মিজানুর রহমান খান
বিচার প্রশাসনে বজ্রপাত ঘটেছে। প্রায় ১৭০ জন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙিয়ে বিচার প্রশাসনের শীর্ষ পদ, যা একসময়ে কর্মরত হাইকোর্টের বিচারকও অলংকৃত করতেন, সেখানে এখন একজন আগন্তুকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তিনি আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক। জেলা জজ হিসেবে যাঁর একটি রায় লেখারও অভিজ্ঞতা নেই। শুধু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মতিতে তথাকথিত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ আইনসচিব নিয়োগের ঘটনা অবশ্য এই সরকারের আমলে এবারই প্রথম নয়।
স্পিকার-বিচারকের অসতর্ক উক্তিকে যখন অহেতুক বিচার বিভাগ-সংসদ মুখোমুখি হিসেবে দেখা হচ্ছে, তখন সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার দৃশ্যত মিলেমিশে একাকার। সরকার যে ফ্রিস্টাইলে বিচার প্রশাসন চালাচ্ছে, তার সর্বশেষ নজির কনিষ্ঠকে সর্বজ্যেষ্ঠদের ‘স্যার’ বানিয়ে দেওয়া। কিন্তু এ নিয়ে না সুপ্রিম কোর্ট, না সংসদ—কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
১৭ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে জানতে চাইলাম, এই নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে কি না। তিনি নিশ্চিত করলেন, এটা নেওয়া হয়নি। তবে শুধু এটুকুতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এর প্রেক্ষাপট যে গা শিউরে ওঠা। দু-চার দিনের জন্য কাউকে হয়তো দায়িত্ব দেওয়া চলে। দেশে কোনো ধরনের জরুরি অবস্থা, মহামারি কিংবা দুর্যোগও নেই। সুতরাং, এ রকম একটি সুনসান শান্ত অবস্থায় আইন, বিধিবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায় ভাঙার এমন যজ্ঞে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ শামিল হলেন কেন? কারণটা আকস্মিক নয়, যে নৈরাজ্য বিচার প্রশাসনে চলছে, তাতে এমন নিয়োগ আমাদের অবাক করেনি।
বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর তীব্র বিতর্ক দেখা দিল, বিচারকেরা আইন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী পদে প্রেষণে থাকবেন কি থাকবেন না। এ নিয়ে বিচারপতিদের মধ্যেও মতভেদ ছিল। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক্করণে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তারা বিচার প্রশাসন চালানোর কলকাঠি সরকার থেকে কেড়ে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে দিতে পারেনি।
আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলার আওতায় নিয়োগ বিধিমালা তৈরি করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে চলে আসা একটি বিধান নতুনরূপে গ্রহণ করা হয়। এতে বলা হয়, আইনসচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবসহ আইন ও বিচার ডিভিশনের ৭৫ ভাগ নির্বাহী পদ ‘বিচার বিভাগীয়’ বলে গণ্য হবে। জ্যেষ্ঠতম জেলা জজদের মধ্য থেকে যাঁরা মেধাবী ও বেশি যোগ্য, তাঁদের দ্বারা এই পদ পূরণ করতে হবে।
মাসদার হোসেন মামলায় মূল রায়দানকারী হলেন বিচারপতি মোস্তাফা কামাল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘বিচারকদের প্রেষণে নিয়োগের বিধান করে আপিল বিভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি।’ আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের (বর্তমানে ধর্মসচিব) নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ, তিনি বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি কর্মরত বিচারকদের জন্য আইনসচিবের মতো সংরক্ষিত পদে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। আমি কিছুদিন দ্বিধায় ছিলাম। কারণ, কাজী হাবিবুল দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুনামের অধিকারী। কিন্তু আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তকে সেদিন সমর্থন দিয়েছিলাম। বিচারপতি মোস্তাফা কামালের ভিন্নমতের সঙ্গে আপাতত একমত হওয়া যায় না বলেই স্থির করেছিলাম। তার নেপথ্যের কারণ ছিল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন।
আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার ডিভিশন বিচারকদের বদলি, কর্মস্থল নির্ধারণ ও শৃঙ্খলা দেখভাল করে। মূল সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, এটা সচিবালয়ে বসে নয়, সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায় বসে সরকারের পরামর্শ না নিয়ে করার কথা। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করল না আওয়ামী লীগ। তাই অবস্থাটি বদলানো গেল না। আপাতত দ্বৈত ব্যবস্থা মেনেছিলাম। কিন্তু সরকার ছলেবলে সুপ্রিম কোর্টকে আউট করে দিয়েছে। তবে কল্পনাও করতে পারিনি, বিচারকদের প্রেষণে থাকার কুফল এতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।
বিচার বিভাগ পৃথক্করণের উচ্ছ্বাস তখনো মিলিয়ে যায়নি। অধস্তন আদালতের বিচারকেরা দলাদলি ও কোন্দলে লিপ্ত হলেন। আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর পদগুলো লোভনীয় হিসেবে গণ্য হলো। প্রেষণই অনেকের প্রাণশক্তি এবং এসব পদ পেতে তদবির ও ধরাধরি শুরু হলো। বিচারিক রীতিনীতি, নীতি-নৈতিকতা—সবকিছুর দ্রুত বিসর্জন ঘটতে থাকল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচারক অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, আওয়ামীপন্থীরা এসে ঝটপট তাঁদের অপসারণ করলেন। আইন মন্ত্রণালয়ে সমিতির নেতারা দল বেঁধে এসেছিলেন। তাঁরা চাইছিলেন, অবিচারক কাজী হাবিবুল যাতে আইনসচিব হতে না পারেন। এ ঘটনায় সমিতির সভাপতি ও মহাসচিব, যাঁরা দুই জ্যেষ্ঠ জেলা জজ, তাঁদের অবৈধভাবে অপসারণ করে পুনর্বহালও করা হয়েছিল।
তবে সেই থেকে সমিতি সরকারের খাস তালুক। অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সমিতির সভাপতি প্রায় ২০০ জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে টপকে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে এবং মহাসচিব প্রায় ১৭০ জন জেলা জজকে টপকে বনে গেলেন আইনসচিব। দেশের প্রথম আইনসচিব ছিলেন হাইকোর্টে কর্মরত বিচারপতি ড. এফ কে এম এ মুনএম, যিনি পরে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন।
আশা করেছিলাম, আপিল বিভাগ নিজেদের জড়িয়ে বিচার প্রশাসন চালাতে যে আইন ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলে তৈরি করেছেন, তা তাঁরা নিজেরাও মেনে চলবেন।
কিন্তু আমরা গত সাড়ে তিন বছরে দেখলাম, বিচারকদের তদারকিতে বিচারকদের বদলি, কর্মস্থল নির্ধারণ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-অনাচার ঘটল এবং তা অব্যাহত। সরকার দিন দিন যত বেপরোয়া হয়ে উঠছে, সুপ্রিম কোর্ট যেন ততই উদাসীন হয়ে পড়ছেন।
সংবিধানের ১০৯ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধস্তন আদালতের প্রায় এক হাজার ৬০০ বিচারকের ভালোমন্দ দেখার দায় হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের।
দুই রকম দৃশ্য। পূর্ত মন্ত্রণালয় বিচারকদের বসতে দিতে সড়ক ভবন ছাড়ছে না। তাই আদালত অবমাননার রুল হলো। আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর পদগুলোতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে স্থায়ীভাবে বিচারকদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না; কিন্তু এতে আদালতের অবমাননা ঘটে না।
হাইকোর্ট বিভাগে সদ্য শপথ গ্রহণকারী বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস তথাকথিত দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনসচিব হিসেবে আট মাসের চেয়ে এক সপ্তাহ কম সময় কাটিয়ে এলেন। জ্যেষ্ঠ এবং তাঁর ব্যাচের প্রথম স্থান অধিকারী হয়েও তাঁকে অতিরিক্ত সচিব করার ফাইল সুপ্রিম কোর্টে আটকে ছিল। প্রধান বিচারপতির পরামর্শে তিনি হাইকোর্টের বিচারক হলেন। এর মানে দাঁড়ায়, অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যিনি প্রধান বিচারপতির স্বীকৃতি পান না, সেটা বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় একই ব্যক্তি একই প্রধান বিচারপতির পরামর্শে হাইকোর্টের বিচারক হতে পারেন। এবার হয়তো বিদায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবকে আমরা সড়ক ভবনের কোনো এজলাসে স্থায়ী বিচারকের আসনেই দেখতে পাব।
আমরা এমন অনেক কিছুতেই প্রমাণ পাচ্ছি, নিয়মকানুনের দিন ফুরাচ্ছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন ভিন্ন ফল মিলছে। বিচার প্রশাসন পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে চুরচুর হচ্ছে এবং তা যে অবশ্যই দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও অন্যরূপ ভয়ানক অনিয়ম-অনাচারের ইঙ্গিতবহ, তাতে আর সন্দেহ কী।
প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্ট কিংবা তাঁর পক্ষে বিচার প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন প্রশাসনিক প্রধান বিচারপতি এবং আইন মন্ত্রণালয়, যার পক্ষে মন্ত্রী, যিনি সরকারের পক্ষে বিচার প্রশাসন চালনা করে থাকেন, তাঁরা উভয়ে একটি পদ্ধতিগত ও সুপরিকল্পিতভাবে বিচার প্রশাসনে অভাবনীয় অনিয়ম সংঘটন কিংবা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন কি না কিংবা তেমনটা প্রতীয়মান হতে দিতে তাঁরা উদাসীন কি না।
ন্যায়বিচারে যদি প্রতীয়মান হওয়ার শর্ত গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে বিচার প্রশাসন চালানোয় ন্যায়বিচার যে চলছে, তা নিশ্চয় প্রতীয়মানযোগ্য বটে।
এটা আর কোনো আকস্মিক, মামুলি বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় যে আইন ও বিচার ডিভিশনের উচ্চতর পদগুলো বছরের পর বছর শূন্য রাখা হচ্ছে। এতে পছন্দের লোকেরাই নিয়োগ পাচ্ছেন; কিন্তু তাঁরা যাতে ভুলক্রমেও স্বাধীন সত্তায় কাজ না করতে পারেন, সে জন্য ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ হিসেবে একটি অদ্ভুত পরিভাষা উদ্ভাবন করা হয়েছে। উপসচিবদের দিয়ে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবের কাজ করানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিচার বিভাগের নৈতিকতা ও মনোবল পঙ্গু কিংবা প্রতিবন্ধী করে রাখতে এই ঝুলন্ত অব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে।
অনেক নিষ্ঠুর মা-বাবার পরিচয় আমরা পাই, যাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি করানোর জন্য নিজ সন্তানকে পঙ্গু করতে তাঁদের বুক কাঁপে না, চোখের লজ্জা তাঁদের থাকে কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর। বিচার প্রশাসন প্রতিবন্ধী হতে চলেছে।
এ দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যাতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেতে পারে, সে লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠীর (প্রধানত আওয়ামী ও বিএনপি নামীয় শক্তি) সুচতুর কৌশল সব সময় সক্রিয় থাকে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ মেনে নেওয়ার বাহবা ক্ষমতাসীন দল ষোলোআনাই ভোগ করতে চায়। কিন্তু তারা তাদের আলোচ্য কদর্য ও কুৎসিত রূপটি নেকাবের আড়ালে ঢেকে রেখেছে। বোমা মারলেও বিএনপির পেট থেকে এ বিষয়ে কথা বের হবে না। সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটা দেখেও না দেখার ভান করছেন কিংবা সুচিন্তিতভাবে সরকারকে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছেন কিংবা ঘণ্টা বাঁধতে ভয় পাচ্ছেন কিংবা দোদুল্যমান রয়েছেন।
আইন ও বিচার ডিভিশনে আইনসচিব, অতিরিক্ত সচিবের একটি করে এবং যুগ্ম সচিবের চারটি স্থায়ী পদ রয়েছে। এটা কি কোনো সুস্থ মানুষ মেনে নেবেন যে, সাড়ে তিন বছর ধরে এই ছয়টি পদ স্থায়ীভাবে শূন্য রাখা হয়েছে কোনো অসৎ মতলব ছাড়াই?
তিন বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের আইনসচিব পদ শূন্য ঘোষণা করে বলেন, ‘আমরাই এতে উপযুক্ত লোক বাছাই করে নিয়োগ দেব।’ কিন্তু তাঁরা দেননি। এমনকি ওই পদে নিয়োগদানের প্রাথমিক যে শর্ত—চারজন নিয়মিত যুগ্ম সচিব নিয়োগ, সেখানেও অচলাবস্থা চলছে।
একটি ব্যতিক্রম আছে। সুপ্রিম কোর্ট ও সংস্থাপনের পরামর্শক্রমে দুজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল ওই ডিভিশনের যুগ্ম সচিব পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই বিচারকদের একজন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার হয়ে হাইকোর্টের বিচারক হয়েছেন। অন্যজন কোটারি মহলের বিরাগভাজন হয়ে আজ নির্বাসিত। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধা।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এ রকমের ঊর্ধ্বতন পদগুলো কীভাবে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং সেখানে আমরা দালিলিকভাবেই একজন উপসচিবের বিশেষ ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি। এটা একটা সরকারদলীয় ফাঁদ। বিএনপির আমলে এক বিচারক খালেদা জিয়ার ছবি আইন মন্ত্রণালয়ে তাঁর কক্ষে আগলে রাখতেন। ‘ক্ষমতার কিছু অপব্যবহার করলেও তিনি বিচার প্রশাসনের আদি রীতিতে আঘাত করেননি। কিন্তু এবার তাঁর আওয়ামী উত্তরসূরি তাঁকে ইতিমধ্যে যথেষ্ট ছাড়িয়ে গেছেন।’ এমন কথা শোনা যায়। উপযুক্ত যোগ্যতা নেই, তাহলে কিসের মাপকাঠিতে তিনি সবাইকে টপকালেন! দলবাজি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আগামীকাল পড়ুন: প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী সংবিধান ভাঙছেন
বিচার প্রশাসনে বজ্রপাত ঘটেছে। প্রায় ১৭০ জন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙিয়ে বিচার প্রশাসনের শীর্ষ পদ, যা একসময়ে কর্মরত হাইকোর্টের বিচারকও অলংকৃত করতেন, সেখানে এখন একজন আগন্তুকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তিনি আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক। জেলা জজ হিসেবে যাঁর একটি রায় লেখারও অভিজ্ঞতা নেই। শুধু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মতিতে তথাকথিত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ আইনসচিব নিয়োগের ঘটনা অবশ্য এই সরকারের আমলে এবারই প্রথম নয়।
স্পিকার-বিচারকের অসতর্ক উক্তিকে যখন অহেতুক বিচার বিভাগ-সংসদ মুখোমুখি হিসেবে দেখা হচ্ছে, তখন সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার দৃশ্যত মিলেমিশে একাকার। সরকার যে ফ্রিস্টাইলে বিচার প্রশাসন চালাচ্ছে, তার সর্বশেষ নজির কনিষ্ঠকে সর্বজ্যেষ্ঠদের ‘স্যার’ বানিয়ে দেওয়া। কিন্তু এ নিয়ে না সুপ্রিম কোর্ট, না সংসদ—কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
১৭ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে জানতে চাইলাম, এই নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে কি না। তিনি নিশ্চিত করলেন, এটা নেওয়া হয়নি। তবে শুধু এটুকুতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এর প্রেক্ষাপট যে গা শিউরে ওঠা। দু-চার দিনের জন্য কাউকে হয়তো দায়িত্ব দেওয়া চলে। দেশে কোনো ধরনের জরুরি অবস্থা, মহামারি কিংবা দুর্যোগও নেই। সুতরাং, এ রকম একটি সুনসান শান্ত অবস্থায় আইন, বিধিবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায় ভাঙার এমন যজ্ঞে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ শামিল হলেন কেন? কারণটা আকস্মিক নয়, যে নৈরাজ্য বিচার প্রশাসনে চলছে, তাতে এমন নিয়োগ আমাদের অবাক করেনি।
বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর তীব্র বিতর্ক দেখা দিল, বিচারকেরা আইন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী পদে প্রেষণে থাকবেন কি থাকবেন না। এ নিয়ে বিচারপতিদের মধ্যেও মতভেদ ছিল। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক্করণে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তারা বিচার প্রশাসন চালানোর কলকাঠি সরকার থেকে কেড়ে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে দিতে পারেনি।
আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলার আওতায় নিয়োগ বিধিমালা তৈরি করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে চলে আসা একটি বিধান নতুনরূপে গ্রহণ করা হয়। এতে বলা হয়, আইনসচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবসহ আইন ও বিচার ডিভিশনের ৭৫ ভাগ নির্বাহী পদ ‘বিচার বিভাগীয়’ বলে গণ্য হবে। জ্যেষ্ঠতম জেলা জজদের মধ্য থেকে যাঁরা মেধাবী ও বেশি যোগ্য, তাঁদের দ্বারা এই পদ পূরণ করতে হবে।
মাসদার হোসেন মামলায় মূল রায়দানকারী হলেন বিচারপতি মোস্তাফা কামাল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘বিচারকদের প্রেষণে নিয়োগের বিধান করে আপিল বিভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি।’ আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের (বর্তমানে ধর্মসচিব) নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ, তিনি বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি কর্মরত বিচারকদের জন্য আইনসচিবের মতো সংরক্ষিত পদে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। আমি কিছুদিন দ্বিধায় ছিলাম। কারণ, কাজী হাবিবুল দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুনামের অধিকারী। কিন্তু আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তকে সেদিন সমর্থন দিয়েছিলাম। বিচারপতি মোস্তাফা কামালের ভিন্নমতের সঙ্গে আপাতত একমত হওয়া যায় না বলেই স্থির করেছিলাম। তার নেপথ্যের কারণ ছিল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন।
আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার ডিভিশন বিচারকদের বদলি, কর্মস্থল নির্ধারণ ও শৃঙ্খলা দেখভাল করে। মূল সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, এটা সচিবালয়ে বসে নয়, সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায় বসে সরকারের পরামর্শ না নিয়ে করার কথা। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করল না আওয়ামী লীগ। তাই অবস্থাটি বদলানো গেল না। আপাতত দ্বৈত ব্যবস্থা মেনেছিলাম। কিন্তু সরকার ছলেবলে সুপ্রিম কোর্টকে আউট করে দিয়েছে। তবে কল্পনাও করতে পারিনি, বিচারকদের প্রেষণে থাকার কুফল এতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।
বিচার বিভাগ পৃথক্করণের উচ্ছ্বাস তখনো মিলিয়ে যায়নি। অধস্তন আদালতের বিচারকেরা দলাদলি ও কোন্দলে লিপ্ত হলেন। আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর পদগুলো লোভনীয় হিসেবে গণ্য হলো। প্রেষণই অনেকের প্রাণশক্তি এবং এসব পদ পেতে তদবির ও ধরাধরি শুরু হলো। বিচারিক রীতিনীতি, নীতি-নৈতিকতা—সবকিছুর দ্রুত বিসর্জন ঘটতে থাকল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচারক অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, আওয়ামীপন্থীরা এসে ঝটপট তাঁদের অপসারণ করলেন। আইন মন্ত্রণালয়ে সমিতির নেতারা দল বেঁধে এসেছিলেন। তাঁরা চাইছিলেন, অবিচারক কাজী হাবিবুল যাতে আইনসচিব হতে না পারেন। এ ঘটনায় সমিতির সভাপতি ও মহাসচিব, যাঁরা দুই জ্যেষ্ঠ জেলা জজ, তাঁদের অবৈধভাবে অপসারণ করে পুনর্বহালও করা হয়েছিল।
তবে সেই থেকে সমিতি সরকারের খাস তালুক। অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সমিতির সভাপতি প্রায় ২০০ জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে টপকে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে এবং মহাসচিব প্রায় ১৭০ জন জেলা জজকে টপকে বনে গেলেন আইনসচিব। দেশের প্রথম আইনসচিব ছিলেন হাইকোর্টে কর্মরত বিচারপতি ড. এফ কে এম এ মুনএম, যিনি পরে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন।
আশা করেছিলাম, আপিল বিভাগ নিজেদের জড়িয়ে বিচার প্রশাসন চালাতে যে আইন ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলে তৈরি করেছেন, তা তাঁরা নিজেরাও মেনে চলবেন।
কিন্তু আমরা গত সাড়ে তিন বছরে দেখলাম, বিচারকদের তদারকিতে বিচারকদের বদলি, কর্মস্থল নির্ধারণ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-অনাচার ঘটল এবং তা অব্যাহত। সরকার দিন দিন যত বেপরোয়া হয়ে উঠছে, সুপ্রিম কোর্ট যেন ততই উদাসীন হয়ে পড়ছেন।
সংবিধানের ১০৯ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধস্তন আদালতের প্রায় এক হাজার ৬০০ বিচারকের ভালোমন্দ দেখার দায় হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের।
দুই রকম দৃশ্য। পূর্ত মন্ত্রণালয় বিচারকদের বসতে দিতে সড়ক ভবন ছাড়ছে না। তাই আদালত অবমাননার রুল হলো। আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর পদগুলোতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে স্থায়ীভাবে বিচারকদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না; কিন্তু এতে আদালতের অবমাননা ঘটে না।
হাইকোর্ট বিভাগে সদ্য শপথ গ্রহণকারী বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস তথাকথিত দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনসচিব হিসেবে আট মাসের চেয়ে এক সপ্তাহ কম সময় কাটিয়ে এলেন। জ্যেষ্ঠ এবং তাঁর ব্যাচের প্রথম স্থান অধিকারী হয়েও তাঁকে অতিরিক্ত সচিব করার ফাইল সুপ্রিম কোর্টে আটকে ছিল। প্রধান বিচারপতির পরামর্শে তিনি হাইকোর্টের বিচারক হলেন। এর মানে দাঁড়ায়, অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যিনি প্রধান বিচারপতির স্বীকৃতি পান না, সেটা বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় একই ব্যক্তি একই প্রধান বিচারপতির পরামর্শে হাইকোর্টের বিচারক হতে পারেন। এবার হয়তো বিদায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবকে আমরা সড়ক ভবনের কোনো এজলাসে স্থায়ী বিচারকের আসনেই দেখতে পাব।
আমরা এমন অনেক কিছুতেই প্রমাণ পাচ্ছি, নিয়মকানুনের দিন ফুরাচ্ছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন ভিন্ন ফল মিলছে। বিচার প্রশাসন পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে চুরচুর হচ্ছে এবং তা যে অবশ্যই দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও অন্যরূপ ভয়ানক অনিয়ম-অনাচারের ইঙ্গিতবহ, তাতে আর সন্দেহ কী।
প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্ট কিংবা তাঁর পক্ষে বিচার প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন প্রশাসনিক প্রধান বিচারপতি এবং আইন মন্ত্রণালয়, যার পক্ষে মন্ত্রী, যিনি সরকারের পক্ষে বিচার প্রশাসন চালনা করে থাকেন, তাঁরা উভয়ে একটি পদ্ধতিগত ও সুপরিকল্পিতভাবে বিচার প্রশাসনে অভাবনীয় অনিয়ম সংঘটন কিংবা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন কি না কিংবা তেমনটা প্রতীয়মান হতে দিতে তাঁরা উদাসীন কি না।
ন্যায়বিচারে যদি প্রতীয়মান হওয়ার শর্ত গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে বিচার প্রশাসন চালানোয় ন্যায়বিচার যে চলছে, তা নিশ্চয় প্রতীয়মানযোগ্য বটে।
এটা আর কোনো আকস্মিক, মামুলি বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় যে আইন ও বিচার ডিভিশনের উচ্চতর পদগুলো বছরের পর বছর শূন্য রাখা হচ্ছে। এতে পছন্দের লোকেরাই নিয়োগ পাচ্ছেন; কিন্তু তাঁরা যাতে ভুলক্রমেও স্বাধীন সত্তায় কাজ না করতে পারেন, সে জন্য ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ হিসেবে একটি অদ্ভুত পরিভাষা উদ্ভাবন করা হয়েছে। উপসচিবদের দিয়ে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবের কাজ করানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিচার বিভাগের নৈতিকতা ও মনোবল পঙ্গু কিংবা প্রতিবন্ধী করে রাখতে এই ঝুলন্ত অব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে।
অনেক নিষ্ঠুর মা-বাবার পরিচয় আমরা পাই, যাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি করানোর জন্য নিজ সন্তানকে পঙ্গু করতে তাঁদের বুক কাঁপে না, চোখের লজ্জা তাঁদের থাকে কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর। বিচার প্রশাসন প্রতিবন্ধী হতে চলেছে।
এ দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যাতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেতে পারে, সে লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠীর (প্রধানত আওয়ামী ও বিএনপি নামীয় শক্তি) সুচতুর কৌশল সব সময় সক্রিয় থাকে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ মেনে নেওয়ার বাহবা ক্ষমতাসীন দল ষোলোআনাই ভোগ করতে চায়। কিন্তু তারা তাদের আলোচ্য কদর্য ও কুৎসিত রূপটি নেকাবের আড়ালে ঢেকে রেখেছে। বোমা মারলেও বিএনপির পেট থেকে এ বিষয়ে কথা বের হবে না। সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটা দেখেও না দেখার ভান করছেন কিংবা সুচিন্তিতভাবে সরকারকে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছেন কিংবা ঘণ্টা বাঁধতে ভয় পাচ্ছেন কিংবা দোদুল্যমান রয়েছেন।
আইন ও বিচার ডিভিশনে আইনসচিব, অতিরিক্ত সচিবের একটি করে এবং যুগ্ম সচিবের চারটি স্থায়ী পদ রয়েছে। এটা কি কোনো সুস্থ মানুষ মেনে নেবেন যে, সাড়ে তিন বছর ধরে এই ছয়টি পদ স্থায়ীভাবে শূন্য রাখা হয়েছে কোনো অসৎ মতলব ছাড়াই?
তিন বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের আইনসচিব পদ শূন্য ঘোষণা করে বলেন, ‘আমরাই এতে উপযুক্ত লোক বাছাই করে নিয়োগ দেব।’ কিন্তু তাঁরা দেননি। এমনকি ওই পদে নিয়োগদানের প্রাথমিক যে শর্ত—চারজন নিয়মিত যুগ্ম সচিব নিয়োগ, সেখানেও অচলাবস্থা চলছে।
একটি ব্যতিক্রম আছে। সুপ্রিম কোর্ট ও সংস্থাপনের পরামর্শক্রমে দুজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল ওই ডিভিশনের যুগ্ম সচিব পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই বিচারকদের একজন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার হয়ে হাইকোর্টের বিচারক হয়েছেন। অন্যজন কোটারি মহলের বিরাগভাজন হয়ে আজ নির্বাসিত। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধা।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এ রকমের ঊর্ধ্বতন পদগুলো কীভাবে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং সেখানে আমরা দালিলিকভাবেই একজন উপসচিবের বিশেষ ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি। এটা একটা সরকারদলীয় ফাঁদ। বিএনপির আমলে এক বিচারক খালেদা জিয়ার ছবি আইন মন্ত্রণালয়ে তাঁর কক্ষে আগলে রাখতেন। ‘ক্ষমতার কিছু অপব্যবহার করলেও তিনি বিচার প্রশাসনের আদি রীতিতে আঘাত করেননি। কিন্তু এবার তাঁর আওয়ামী উত্তরসূরি তাঁকে ইতিমধ্যে যথেষ্ট ছাড়িয়ে গেছেন।’ এমন কথা শোনা যায়। উপযুক্ত যোগ্যতা নেই, তাহলে কিসের মাপকাঠিতে তিনি সবাইকে টপকালেন! দলবাজি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আগামীকাল পড়ুন: প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী সংবিধান ভাঙছেন