জাতীয় সংসদে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে দৃশ্যত বিচার বিভাগকে তিন দিনের আলটিমেটাম দেওয়া একটা আশ্চর্য ঘটনা। এটা অজ্ঞতাপ্রসূত ধরব না, তিরটা যেন ছোড়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে বাঁচাতে। জনগণের চোখে প্রধান বিচারপতি প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমাদের বিজ্ঞ সাংসদদের মনে হয়, অতটা ক্ষতি নেই। প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিটা উজ্জ্বল থাকলেই হলো। আর সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে প্রধান বিচারপতিকে আলটিমেটাম দেওয়া। রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বানও কম উচ্চারিত থেকেছে।
দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি মন্তব্য বেশ খাসা। মানুষকে তাঁরা যে বোকা ভাবেন, এটা তারই প্রমাণ। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথম যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেমন, তেমনি বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারক অপসারণসংক্রান্ত অভিশংসনের বিধান ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দুটোই বাদ পড়ে। আর এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হুমকি দিয়েছেন, সংসদ চাইলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অভিশংসনের বিধান সংবিধানে প্রতিস্থাপন করতে পারে। ভাবখানা হলো, যদি তাদের হুমকিতে কাউন্সিল গঠিত হয় বা না হলেও তাদের অভিযুক্ত বিচারক পদত্যাগ করেন, তাহলে আর অভিশংসনের ব্যবস্থা আনবেন না। এমনকি প্রধান বিচারপতি যদি তাঁর এখতিয়ার হ্রাস করেন, তাহলেও তাঁরা কৃতার্থ থাকবেন। এই নিয়ে সংসদে বিতর্ক যা হলো, তাতে বর্তমান সংসদের চিন্তার দেউলিয়াত্ব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। বিচার বিভাগের এবড়োখেবড়ো স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের কোনো দায় নেই। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ-এর নতুন সংস্করণে সুপ্রিম কোর্টের একটি ধূসর প্রচ্ছদ ঠাঁই পেয়েছে। এর ঔজ্জ্বল্য যাতে ফেরে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা দেখা যায়নি।
জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ এবং হাইকোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির পটভূমিতে আমাদের জাতীয় সংসদ যদি অভিশংসনের বিধান ফিরিয়ে আনতে পারে, সেটা হবে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। গত সাড়ে তিন বছরে ব্যক্তিগত দায় মূল্যায়ন করলে তাঁদের উভয়ের কিছু ভালো ভূমিকা আমরা দেখেছি। তাঁদের যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ এবং পক্ষপাতিত্ব ভূমিকাও আমরা দেখেছি। সার্বিক বিচারে এই বিতর্ককে আমরা দুই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যগত লড়াই হিসেবে দেখতে পারলে বাধিত হতাম। এর আগে প্রায় দেড় শ বিচারককে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজ পদে পদোন্নতি দিলে সংসদীয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানালে একটা দ্বন্দ্ব হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের কোনো কর্মকর্তাও সংসদে যেতে বেঁকে বসেন, যা ছিল অগ্রহণযোগ্য। পরে আমরা দেখি, সেই জেলা জজ সংসদের বস্ফািরিত চোখের সামনে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু সংসদের তাতে মর্যাদার হানি ঘটেনি। স্পষ্টতই স্পিকার বলেই তাঁদের গায়ে ফোসকা পড়েছে। এর সঙ্গে তাই প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের বা জনস্বার্থের সম্পর্ক ঠুনকো কিংবা নেই বললেই চলে।
১৯৫৬ সালে প্রথম সংবিধান লিখতে বসে নীতিনির্ধারকেরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিচারক অপসারণে অভিশংসন, নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল? কাউন্সিল-প্রথার পক্ষে যুক্তি ছিল, নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের নবীন সাংসদেরা বিচারক অপসারণের মতো বড়দের খাবার হজম করতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের রীতি মেনে সংসদীয় অভিশংসন-প্রথা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রথমবারের মতো কাউন্সিল প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থার বড় সুবিধাভোগী সামরিক শাসকেরা। কারণ, সামরিক শাসনে সংসদ থাকে না। আর সংসদ না থাকলে অভিশংসন-প্রথা সচল হওয়ার প্রশ্ন আসে না। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে প্রথম অভিশংসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। কেবল নোটিশ দিয়ে বিচারক অপসারণের বিধান কায়েম করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমান দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আমদানি করেন। বড় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও সংসদীয় মহলে এই অনগ্রসর ও অকার্যকর ব্যবস্থা সম্পর্কে জোরালো অনাস্থা নেই। দুই বড় দলের বড় নেতারাও এর সমর্থক।
আজ সংসদকে যদি আলটিমেটামে বিশ্বাস করতে হয়, তবে সেটা প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে, প্রধান বিচারপতিকে নয়। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও পরের দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনাআপনি গঠিত হয়ে আছে। এটা কখনো গঠন করার প্রশ্ন আসে না। প্রশ্ন আসে কার্যধারা শুরু করতে বৈঠকে বসার। প্রথম আলোসহ গতকাল অনেক পত্রিকা বড় করে শিরোনাম ছেপেছে, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি’। সাংসদদের এমন বক্তব্য শুনে সাধারণ মানুষের ধারণা হবে, এই কাউন্সিল গঠন করার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির। আর প্রধান বিচারপতির অবস্থা এ ক্ষেত্রে আরও নাজুক। কারণ, তিনি পত্রিকায় বিবৃতি দিতে পারবেন না। সংসদকে বলতে পারবেন না যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে তাঁর এখতিয়ার নেই। অথচ সমস্যা যেখানে, সেই প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি তাঁর গায়ে বিতর্কের কালিমাটুকুও লাগবে না। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষমাকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। এর দায় নিরঙ্কুশভাবে একজন প্রধানমন্ত্রীর। টেলিভিশনে জনগণ দেখেছে, স্পিকারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যখন বক্তব্যের সূচনা ঘটে, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর আসনে বসা ছিলেন। একটু পরে তিনি চলে যান। এখন অনেকেরই চিন্তাভাবনা, এই বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী কী অবস্থান নেবেন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সাংসদদের আনুগত্য নিরঙ্কুশ করেছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ তাহলে কী? নিরাপদে এটুকু বলতে পারি, বিচারকসহ সব সাংবিধানিক পদধারীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকারের ব্যবস্থা নিতে হলে প্রধানমন্ত্রীর সবুজসংকেত লাগবেই।
সড়ক ভবন দ্রুত হস্তান্তর প্রশ্নে স্পিকার আবদুল হামিদ গত ২৯ মে বলেছেন, ‘সরকার কিংবা বিচার বিভাগ কারোরই এমন ভাবসাব হওয়া ঠিক নয় যে, আমি ক্ষমতা পেলাম একটা কিছু দেখাই। আদালতের রায়ে জনগণ ক্ষুব্ধ হলে কিংবা সরকার স্বৈরাচারী হলে উভয়ের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে পারে।’ তবে স্পিকার যে সুরে তা বলেছেন, তা সংসদীয় বিতর্কে অংশ নেওয়ার শামিল বলে প্রতীয়মান হতে পারে। সংসদীয় বিতর্কে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ স্পিকারের নেই। আবার এও সত্য যে সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদে যা বলা হবে, তার বৈধতা নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
প্রাচীন ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টের নাম ছিল হাইকোর্ট অব পার্লামেন্ট। কয়েক শ বছর লড়াই শেষে দুই পক্ষের মধ্যে একটা আপসরফা হয়। আদালত ও সংসদ যে যার মতো চলবে। কিন্তু বাস্তবে তো আর সেভাবে চলা সম্ভব নয়। তাই কে বড়, কে ছোট—একটা সরল বিতর্ক এসে যায়। কোনো সন্দেহ নেই, অভিশংসন একধরনের বিচারব্যবস্থা। প্রাচীনকালের সেই হাইকোর্ট অব পার্লামেন্ট, যেখানে বিচারসভা হতো, সেই বিচারসভাই আধুনিক ইতিহাসে অভিশংসন হিসেবে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সুতরাং, শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্বে বিচার বিভাগের একধরনের আসন রয়েছে। এক অর্থে তারও সার্বভৌমত্ব রয়েছে। কিন্তু স্পিকার-বিচারপতি যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে এই ধ্রুপদি বিতর্কের সম্পর্ক খুবই আলগা।
সংসদে অনুপস্থিত নাগরিকের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দেওয়া হয়। কিন্তু স্পিকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তা এক্সপাঞ্জ করেন বলে দেশবাসী জানতে পারে না। আমাদের অন্যতম আলোকবর্তিকা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের না বলা ‘আপত্তিকর’ উক্তিকে কেন্দ্র করে সংসদে উত্তেজনাকর বক্তব্য দেওয়া হয়। অসতর্ক মন্তব্য হতে পারে। ডেপুটি স্পিকার সে জন্য সংসদের বাইরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংসদ সদস্যদের সেই অযাচিত আক্রমণ সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিতে স্পিকার উদ্যোগী হননি। মনে হচ্ছে, আমরা একটা বড় সংকটে খাবি খেতে চলেছি। আর উচ্চতম পর্যায়ের অসৌজন্যমূলক সব বাগিবতণ্ডা তার আগমনী ফুলকি ছড়াচ্ছে।
আলোচ্য বিচারপতির আচরণগত দিক নিয়ে নাগরিক সমাজে যথেষ্ট জোরালো প্রশ্ন রয়েছে। তাঁর অনেকগুলোয় জনস্বার্থবিষয়ক প্রশংসনীয় আদেশ রয়েছে, তবে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন আদালতে নাগরিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ খুবই প্রাসঙ্গিক। এই অনুচ্ছেদ বলেছে, কাউকে লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এখানে সমস্যা আরও প্রকট। বিচারের আগেই লাঞ্ছনাকর দণ্ড। রিট মামলার বিবাদীকে আদালতে ডেকে দাঁড় করিয়ে রাখার নজির বাংলাদেশে নেই। ইংল্যান্ডের কয়েক শ বছরের ইতিহাসেও নেই। বিশেষ করে, নাগরিকদের প্রতি বিচারকদের অসৌজন্যমূলক মন্তব্য সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আচরণবিধিতে লেখা আছে, বিচারসংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বিচারককে অবশ্যই সৌজন্য দেখাতে হবে। সংবিধান ‘নৈতিকতা ও শালীনতা’ বজায় রাখার শর্তে সাংসদ, বিচারকসহ সব নাগরিকের বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
কদিন আগে একটি মার্কিনি চলচ্চিত্র (ক্লিন্ট ইস্টউড পরিচালিত চেইঞ্জলিং) দেখেছিলাম, তাতে একজন সন্দেহভাজন সিরিয়াল কিলার এজলাসে বসে ছিলেন। বিচারক তাঁকে বক্তব্য দেওয়ার সময়, জনাব সম্বোধন করে তাঁর বক্তব্য দিতে অনুরোধ করেছিলেন। বিচারালয়ে এই পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। আদালতে সৌজন্যতাসংক্রান্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের বহু দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলেও স্পিকার নিয়ে মন্তব্য করার আগ পর্যন্ত সংসদ মুখ বুজে থেকেছে। সরকারি দলের অপছন্দের কেউ কোথাও হেয়প্রতিপন্ন হলে তো কথাই নেই। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী বহু ঘটনায় আলোচিত-বিতর্কিত। আইজিপির চাকরি যায়। ট্রাফিক পুলিশ কান ধরে ওঠবস করে। সৈয়দ আবুল মকসুদকে তিনি মূর্খ ও হরিদাস পাল বলেন। অধ্যাপক আসিফ নজরুল যা বলেননি, তাই ধরে নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী তকমায় আদালতে ভূষিত হন। একজন ব্যারিস্টারকে জানি, তিনি আদালতকক্ষে লাঞ্ছিত হন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশ করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। স্পিকার যা বলেছেন, তা নিয়ে আদালতের উষ্মা থাকতে পারে। কিন্তু স্পিকারের বিরুদ্ধে আনা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ অভাবনীয়। কারণ, এই একটি অপরাধ নির্ধারণের দায় শুধু সরকারের। সরকারি ছাড়পত্র না থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহের কোনো মামলা আদালত আমলে নিলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে।
(আগামীকাল পড়ুন: সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের জবাবদিহি)।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি মন্তব্য বেশ খাসা। মানুষকে তাঁরা যে বোকা ভাবেন, এটা তারই প্রমাণ। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথম যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেমন, তেমনি বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারক অপসারণসংক্রান্ত অভিশংসনের বিধান ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দুটোই বাদ পড়ে। আর এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হুমকি দিয়েছেন, সংসদ চাইলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অভিশংসনের বিধান সংবিধানে প্রতিস্থাপন করতে পারে। ভাবখানা হলো, যদি তাদের হুমকিতে কাউন্সিল গঠিত হয় বা না হলেও তাদের অভিযুক্ত বিচারক পদত্যাগ করেন, তাহলে আর অভিশংসনের ব্যবস্থা আনবেন না। এমনকি প্রধান বিচারপতি যদি তাঁর এখতিয়ার হ্রাস করেন, তাহলেও তাঁরা কৃতার্থ থাকবেন। এই নিয়ে সংসদে বিতর্ক যা হলো, তাতে বর্তমান সংসদের চিন্তার দেউলিয়াত্ব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। বিচার বিভাগের এবড়োখেবড়ো স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের কোনো দায় নেই। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ-এর নতুন সংস্করণে সুপ্রিম কোর্টের একটি ধূসর প্রচ্ছদ ঠাঁই পেয়েছে। এর ঔজ্জ্বল্য যাতে ফেরে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা দেখা যায়নি।
জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ এবং হাইকোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির পটভূমিতে আমাদের জাতীয় সংসদ যদি অভিশংসনের বিধান ফিরিয়ে আনতে পারে, সেটা হবে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। গত সাড়ে তিন বছরে ব্যক্তিগত দায় মূল্যায়ন করলে তাঁদের উভয়ের কিছু ভালো ভূমিকা আমরা দেখেছি। তাঁদের যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ এবং পক্ষপাতিত্ব ভূমিকাও আমরা দেখেছি। সার্বিক বিচারে এই বিতর্ককে আমরা দুই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যগত লড়াই হিসেবে দেখতে পারলে বাধিত হতাম। এর আগে প্রায় দেড় শ বিচারককে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজ পদে পদোন্নতি দিলে সংসদীয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানালে একটা দ্বন্দ্ব হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের কোনো কর্মকর্তাও সংসদে যেতে বেঁকে বসেন, যা ছিল অগ্রহণযোগ্য। পরে আমরা দেখি, সেই জেলা জজ সংসদের বস্ফািরিত চোখের সামনে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু সংসদের তাতে মর্যাদার হানি ঘটেনি। স্পষ্টতই স্পিকার বলেই তাঁদের গায়ে ফোসকা পড়েছে। এর সঙ্গে তাই প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের বা জনস্বার্থের সম্পর্ক ঠুনকো কিংবা নেই বললেই চলে।
১৯৫৬ সালে প্রথম সংবিধান লিখতে বসে নীতিনির্ধারকেরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিচারক অপসারণে অভিশংসন, নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল? কাউন্সিল-প্রথার পক্ষে যুক্তি ছিল, নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের নবীন সাংসদেরা বিচারক অপসারণের মতো বড়দের খাবার হজম করতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের রীতি মেনে সংসদীয় অভিশংসন-প্রথা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রথমবারের মতো কাউন্সিল প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থার বড় সুবিধাভোগী সামরিক শাসকেরা। কারণ, সামরিক শাসনে সংসদ থাকে না। আর সংসদ না থাকলে অভিশংসন-প্রথা সচল হওয়ার প্রশ্ন আসে না। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে প্রথম অভিশংসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। কেবল নোটিশ দিয়ে বিচারক অপসারণের বিধান কায়েম করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমান দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আমদানি করেন। বড় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও সংসদীয় মহলে এই অনগ্রসর ও অকার্যকর ব্যবস্থা সম্পর্কে জোরালো অনাস্থা নেই। দুই বড় দলের বড় নেতারাও এর সমর্থক।
আজ সংসদকে যদি আলটিমেটামে বিশ্বাস করতে হয়, তবে সেটা প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে, প্রধান বিচারপতিকে নয়। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও পরের দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনাআপনি গঠিত হয়ে আছে। এটা কখনো গঠন করার প্রশ্ন আসে না। প্রশ্ন আসে কার্যধারা শুরু করতে বৈঠকে বসার। প্রথম আলোসহ গতকাল অনেক পত্রিকা বড় করে শিরোনাম ছেপেছে, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি’। সাংসদদের এমন বক্তব্য শুনে সাধারণ মানুষের ধারণা হবে, এই কাউন্সিল গঠন করার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির। আর প্রধান বিচারপতির অবস্থা এ ক্ষেত্রে আরও নাজুক। কারণ, তিনি পত্রিকায় বিবৃতি দিতে পারবেন না। সংসদকে বলতে পারবেন না যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে তাঁর এখতিয়ার নেই। অথচ সমস্যা যেখানে, সেই প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি তাঁর গায়ে বিতর্কের কালিমাটুকুও লাগবে না। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষমাকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। এর দায় নিরঙ্কুশভাবে একজন প্রধানমন্ত্রীর। টেলিভিশনে জনগণ দেখেছে, স্পিকারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যখন বক্তব্যের সূচনা ঘটে, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর আসনে বসা ছিলেন। একটু পরে তিনি চলে যান। এখন অনেকেরই চিন্তাভাবনা, এই বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী কী অবস্থান নেবেন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সাংসদদের আনুগত্য নিরঙ্কুশ করেছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ তাহলে কী? নিরাপদে এটুকু বলতে পারি, বিচারকসহ সব সাংবিধানিক পদধারীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকারের ব্যবস্থা নিতে হলে প্রধানমন্ত্রীর সবুজসংকেত লাগবেই।
সড়ক ভবন দ্রুত হস্তান্তর প্রশ্নে স্পিকার আবদুল হামিদ গত ২৯ মে বলেছেন, ‘সরকার কিংবা বিচার বিভাগ কারোরই এমন ভাবসাব হওয়া ঠিক নয় যে, আমি ক্ষমতা পেলাম একটা কিছু দেখাই। আদালতের রায়ে জনগণ ক্ষুব্ধ হলে কিংবা সরকার স্বৈরাচারী হলে উভয়ের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে পারে।’ তবে স্পিকার যে সুরে তা বলেছেন, তা সংসদীয় বিতর্কে অংশ নেওয়ার শামিল বলে প্রতীয়মান হতে পারে। সংসদীয় বিতর্কে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ স্পিকারের নেই। আবার এও সত্য যে সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদে যা বলা হবে, তার বৈধতা নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
প্রাচীন ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টের নাম ছিল হাইকোর্ট অব পার্লামেন্ট। কয়েক শ বছর লড়াই শেষে দুই পক্ষের মধ্যে একটা আপসরফা হয়। আদালত ও সংসদ যে যার মতো চলবে। কিন্তু বাস্তবে তো আর সেভাবে চলা সম্ভব নয়। তাই কে বড়, কে ছোট—একটা সরল বিতর্ক এসে যায়। কোনো সন্দেহ নেই, অভিশংসন একধরনের বিচারব্যবস্থা। প্রাচীনকালের সেই হাইকোর্ট অব পার্লামেন্ট, যেখানে বিচারসভা হতো, সেই বিচারসভাই আধুনিক ইতিহাসে অভিশংসন হিসেবে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সুতরাং, শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্বে বিচার বিভাগের একধরনের আসন রয়েছে। এক অর্থে তারও সার্বভৌমত্ব রয়েছে। কিন্তু স্পিকার-বিচারপতি যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে এই ধ্রুপদি বিতর্কের সম্পর্ক খুবই আলগা।
সংসদে অনুপস্থিত নাগরিকের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দেওয়া হয়। কিন্তু স্পিকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তা এক্সপাঞ্জ করেন বলে দেশবাসী জানতে পারে না। আমাদের অন্যতম আলোকবর্তিকা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের না বলা ‘আপত্তিকর’ উক্তিকে কেন্দ্র করে সংসদে উত্তেজনাকর বক্তব্য দেওয়া হয়। অসতর্ক মন্তব্য হতে পারে। ডেপুটি স্পিকার সে জন্য সংসদের বাইরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংসদ সদস্যদের সেই অযাচিত আক্রমণ সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিতে স্পিকার উদ্যোগী হননি। মনে হচ্ছে, আমরা একটা বড় সংকটে খাবি খেতে চলেছি। আর উচ্চতম পর্যায়ের অসৌজন্যমূলক সব বাগিবতণ্ডা তার আগমনী ফুলকি ছড়াচ্ছে।
আলোচ্য বিচারপতির আচরণগত দিক নিয়ে নাগরিক সমাজে যথেষ্ট জোরালো প্রশ্ন রয়েছে। তাঁর অনেকগুলোয় জনস্বার্থবিষয়ক প্রশংসনীয় আদেশ রয়েছে, তবে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন আদালতে নাগরিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ খুবই প্রাসঙ্গিক। এই অনুচ্ছেদ বলেছে, কাউকে লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এখানে সমস্যা আরও প্রকট। বিচারের আগেই লাঞ্ছনাকর দণ্ড। রিট মামলার বিবাদীকে আদালতে ডেকে দাঁড় করিয়ে রাখার নজির বাংলাদেশে নেই। ইংল্যান্ডের কয়েক শ বছরের ইতিহাসেও নেই। বিশেষ করে, নাগরিকদের প্রতি বিচারকদের অসৌজন্যমূলক মন্তব্য সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আচরণবিধিতে লেখা আছে, বিচারসংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বিচারককে অবশ্যই সৌজন্য দেখাতে হবে। সংবিধান ‘নৈতিকতা ও শালীনতা’ বজায় রাখার শর্তে সাংসদ, বিচারকসহ সব নাগরিকের বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
কদিন আগে একটি মার্কিনি চলচ্চিত্র (ক্লিন্ট ইস্টউড পরিচালিত চেইঞ্জলিং) দেখেছিলাম, তাতে একজন সন্দেহভাজন সিরিয়াল কিলার এজলাসে বসে ছিলেন। বিচারক তাঁকে বক্তব্য দেওয়ার সময়, জনাব সম্বোধন করে তাঁর বক্তব্য দিতে অনুরোধ করেছিলেন। বিচারালয়ে এই পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। আদালতে সৌজন্যতাসংক্রান্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের বহু দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলেও স্পিকার নিয়ে মন্তব্য করার আগ পর্যন্ত সংসদ মুখ বুজে থেকেছে। সরকারি দলের অপছন্দের কেউ কোথাও হেয়প্রতিপন্ন হলে তো কথাই নেই। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী বহু ঘটনায় আলোচিত-বিতর্কিত। আইজিপির চাকরি যায়। ট্রাফিক পুলিশ কান ধরে ওঠবস করে। সৈয়দ আবুল মকসুদকে তিনি মূর্খ ও হরিদাস পাল বলেন। অধ্যাপক আসিফ নজরুল যা বলেননি, তাই ধরে নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী তকমায় আদালতে ভূষিত হন। একজন ব্যারিস্টারকে জানি, তিনি আদালতকক্ষে লাঞ্ছিত হন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশ করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। স্পিকার যা বলেছেন, তা নিয়ে আদালতের উষ্মা থাকতে পারে। কিন্তু স্পিকারের বিরুদ্ধে আনা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ অভাবনীয়। কারণ, এই একটি অপরাধ নির্ধারণের দায় শুধু সরকারের। সরকারি ছাড়পত্র না থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহের কোনো মামলা আদালত আমলে নিলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে।
(আগামীকাল পড়ুন: সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের জবাবদিহি)।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন