মিজানুর রহমান খান
একজন সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ ম্লান হয়ে গেল। পদ্মা সেতু নিয়ে কথিত দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে তির ছুড়েছে বিশ্বব্যাংক। সেই তিরে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদকের চেয়ারম্যান কি বিদ্ধ হননি?
দুদকের কাছ থেকে সৈয়দ আবুল হোসেন সততার সনদ নিয়েছিলেন। এখন অর্থমন্ত্রীকে সনদ দেবে কে? খোদ দুদকের চেয়ারম্যানও শরাহত। একাদিক্রমে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশের মর্যাদার জন্য এ ঘটনা মারাত্মক আঘাত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি বিরোধী দল করতে পারেনি, সেই ক্ষতি ও ক্ষত সৃষ্টি করল বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভূমিকায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছে। তবে তাদের এই অভিযোগ সঠিক কি না, সেটা নিশ্চয়ই যাচাইসাপেক্ষ। চুক্তি বাতিল হওয়া নয়, আমরা লজ্জিত সরকারপ্রধানকেও অভিযুক্ত করায়। সুতরাং আমরা তাঁদের কাছ থেকেই পৃথক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য আশা করতে পারি।
২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত কিংবা আকস্মিক নয়। প্রশ্ন হলো, এরপর কী? বিশ্বব্যাংকের কঠোর অবস্থানের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে যে ধরনের অবহেলা ও ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ও ভাবমূর্তি আপাতত তলানিতে ঠেকেছে।
বিশ্বব্যাংকের বর্তমান অবস্থানকে খোদ অর্থমন্ত্রীর দ্বারা বিদায়ী সভাপতি রবার্ট জোয়েলিকের ‘ব্যক্তিগত’ মন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা বড়ই পীড়াদায়ক। জোয়েলিকের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বাংলাদেশ কী পাবে? জোয়েলিক বুশ-আমলে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ২৯ নভেম্বরে ঋণচুক্তি বাতিলের তারিখে বিশ্বব্যাংক আরও একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে তারা জোয়েলিকের নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছে, তিনি বিশ্বব্যাংককে আধুনিক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গতিশীল, নমনীয় এবং সেই সঙ্গে সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছেন। অনেকের ধারণা, জোয়েলিক তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১ জুলাই জোয়েলিক আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিলেও বর্তমান সভাপতি কিম কিন্তু গত এপ্রিল থেকেই তাঁর দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার তালিম নিতে শুরু করেন। ১৬ এপ্রিল কিম এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তাই বলেছিলেন, ‘আমি জোয়েলিকের সঙ্গে ক্রান্তিকালে (্এপ্রিল-জুন) কাজ করার সুযোগ পেয়ে বাধিত। জোয়েলিক এই অঞ্চল, বিশেষ করে ভারতকে খুব ভালো চেনেন। গঙ্গা নদী ও সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষ অর্থায়নে তাঁর ভূমিকা আছে। গত মার্চে চতুর্থবারের মতো ভারত সফর করেন তিনি।’
আমাদের কূটনীতিক ও রাজনীতিকেরা যদি দাবি করেন যে তাঁরা ভারতীয় কূটনীতিতে মুগ্ধ, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ নিহিত, তাহলে আমরা একটা হিসাব মেলাতে পারি না। বিশ্বব্যাংক দুনিয়ার কোথায় কোথায় কী কী অনৈতিক কাজ করেছে, তা আমরা অবশ্যই বিবেচনায় নেব, তবে এই হিসাবটা মেলাতে হবে।
হিলারি ক্লিনটনের আলোচিত ঢাকা-দিল্লি সফরের আগে গত ২৭ এপ্রিল হনলুলুতে রবার্ট ও ব্লেক একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। এতে পদ্মা সেতুর বিষয়ে ব্লেক যা উল্লেখ করেন, তার একটি অনুচ্ছেদ এখানে হুবহু তুলে ধরছি: ‘প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে একটি সফল সফর সম্পন্ন করেন, যাতে পর্যায়ক্রমে সম্পর্কের উন্নয়নে অঙ্গীকার ছিল। উভয় পক্ষ বাণিজ্য উদারীকরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং ভারত পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়েছে। এই সেতু উভয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম কানেকটিভিটির যে রূপকল্প, তার জন্যও পদ্মা সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপর আমরা হিলারি ক্লিনটনের নিষ্প্রভ সফর দেখলাম। উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোর সঙ্গে টাকা-কড়ি নিয়ে কারবারকারী বিশ্বে যত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার শীর্ষে বিশ্বব্যাংক, বস্তুত বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কাজে লাগে, তুলনা করার মতো আর কোনো নখদন্তপূর্ণ সংস্থা দুনিয়ায় নেই। আর এই প্রতিষ্ঠানটি সব সুনাম-দুর্নাম নিয়ে ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়ার পর থেকে একটি মাত্র দেশের কক্ষপুটে লালিত হচ্ছে। এই দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র। পদাধিকারীর মতো দেশাধিকারবলে ৬৮ বছর ধরে শুধু মার্কিন নাগরিকেরাই বিশ্বব্যাংকের সভাপতির পদে বসতে পেরেছেন। এবারই প্রথম ড. কিম মার্কিন প্রার্থী হয়েও একটু প্রচারাভিযানে বেরিয়েছিলেন। কিম যথারীতি ভারতেও ভোট চাইতে আসেন। এই পদটি মার্কিনদের মুঠো থেকে বেরোনোর প্রশ্নটি সম্ভবত দেশটির বৃহৎ শক্তির প্রাণশক্তিসূত্রে গাঁথা।
আমরা এই অঞ্চলে জোয়েলিক-জমানায় কী দেখলাম? এটা মনমোহন-শেখ হাসিনার সম্প্রীতির জমানাও বটে। হিলারির ঢাকা সফরের মাত্র এক মাস আগে জোয়েলিক ভারত সফর করেন। এ সময় তিনি বাংলা-ভারত সম্পর্কের দুই অনুঘটক প্রণব-চিদাম্বরমের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনা করেন। গত ৩০ মার্চ জোয়েলিক দিল্লিতে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত তাঁর মেয়াদেই সর্বোচ্চ ৪২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে।
বিশ্বব্যাংক মানেই আমেরিকার ব্যাংক। আইএমএফ ও ডব্লিউটিওর সভাপতি, জাতিসংঘের মহাসচিব এমনকি কোনো আঞ্চলিক ব্যাংকের প্রধান পদে কখনো কোনো মার্কিনকে দেখা যায়নি। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের দেশটিকে বহুপক্ষীয় ফোরামে সক্রিয় দেখতে চাইলে একটি পদতো যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে রসিকতা করে জোয়েলিক অবশ্য বলতে ভোলেননি যে আমি অবশ্য বলি না যে, সেটা বিশ্বব্যাংকই হতে হবে। সুতরাং বিশ্বব্যাংককে বশ করার জাদুটা ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ওপর অনেকটা বা যথেষ্ট নির্ভর করে বৈকি।
জোয়েলিক ভারতের জন্য কী করেছেন, তা তাঁর জবানিতে শুনুন: ‘একক ঋণগ্রহীতা হিসেবে শুধু ভারতের জন্য সিলিং বাড়াতে আমি বিশ্বব্যাংক বোর্ডকে রাজি করাতে সক্ষম হই। অন্য সব দেশের চেয়ে ভারতের একক ঋণ গ্রহণ সর্বোচ্চ দেখে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। কারণ, ভারতের সঙ্গে আমরা সমবায় গড়েছি।’
এখন পাঠকই বলুন, আমাদের অর্থমন্ত্রী জোয়েলিক-সংক্রান্ত তাঁর আলোচ্য মন্তব্যকে প্রলাপ না বিলাপ বলবেন? জোয়েলিক-বর্ণিত সমবায় সমিতিতে বাংলাদেশ যদি আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলেই ঢুকতে না পারল, বরং বহিষ্কৃত হলো, তাহলে আমাদের কূটনীতির ভবিষ্যৎ কী। একজন সম্মানিত ব্যক্তির নাম ভাঙিয়েও আওয়ামী লীগের পাইক-বরকন্দাজ বিশ্বব্যাংক কূটনীতিতে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে।
ভারতের ভাবি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যদি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দরাজ দিলে বলতে পারেন যে ‘জোয়েলিক ভারতের প্রকৃত বন্ধু’, তাহলে বাংলাদেশ কেন তাঁকে শত্রু ভাবল। প্রণব মনে করেন, জোয়েলিকের হাতেই ভারত-বিশ্বব্যাংক সম্পর্ক একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
তাই যদি হবে, তাহলে আমরা বিশ্বব্যাংকের ট্রেন ফেল করলাম কেন? এই লেখক জোয়েলিককে বাংলাদেশের শত্রু ভাবতে কোনো রসদ খুঁজে পাননি। বরং আমরা দেখি, জোয়েলিক বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক। তাঁর কথায়, ‘নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ অগ্রগতি করছে। মানব উন্নয়ন সাফল্য অসাধারণ। দেশটির বিরাট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও তার সাফল্যের জন্য সে “বাংলাদেশ প্যারাডক্স” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত উপাখ্যান আমরা জানি। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালেই বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যে এমন বিবৃতি দিতে পারে, তা ধারণার বাইরে ছিল। তারা যথেষ্ট কড়া ভাষায় ও উষ্মার সঙ্গে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রকে দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। খুব নির্দিষ্ট করে বললে বিশ্বব্যাংক তাদের দাবি অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়া এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার
না করার জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে উল্লিখিত তিনজনকেই শনাক্ত করেছে। তাদের সুরটা হলো, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’।
গত সেপ্টেম্বরেই এসএনসির দপ্তরে কানাডীয় পুলিশ হানা দিয়েছিল। এর বিপরীতে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র গণমাধ্যমের ওপর নানা ছলছুতায় বাক্যবাণ ও কটূক্তি করে চলেছে।
বিশ্বব্যাংকের গত এপ্রিলের প্রতিবেদন, যা প্রধানমন্ত্রী ও দুদকের কার্যালয়ে রয়েছে বলে ধারণা করি, তার বিস্তারিত না জানা পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের দাবির বিষয়ে আমরা কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করতে পারি না। তবে এমন অভিযোগ নিয়ে আমাদের সরকারের যে পলায়নপর ও আনাড়ি মোকাবিলা, তার সমালোচনা আমরা করি। পদ্মা সেতু প্রকল্প নেহাত একটি জাতীয় উন্নয়নের বিষয় নয়, এর যে একটি বহুপক্ষীয় কিংবা আন্তর্জাতিক মাত্রা রয়েছে। এর সঙ্গে যে রাজনীতি ও কূটনীতি বোধযোগ্য, তার প্রতি আমাদের সরকারের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আমাদের শঙ্কিত করে। দেশ-দশের স্বার্থটাই যেন ঠুনকো, আর সবই শ্রেষ্ঠ।
দুদক আমাদের ছেলে ভোলানো ছড়া শুনিয়েই যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে আমরা একটি বিকল্প পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলাম। সেই তিন সূত্র মানা কঠিন ছিল না। অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহভাজন সব কর্মকর্তাকে ছুটিতে রাখা, দুদকের আওতায় একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন ও বিশ্বব্যাংক নিযুক্ত একটি প্যানেলকে দুদকের কমিটির সঙ্গে কাজ
করতে দেওয়া। ওবায়দুল কাদের বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করছেন। কিন্তু তিনি কী বলবেন, কেন এই তিন সূত্র মানা সরকারের পক্ষে কঠিন ছিল? কেন তারা এটা না করে মালয়েশিয়াসহ নানা দুয়ারে দৌড়াদৌড়ি করছিল?
দুদকের চেয়ারম্যান এমন একটি সময়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন, যখন বিশ্বব্যাংক ত্যক্তবিরক্ত হয়ে চরম সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রহর গুনছিল। আমরা কি ধরে নেব, বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কথা সরকার আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। কোনো সম্মানজনক সমাধানের চেষ্টা করলে তারা তিন সূত্র নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। এর বিপরীতে আমরা দেখলাম, সাংবাদিক ঠেকানোর কর্মসূচি নেওয়া হলো। কিন্তু বাংলাদেশি সাংবাদিক ঠেকানো গেলেও বিশ্বব্যাংককে ঠেকানো যায়নি। বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণের দিকে অন্ধ হয়ে থাকতে পারে না, উচিত নয় এবং থাকবে না।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে না দেখতে বিশ্বব্যাংক প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদকের চেয়ারম্যানকে অভিযুক্ত করার পরে আমি মনে করি না যে দুদকের চলমান তদন্ত আরও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারে। অন্তত এই অভিযোগ ভিন্নতর উপায়ে তদন্তের দাবি রাখে। বিষয়টি শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, ধরে নেওয়াই ভালো যে, এতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদারদের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে বা হবে। বিশ্বব্যাংক সেদিকে ইঙ্গিতটা কিন্তু অস্পষ্ট রাখেনি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
দুদকের কাছ থেকে সৈয়দ আবুল হোসেন সততার সনদ নিয়েছিলেন। এখন অর্থমন্ত্রীকে সনদ দেবে কে? খোদ দুদকের চেয়ারম্যানও শরাহত। একাদিক্রমে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশের মর্যাদার জন্য এ ঘটনা মারাত্মক আঘাত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি বিরোধী দল করতে পারেনি, সেই ক্ষতি ও ক্ষত সৃষ্টি করল বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভূমিকায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছে। তবে তাদের এই অভিযোগ সঠিক কি না, সেটা নিশ্চয়ই যাচাইসাপেক্ষ। চুক্তি বাতিল হওয়া নয়, আমরা লজ্জিত সরকারপ্রধানকেও অভিযুক্ত করায়। সুতরাং আমরা তাঁদের কাছ থেকেই পৃথক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য আশা করতে পারি।
২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত কিংবা আকস্মিক নয়। প্রশ্ন হলো, এরপর কী? বিশ্বব্যাংকের কঠোর অবস্থানের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে যে ধরনের অবহেলা ও ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ও ভাবমূর্তি আপাতত তলানিতে ঠেকেছে।
বিশ্বব্যাংকের বর্তমান অবস্থানকে খোদ অর্থমন্ত্রীর দ্বারা বিদায়ী সভাপতি রবার্ট জোয়েলিকের ‘ব্যক্তিগত’ মন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা বড়ই পীড়াদায়ক। জোয়েলিকের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বাংলাদেশ কী পাবে? জোয়েলিক বুশ-আমলে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ২৯ নভেম্বরে ঋণচুক্তি বাতিলের তারিখে বিশ্বব্যাংক আরও একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে তারা জোয়েলিকের নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছে, তিনি বিশ্বব্যাংককে আধুনিক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গতিশীল, নমনীয় এবং সেই সঙ্গে সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছেন। অনেকের ধারণা, জোয়েলিক তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১ জুলাই জোয়েলিক আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিলেও বর্তমান সভাপতি কিম কিন্তু গত এপ্রিল থেকেই তাঁর দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার তালিম নিতে শুরু করেন। ১৬ এপ্রিল কিম এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তাই বলেছিলেন, ‘আমি জোয়েলিকের সঙ্গে ক্রান্তিকালে (্এপ্রিল-জুন) কাজ করার সুযোগ পেয়ে বাধিত। জোয়েলিক এই অঞ্চল, বিশেষ করে ভারতকে খুব ভালো চেনেন। গঙ্গা নদী ও সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষ অর্থায়নে তাঁর ভূমিকা আছে। গত মার্চে চতুর্থবারের মতো ভারত সফর করেন তিনি।’
আমাদের কূটনীতিক ও রাজনীতিকেরা যদি দাবি করেন যে তাঁরা ভারতীয় কূটনীতিতে মুগ্ধ, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ নিহিত, তাহলে আমরা একটা হিসাব মেলাতে পারি না। বিশ্বব্যাংক দুনিয়ার কোথায় কোথায় কী কী অনৈতিক কাজ করেছে, তা আমরা অবশ্যই বিবেচনায় নেব, তবে এই হিসাবটা মেলাতে হবে।
হিলারি ক্লিনটনের আলোচিত ঢাকা-দিল্লি সফরের আগে গত ২৭ এপ্রিল হনলুলুতে রবার্ট ও ব্লেক একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। এতে পদ্মা সেতুর বিষয়ে ব্লেক যা উল্লেখ করেন, তার একটি অনুচ্ছেদ এখানে হুবহু তুলে ধরছি: ‘প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে একটি সফল সফর সম্পন্ন করেন, যাতে পর্যায়ক্রমে সম্পর্কের উন্নয়নে অঙ্গীকার ছিল। উভয় পক্ষ বাণিজ্য উদারীকরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং ভারত পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়েছে। এই সেতু উভয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম কানেকটিভিটির যে রূপকল্প, তার জন্যও পদ্মা সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপর আমরা হিলারি ক্লিনটনের নিষ্প্রভ সফর দেখলাম। উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোর সঙ্গে টাকা-কড়ি নিয়ে কারবারকারী বিশ্বে যত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার শীর্ষে বিশ্বব্যাংক, বস্তুত বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কাজে লাগে, তুলনা করার মতো আর কোনো নখদন্তপূর্ণ সংস্থা দুনিয়ায় নেই। আর এই প্রতিষ্ঠানটি সব সুনাম-দুর্নাম নিয়ে ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়ার পর থেকে একটি মাত্র দেশের কক্ষপুটে লালিত হচ্ছে। এই দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র। পদাধিকারীর মতো দেশাধিকারবলে ৬৮ বছর ধরে শুধু মার্কিন নাগরিকেরাই বিশ্বব্যাংকের সভাপতির পদে বসতে পেরেছেন। এবারই প্রথম ড. কিম মার্কিন প্রার্থী হয়েও একটু প্রচারাভিযানে বেরিয়েছিলেন। কিম যথারীতি ভারতেও ভোট চাইতে আসেন। এই পদটি মার্কিনদের মুঠো থেকে বেরোনোর প্রশ্নটি সম্ভবত দেশটির বৃহৎ শক্তির প্রাণশক্তিসূত্রে গাঁথা।
আমরা এই অঞ্চলে জোয়েলিক-জমানায় কী দেখলাম? এটা মনমোহন-শেখ হাসিনার সম্প্রীতির জমানাও বটে। হিলারির ঢাকা সফরের মাত্র এক মাস আগে জোয়েলিক ভারত সফর করেন। এ সময় তিনি বাংলা-ভারত সম্পর্কের দুই অনুঘটক প্রণব-চিদাম্বরমের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনা করেন। গত ৩০ মার্চ জোয়েলিক দিল্লিতে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত তাঁর মেয়াদেই সর্বোচ্চ ৪২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে।
বিশ্বব্যাংক মানেই আমেরিকার ব্যাংক। আইএমএফ ও ডব্লিউটিওর সভাপতি, জাতিসংঘের মহাসচিব এমনকি কোনো আঞ্চলিক ব্যাংকের প্রধান পদে কখনো কোনো মার্কিনকে দেখা যায়নি। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের দেশটিকে বহুপক্ষীয় ফোরামে সক্রিয় দেখতে চাইলে একটি পদতো যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে রসিকতা করে জোয়েলিক অবশ্য বলতে ভোলেননি যে আমি অবশ্য বলি না যে, সেটা বিশ্বব্যাংকই হতে হবে। সুতরাং বিশ্বব্যাংককে বশ করার জাদুটা ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ওপর অনেকটা বা যথেষ্ট নির্ভর করে বৈকি।
জোয়েলিক ভারতের জন্য কী করেছেন, তা তাঁর জবানিতে শুনুন: ‘একক ঋণগ্রহীতা হিসেবে শুধু ভারতের জন্য সিলিং বাড়াতে আমি বিশ্বব্যাংক বোর্ডকে রাজি করাতে সক্ষম হই। অন্য সব দেশের চেয়ে ভারতের একক ঋণ গ্রহণ সর্বোচ্চ দেখে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। কারণ, ভারতের সঙ্গে আমরা সমবায় গড়েছি।’
এখন পাঠকই বলুন, আমাদের অর্থমন্ত্রী জোয়েলিক-সংক্রান্ত তাঁর আলোচ্য মন্তব্যকে প্রলাপ না বিলাপ বলবেন? জোয়েলিক-বর্ণিত সমবায় সমিতিতে বাংলাদেশ যদি আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলেই ঢুকতে না পারল, বরং বহিষ্কৃত হলো, তাহলে আমাদের কূটনীতির ভবিষ্যৎ কী। একজন সম্মানিত ব্যক্তির নাম ভাঙিয়েও আওয়ামী লীগের পাইক-বরকন্দাজ বিশ্বব্যাংক কূটনীতিতে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে।
ভারতের ভাবি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যদি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দরাজ দিলে বলতে পারেন যে ‘জোয়েলিক ভারতের প্রকৃত বন্ধু’, তাহলে বাংলাদেশ কেন তাঁকে শত্রু ভাবল। প্রণব মনে করেন, জোয়েলিকের হাতেই ভারত-বিশ্বব্যাংক সম্পর্ক একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
তাই যদি হবে, তাহলে আমরা বিশ্বব্যাংকের ট্রেন ফেল করলাম কেন? এই লেখক জোয়েলিককে বাংলাদেশের শত্রু ভাবতে কোনো রসদ খুঁজে পাননি। বরং আমরা দেখি, জোয়েলিক বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক। তাঁর কথায়, ‘নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ অগ্রগতি করছে। মানব উন্নয়ন সাফল্য অসাধারণ। দেশটির বিরাট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও তার সাফল্যের জন্য সে “বাংলাদেশ প্যারাডক্স” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত উপাখ্যান আমরা জানি। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালেই বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যে এমন বিবৃতি দিতে পারে, তা ধারণার বাইরে ছিল। তারা যথেষ্ট কড়া ভাষায় ও উষ্মার সঙ্গে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রকে দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। খুব নির্দিষ্ট করে বললে বিশ্বব্যাংক তাদের দাবি অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়া এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার
না করার জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে উল্লিখিত তিনজনকেই শনাক্ত করেছে। তাদের সুরটা হলো, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’।
গত সেপ্টেম্বরেই এসএনসির দপ্তরে কানাডীয় পুলিশ হানা দিয়েছিল। এর বিপরীতে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র গণমাধ্যমের ওপর নানা ছলছুতায় বাক্যবাণ ও কটূক্তি করে চলেছে।
বিশ্বব্যাংকের গত এপ্রিলের প্রতিবেদন, যা প্রধানমন্ত্রী ও দুদকের কার্যালয়ে রয়েছে বলে ধারণা করি, তার বিস্তারিত না জানা পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের দাবির বিষয়ে আমরা কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করতে পারি না। তবে এমন অভিযোগ নিয়ে আমাদের সরকারের যে পলায়নপর ও আনাড়ি মোকাবিলা, তার সমালোচনা আমরা করি। পদ্মা সেতু প্রকল্প নেহাত একটি জাতীয় উন্নয়নের বিষয় নয়, এর যে একটি বহুপক্ষীয় কিংবা আন্তর্জাতিক মাত্রা রয়েছে। এর সঙ্গে যে রাজনীতি ও কূটনীতি বোধযোগ্য, তার প্রতি আমাদের সরকারের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আমাদের শঙ্কিত করে। দেশ-দশের স্বার্থটাই যেন ঠুনকো, আর সবই শ্রেষ্ঠ।
দুদক আমাদের ছেলে ভোলানো ছড়া শুনিয়েই যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে আমরা একটি বিকল্প পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলাম। সেই তিন সূত্র মানা কঠিন ছিল না। অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহভাজন সব কর্মকর্তাকে ছুটিতে রাখা, দুদকের আওতায় একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন ও বিশ্বব্যাংক নিযুক্ত একটি প্যানেলকে দুদকের কমিটির সঙ্গে কাজ
করতে দেওয়া। ওবায়দুল কাদের বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করছেন। কিন্তু তিনি কী বলবেন, কেন এই তিন সূত্র মানা সরকারের পক্ষে কঠিন ছিল? কেন তারা এটা না করে মালয়েশিয়াসহ নানা দুয়ারে দৌড়াদৌড়ি করছিল?
দুদকের চেয়ারম্যান এমন একটি সময়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন, যখন বিশ্বব্যাংক ত্যক্তবিরক্ত হয়ে চরম সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রহর গুনছিল। আমরা কি ধরে নেব, বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কথা সরকার আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। কোনো সম্মানজনক সমাধানের চেষ্টা করলে তারা তিন সূত্র নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। এর বিপরীতে আমরা দেখলাম, সাংবাদিক ঠেকানোর কর্মসূচি নেওয়া হলো। কিন্তু বাংলাদেশি সাংবাদিক ঠেকানো গেলেও বিশ্বব্যাংককে ঠেকানো যায়নি। বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণের দিকে অন্ধ হয়ে থাকতে পারে না, উচিত নয় এবং থাকবে না।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে না দেখতে বিশ্বব্যাংক প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদকের চেয়ারম্যানকে অভিযুক্ত করার পরে আমি মনে করি না যে দুদকের চলমান তদন্ত আরও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারে। অন্তত এই অভিযোগ ভিন্নতর উপায়ে তদন্তের দাবি রাখে। বিষয়টি শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, ধরে নেওয়াই ভালো যে, এতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদারদের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে বা হবে। বিশ্বব্যাংক সেদিকে ইঙ্গিতটা কিন্তু অস্পষ্ট রাখেনি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com