনি সেই ‘কারণ’ জানতে পারছেন না। সুতরাং অনেকের কাছে এটা মনে হতেই পারে, তিনি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
অথচ কমিটি ও টিআইবি টাকার ওপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। তাই তারা বলতে পেরেছে, ‘টিআইবির প্রতিবেদনের এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই যে উল্লিখিত ঘুষের টাকা বিচারকের হাতে পৌঁছেছে।’ বিচারকেরা কেউ ঘুষ নিলেন কি নিলেন না, তাতে ভুক্তভোগী জনগণের যায় আসে না। কারণ, জমিজিরাত বেচে হলেও তাঁদের মাহমুদুল ইসলাম বর্ণিত ঘুষের টাকা দিতেই হয়। তাঁকে সাক্ষী মানছি। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হোক। অ্যামিকাস কিউরি অর্থ আদালতের বন্ধু। সেই বন্ধুদের সহায়তা শুধু বিচারে কেন, বিচার প্রশাসন চালাতেও নিতে কোনো ক্ষতি দেখি না। মাহমুদুল ইসলামের মতো আইনবিদেরা অতি উত্তম রূপে বলতে পারবেন, খুবই ‘অল্পসংখ্যক বিচারক’ কথাটির মানে কী? বেঞ্চ অফিসাররা ঘুষ নিয়ে এমন সব কাজ করেন, ‘যা তাঁদের করা উচিত নয়’ কথাটির মানে কী। এবং তাঁরা এসব করার স্পর্ধা কোথায় পান? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে—সে কথাটি না মানার মাশুল সুপ্রিম কোর্টে বিচার-প্রার্থীরা আর কতকাল দেবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

মনমোহনজি, সুপ্রিম কোর্টের রায়টি পড়ুন

মনমোহন সিং মনমোহন সিং
বাহাত্তরের মূল সংবিধানে বাংলাদেশের সীমানা নির্দিষ্ট ও নিশ্ছিদ্র করা হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর কারণে সেই সীমানায় ছিদ্র তৈরি হয়। ওই সংশোধনীতে এমন একটি বাক্য যুক্ত করা হয়, যার ফলে ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানার ভাগ্য অংশত সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
এ কথা খুবই আলোচিত যে বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করে বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়েছিল। কিন্তু এর বিনিময়ে তিন বিঘা করিডর স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ পায়নি। তবে যেটা আলোচনায় নেই সেটা হলো, ১২ নম্বর বেরুবাড়ী ইউনিয়নের ভাগ্য মুজিব-ইন্দিরা ঠিক করেননি। নেহরু-নুন আধাআধি ভাগ করেছিলেন। সেটা ১৯৫৮ সালের কথা। দুই নেতা শুধু বেরুবাড়ী নয়, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্থলসীমান্ত ঠিক করেছিলেন।
বাংলাদেশের সীমানা প্রসঙ্গ এখন যে কারণে মনে পড়ল তা হলো, দুই দেশের কূটনীতিকদের বক্তব্য। তাঁরা আমাদের জানাচ্ছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে সীমান্ত নিয়ে চুক্তি হবে। কী চুক্তি হবে, তা আমরা জানি না। হলে তা ১৯৮২ সালের মতো কোনো সম্পূরক বা পার্শ্ব চুক্তি হওয়ার কথা। কারণ, এ ক্ষেত্রে নতুন করে বড় ধরনের কোনো চুক্তি সম্পাদনের কোনো অবকাশ নেই। ছোটখাটো চুক্তি যদি হয়, যদি চুয়াত্তরের চুক্তির ৫ নম্বর দফা কার্যকর না হয়, তাহলে সেটা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলাটা সত্যি বেমানান। যেমন তিন বিঘা করিডর দিয়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের অধিকতর অবাধ চলাচল বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হতে পারে। দুই দেশের জরিপকারীরা ছিটমহলে মাথা গণনার কাজ শেষ করেছেন। সাড়ে ছয় কিলোমিটার জায়গা চিহ্নিতকরণের জট খুলতে পারে। কিন্তু হইচই করার কিছু নেই। আমরা চাই, রেটিফিকেশন প্রশ্নটি যেন ঝুলে না থাকে।
আমরা লক্ষ করি, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির রেটিফিকেশন বা অনুসমর্থন যেখানে মুখ্য বিষয়, সেখানে এ নিয়ে আলোচনা নেই। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম যখন সরকার গড়েন, তখন তিনি রেটিফিকেশন নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এ বিষয়টি প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের কাছ থেকে শুনেছিলাম। কিন্তু এরপর আমাদের অন্য কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর বরাতে এই রেটিফিকেশন শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে বলে শুনিনি।
সম্প্রতি দিল্লি সফরকালে এ বিষয়ে আমাদের হাইকমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তাঁকে বলি যে এইবার রেটিফিকেশনটা সম্পন্ন করে নেওয়ার সম্ভাবনা কতটা? তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এখানে বলে রাখি, অনেক সময় শুনেছি যে নয়াদিল্লি যুক্তি দেয়, রেটিফিকেশন করতে হলে ভারতের সংবিধানে সংশোধনী লাগবে। সাম্প্রতিককালেও শুনেছি, রেটিফিকেশনের কথা বললে ভারতের কোনো কোনো সরকারি মহল নাকি সংবিধান সংশোধনের দোহাই দেয়।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা-মনমোহন সিংয়ের যৌথ বিবৃতির ২০ দফায় বলা আছে, ‘উভয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তির চেতনার ভিত্তিতে সীমান্তসংক্রান্ত সব বকেয়া ইস্যু ব্যাপক ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করতে একমত হয়েছেন।’
বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের ৩৬ বছর পর এই বিবৃতিতে আমাদের সরকার সন্তুষ্ট হতে পারে। ভারতের সরকারি যন্ত্র সন্তুষ্ট হতে পারে। কিন্তু আরও একটি মহান প্রতিষ্ঠান আছে, যার কিন্তু এই বিবৃতিতে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। সেটি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। কেন, সে কথায় পরে আসছি।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী চুক্তিটি সই করেন। এটি আসলে ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তির পরিবর্তিত সম্প্রসারণ বা ধারাবাহিকতা। এক অর্থে এটি যথেষ্ট মৌলিক চুক্তি নয়। আমাদের তৃতীয় সংশোধনীর মতো আটান্নর চুক্তির পেছনেও কিন্তু বেরুবাড়ী। মূলত এই বেরুবাড়ীর জন্যই আমাদের সংবিধান সংশোধন করা হয়। স্যার সিসিল রেডক্লিফ ছিলেন সেই বুড়ো খোকা। যিনি তাঁর পেনসিল দিয়ে ভারত ভাগ করেছিলেন। রেডক্লিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত হয়। এই রোয়েদাদের ব্যাখ্যা ভারত প্রথমে এমনভাবে করেছিল যাতে তারা পুরো বেরুবাড়ীর দখল নিয়ে নেয়। পাকিস্তানও তাতে আপত্তি করেনি। কিন্তু ১৯৫২ সালের কাছাকাছি সময়ে পাকিস্তান বলা শুরু করে যে রেডক্লিফ রোয়েদাদের প্রকৃত ব্যাখ্যা করলে বেরুবাড়ী ভারতের ভাগে পড়ে না। ওটা পূর্ববঙ্গের মধ্যে পড়ে। এ নিয়ে চিঠি চালাচালি করতে করতেই ১৯৫৮-তে চুক্তি হয়। দুই দেশ বেরুবাড়ী ভাগ করে নেয়। এই চুক্তিতেই কিন্তু ছিটমহল ও অপদখলীয় এলাকার ভাগাভাগি ঘটে। চুয়াত্তরের চুক্তির আওতায় প্রায় ১০ হাজার একরের বেশি জমি যে বিনা মূল্যে বাংলাদেশ পাবে বলে স্থির হয়, সেটাও চূড়ান্ত করেছিলেন নেহরু-নুন।
১৯৫৮ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা ধাঁধায় পড়েন। তাঁরা ভাবতে বসেন, এর সঙ্গে সেশন বা চুক্তি মোতাবেক জমি সমপর্ণের প্রশ্ন জড়িত কি না। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স পাঠান।
সংবিধান সংশোধন করতে হবে কি না, সেই প্রশ্ন ছিল মুখ্য। সুপ্রিম কোর্টের মতের ভিত্তিতে ১৯৬০ সালে ভারত নবম সংশোধনী আনে। এই সংশোধনী পশ্চিম পাকিস্তানে কার্যকর হলেও পূর্ব পাকিস্তানে হয়নি। কারণ তাতে প্রজ্ঞাপন দ্বারা ‘অ্যাপয়ন্টেড ডে’ ঘোষণার কথা ছিল। এটা পশ্চিমে ঘটে ১৭ জানুয়ারি ১৯৬১। পূর্বে ঘটেনি। ১৯৮৩ সালে চুক্তির বৈধতা প্রথম চ্যালেঞ্জ হয় কলকাতা হাইকোর্টে। এক সদস্যের বেঞ্চ রিট নাকচ করে রায় দেন, ‘নবম সংশোধনী ভারতের পূর্বাঞ্চলে কার্যকর হয়নি। চুয়াত্তরের চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতীয় ভূখণ্ড বা সার্বভৌমত্ব খোয়ানোর কোনো প্রশ্ন নেই।’ এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টের এক দ্বৈত বেঞ্চে আপিল হয়। এই বেঞ্চ হাইকোর্টের একক বেঞ্চের রায় বহাল রেখেও সংবিধান সংশোধন দরকার বলে মত দেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ দ্বৈত বেঞ্চের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয় সুপ্রিম কোর্টে।
আওয়ামী লীগের বিগত আমলের বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমান গতকাল জানালেন, ‘বিএসএফের সঙ্গে বৈঠকে আমি রেটিফিকেশনের কথা তুলেছি। তাঁরা এর উত্তরে ভারতের সংবিধান সংশোধনের কথা বলতেন। এ বিষয়ে মামলা বিচারাধীন থাকার যুক্তিও দিয়েছেন।’ জেনারেল রহমান ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। অথচ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯০ সালের ৩ মের রায় থেকে আমরা দেখছি, তাঁরাও দ্বৈত বেঞ্চকে সমর্থন করেন। সুপ্রিম কোর্ট এমনকি বলেন, ‘নবম সংশোধনী বাংলাদেশ সীমানা অর্থে ভারতের সংবিধানের অংশে পরিণতি হয়নি। কারণ “অ্যাপয়ন্টেড ডে” ঠিক হয়নি। সেটা মেনেই দুই সরকার চুয়াত্তরে চুক্তি করে।’ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট রায় দেন যে, সংবিধান সংশোধনের দরকার নেই। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল সলি সোরাবজিও একই অভিমত রেখে বলেন, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধন লাগবে না।
১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর আমাদের সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী কার্যকর হয়। আমাদের দেশের সীমানা-সম্পর্কিত ২ অনুচ্ছেদটি মূল সংবিধানে এভাবে লেখা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্তি হইবে ক. ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং খ. যে সকল এলাকা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত হইতে পারে।’ ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধানেও একই ধাঁচে লেখা। তবে আমাদের একটি খসড়া সংবিধানে দেখি, বিকল্প ভাবা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হবে সেসব এলাকা, যা ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইনে পূর্ববঙ্গ প্রদেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।’ কিন্তু এই বিকল্প বাদ পড়ে।
ওই ২ অনুচ্ছেদে ১৯৭৪ সালের ৭৪ নম্বর আইনের মাধ্যমে সংশোধনী আনা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল কথাটির পরে যুক্ত করা হয় ‘এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা, কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকার তদবহির্ভূত’। তৃতীয় সংশোধনী প্রকৃত অর্থে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটি শর্ত সাপেক্ষে বাংলাদেশ সংবিধানের অংশে পরিণত করা।
বেরুবাড়ীর হস্তান্তরের বিরুদ্ধে আমাদের সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেন, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির সঙ্গে ‘সেশন’ জড়িত। সংবিধান সংশোধন ছাড়া এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কাজী মুখলেসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ের পরপরই আনা হলো তৃতীয় সংশোধনী।
তৃতীয় সংশোধনীর ৪ নম্বর দফার শিরোনাম হচ্ছে ‘এলাকা অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূতকরণের বিজ্ঞপ্তি।’ তাহলে সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদে ‘অন্তর্ভুক্ত এলাকা’ ও ‘বহির্ভূত এলাকা’ আমরা বুঝব ৪ দফার আলোকে। আর এতে লেখা আছে, ‘চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী ভূসীমানা নির্ধারণের পর সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা সরকার যে তারিখ বর্ণনা করেন সেই তারিখ হইতে উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত অন্তর্ভুক্ত এলাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার অংশ হইবে এবং বহির্ভূত এলাকা উভয়ের অংশ হইবে না।’ সুতরাং আমরা দেখি, ‘চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী ভূসীমানা নির্ধারণের পর’ এই শর্ত এখনো পূরণ হয়নি।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ৫ অনুচ্ছেদটি গুরুত্বপূর্ণ। এতে বলা আছে, ‘এই চুক্তি বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকারের অনুসমর্থন সাপেক্ষ এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইনস্ট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন বিনিময় করা হবে। ইনস্ট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন যে তারিখে উভয়ের মধ্যে বিনিময় হবে, সেই তারিখে চুক্তি কার্যকর হবে।’
এর সরল মানে দাঁড়াল এই যে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি আজ পর্যন্ত আইনের চোখে একটি অকার্যকর চুক্তি। পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে আমরা বিতর্কের ঝড় তুলেছি। বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের একটি উত্তম অধ্যায় আমরা অতিক্রান্ত করছি। কিন্তু ওই চুক্তির ৫ নম্বর দফা, যার সঙ্গে আমাদের সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদের কার্যকারিতার প্রশ্ন জড়িত, তা নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমেও কোনো আলোচনা নেই। ইতিমধ্যে এই অনুচ্ছেদটিকে আমরা অন্যতম মৌলিক কাঠামো হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। তিন দশকের বেশি সময় ধরে কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ২ অনুচ্ছেদটির শর্তাংশের দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে। এটিকেও অনাদিকালের জন্য ‘সংশোধন অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে।
আমাদের সীমাবদ্ধতা তো অনেক। তাই সবিনয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করব ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতি। ১৯৯০ সালের ৩ মে দেওয়া রায়ে সুপ্রিম কোর্ট মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির প্রস্তাবনায় ‘উভয় দেশের মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের’ বিষয়টি স্মরণ করেন। তিন বিঘা হস্তান্তর যে একটা বেহুদা টালবাহানা ছিল, তার স্বীকৃতি আছে রায়ে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন এটা একটা ‘নন ইস্যু’। তবে দুই দশক পরেও কিন্তু এটা ইস্যু হয়ে আছে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি সব্যসাচী মুখার্জির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘...তাহলে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন আনা ছাড়াই চুক্তিটি (আমাদের সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত চুয়াত্তরের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। এবং আমরা আশা করি যে, সেটা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের স্বার্থে করা হবে।’ আমরা আশা করি, ঢাকায় আসার আগে ড. মনমোহনজি দুই দশকের পুরোনো এই রায়টি পড়বেন। তাহলে হয়তো তিনি চুক্তি রেটিফিকেশনে তাঁর দেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক অনীহা (যদি থাকে) কিংবা অন্যবিধ জটিলতা এড়াতে এই রায়কে মোক্ষম ঢাল হিসেবে কাজে লাগাতে পারবেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com