শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

বুটের তলায় দলিত ও দণ্ডিত ইউসুফ

পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট ও বিচারে দণ্ডিত ইউসুফের স্বজনদের সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে কথা হয় নীলফামারীর গ্রামের বাড়িতে। কথা হয় আরও অনেকের সঙ্গে। ২৫ বছরের এই যুবক ভূমিহীন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দু-এক শতক জমির ওপর তাঁদের বাঁশের বেড়া, ছিন্ন টিনের চালা। তাঁর বাবা মো. আলী নেথা বানিয়াপাড়া মসজিদে ইমামতি করেন। বেতন ৬০০ টাকা। একটি মক্তব চালিয়ে পান মুষ্টির চাল। বড় ভাই আবদুল হালিম কটকটি ফেরি করেন। গ্রামের লোকেরা বলেছেন, ফিতরা ও জাকাতের টাকায় লেখাপড়া হয়েছে ইউসুফ আলীর। আলিম পাস করার পর দু-তিন বছর আগে মতিঝিলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে একটি ছোট চাকরি পেয়েছেন। তিনি ব্যাংককর্মী নন।
এখন তদবির করতে ওই পরিবারের কারও ঢাকায় আসা সহজ কথা নয়। তাঁরা পারিবারিকভাবে জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করেন। আবদুল হালিম জোর দিয়ে বলেন, ‘ভাত খাবার পয়সা পাই না, আবার দল করব!’ ইউসুফের মা হালিমা আমাকে বলেছেন, ‘মোর ভালো ছাওয়া কষ্ট করি লেখাপড়া করছে।’ টিভিতে ঘটনা জানার পর থেকে তাঁরা বিপর্যস্ত। 
ইউসুফ আলীর ওপর পুলিশি নির্যাতনের বিচার হয়নি। বিচার হয়েছে নির্যাতিতের। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এটি একটি করুণ চিত্র। নির্বাচিত সংসদ সামরিক আদালতের মডেলে ২০০৯ সালে যে আদালত গঠন করেছিল, সেই আদালত তাঁর বিচার করেছেন। কর্নেল তাহেরের বিচারের ক্ষেত্রে সামরিক বিধানেরও লঙ্ঘন ঘটেছিল। মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না, কিন্তু ভূতাপেক্ষ আইন দিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ইউসুফের দশা কিছুটা তাহেরের মতোই। ‘ক্যাঙারু কোর্ট’-এর আইনও লঙ্ঘিত হয়েছে। 
সামরিক শাসন চলে গেলেই সামরিক খাসলত বদলে যায় না। ইউসুফ আলীর ওপর নির্যাতন শেষে তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। 
বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থায় বিচার বিভাগ পৃথক্করণে আমলাদের আক্রোশ প্রশমিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। তখন নির্বাহী হাকিমদের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে শুধু অর্থদণ্ডের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান নির্বাচিত সরকার সেনা-সমর্থিত সরকারকে লজ্জা দিয়ে আমলাদের দিয়ে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদানের বিধান চালু করে, যা সংবিধানের চরম লঙ্ঘন। বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের আদালতব্যবস্থা দেখা যায় না। আক্ষরিক অর্থেই একে সামরিক আদালতের সঙ্গে তুলনা করা চলে। জরুরি অবস্থায় শেরেবাংলা নগরে স্থাপিত আদালতগুলোকে আমাদের রাজনীতিকেরা হরহামেশা ক্যাঙারু কোর্ট বলতেন। কিন্তু তাঁদের হাত দিয়েই বিরোধী দল দলনে অন্য রকম ক্যাঙারু কোর্ট চালু হয়েছে। এই আদালতে কোনো সাক্ষ্য লাগে না। অভিযুক্তের আইনজীবী থাকে না। পুরো বিচারব্যবস্থাই অভিযুক্ত ব্যক্তির তথাকথিত স্বেচ্ছা-জবানবন্দিনির্ভর। কেউ দোষ স্বীকার করলেই তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে, অস্বীকার করলে নয়; নিয়মিত মামলা দায়ের করা যায়। 
পত্রপত্রিকায় ইউসুফ আলীকে নির্যাতন ও মতিঝিল থানায় বসে তাঁর বিচার করার খবর বেরিয়েছে। গতকাল প্রথম আলোতে ‘তাঁকে এক বছরের সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পুলিশ জানিয়েছে, থানায় আনার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ কামাল হোসেনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ইউসুফকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। 
গতকাল দুপুরে আমি মতিঝিল থানায় ফোন করি। জানতে চাইলে এসআই গোলাম হাফেজ বলেন, থানায় কোনো কোর্ট বসেনি। ঘটনাস্থলেই আদালত তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অপরাধবিষয়ক সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, মতিঝিল অঞ্চলের সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে তথাকথিত ওই আদালত বসেছিল। 
ওই কার্যালয় ঘটনাস্থল মতিঝিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রধান অফিস থেকে কমপক্ষে আধা কিলোমিটার দূরে। এই একটিমাত্র তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের ওপর ইউসুফ আলীর ওপর কী ধরনের অবিচার করা হয়েছে, তা প্রমাণযোগ্য।
২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে কোনো অভিযুক্তকে দণ্ডদানের ক্ষেত্রে কতগুলো শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ওই আইনের ৪ নম্বর ধারা বলেছে, কোর্ট ‘কতিপয় অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নেবে’। ইউসুফ আলী যে অপরাধই করে থাকুন না কেন, তা কি নির্বাহী হাকিমের ‘সম্মুখে সংঘটিত কিংবা উদ্ঘাটিত’ হয়েছিল? এই শর্ত পূরণ না হলে ‘তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করে’ অভিযুক্তকে দণ্ড আরোপ করা কীভাবে সম্ভব? নির্বাহী হাকিম যদি প্রত্যক্ষদর্শী হন, তাহলেও তিনি শাস্তি দিতে পারবেন না। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তা স্বীকার করতে হবে। এখন এ স্বীকারোক্তি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কি না, তা অনুধাবনে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আলোকচিত্রই যথেষ্ট। অবশ্য আমাদের শাসক তারকা নেতারা তা বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত!
ইউসুফ আলীর ওপর নির্যাতন চালানোর পর তাঁর কাছ থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ পাওয়ার যে বিবরণ নির্বাহী হাকিম শেখ কামাল হোসেন লিপিবদ্ধ করেছেন, তা জবরদস্তি ও বানোয়াট বলে ধরে নেওয়া চলে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা আছে, ‘এই আইনের অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করিবার সময় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গৃহীত হইবার পরপরই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সংক্ষিপ্ত অভিযোগ লিখিতভাবে গঠন করিয়া উহা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি গঠিত অভিযোগ স্বীকার করেন কি না তাহা জানিতে চাহিবেন এবং স্বীকার না করিলে তিনি কেন স্বীকার করেন না উহা বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানিতে চাহিবেন।’
ইউসুফকে হাতে ব্যান্ড বাঁধা এক পুলিশ বুট দিয়ে তাঁর বুক দলিত-মথিত করেছে। এই আলোকচিত্র সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে ওই নির্বাহী হাকিম ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ওই শর্তাদি পূরণ করেননি, সাজানো বয়ান লিখেছেন।
বিষয়টি গত শুক্রবার ক্ষমতাসীন দলের সম্পাদকমণ্ডলী ও ঢাকায় অবস্থানরত কেন্দ্রীয় নেতাদের জরুরি বৈঠকে আলোচিত হয়েছিল। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা হতভাগ্য ইউসুফ আলীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। গতকাল প্রথম আলো জানাচ্ছে, ‘ওই বৈঠকে বলা হয়, এ ঘটনা সত্য হয়ে থাকলে তা সরকারের জন্য বিব্রতকর। তবে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এটা কারসাজিমূলক অথবা পরিকল্পিত। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কেউ ষড়যন্ত্রমূলক এটা করতে পারে। কারণ, হরতালের দিন বিরোধী দলের এ রকম কোনো পিকেটিং ছিল না যে পুলিশকে কঠোর কোনো ব্যবস্থায় যেতে হবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। ঘটনার সত্যতা জানতে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।’
আমরা আসলে কোনো অংশেই ওই তারকাখচিত মহতী সভার বিজ্ঞ সদস্যদের মতোই ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে খাটো করতে পারি না। খটরমটর হয়তো এর পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণে। ষড়যন্ত্র হলে তা অন্তত দুই কিসিমের হয়েছে। ওই নাদান পুলিশ সরকারের ভাবমূর্তি নস্যাৎ করতে কিংবা তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে তাঁর বুটজুতা দিয়ে ইউসুফের বক্ষ বিদীর্ণে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অতঃপর নির্বাহী হাকিম নির্যাতিত ইউসুফ আলীর বক্ষপিঞ্জরে আদালতের হাতুড়ির ঘা বসিয়েছিলেন। পুলিশ যদি ইউসুফ আলীর বুক বুট দিয়ে পলিশ করে অপরাধ করে থাকে, তাহলে নির্বাহী হাকিমকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে।
এখন সত্যিই কী ঘটেছিল, সেটা সরকারের কোনো শরবত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে আদৌ কখনো জানা যাবে, তেমনটা ভরসা করা কঠিন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে কদিন আগে দেখা হয়েছিল। বললাম, ‘ঢাল-তলোয়ার কবে আপনার হাতে আসবে? লড়াইয়ের ময়দানে কবে নামতে পারবেন?’ তিনি অভয় দিলেন। বললেন, ‘প্রয়োজনীয় লোকবল প্রায় হাতে পেয়ে যাচ্ছি আর কি।’ ওই তারকা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা যদি দেখি তদন্তের দন্তই বরং উৎপাটিত হচ্ছে, তাহলে অবাক হব না। তবে যেন মানবাধিকার কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অগ্রাধিকার দেয়। বাসি বলে যেন পায়ে না দলে।
আমরা অবিলম্বে ইউসুফের মুক্তি ও তাঁকে হেনস্তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার চাই।

পাদটীকা: আমলাচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতব্যবস্থা অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে, কিন্তু তা চালাবেন বিচারিক হাকিমেরা। পাকিস্তানে আসিফ আলী জারদারি বিরোধী দলকে ঠেঙাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। অনেকটাই বাংলাদেশ মডেলে। তবে বাংলাদেশের শাসকদের লজ্জায় ফেলেছেন জারদারি। তিনি সমালোচনার মুখে ওই অধ্যাদেশ বাতিল করেছেন। 
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

বিচার প্রশাসন ভেঙে পড়ছে!

বিচার প্রশাসনে এখন নৈরাজ্য চলছে বললে কম বলা হবে। এখন বলতে হবে, ‘ওলট-পালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই’। মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক ওরফে দুলাল, বিকাশ কুমার সাহাকে ঘিরে অধস্তন আদালতে দীর্ঘদিন ধরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে আছে। 
জনশ্রুতি এই, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে এ ত্রিভুজ বদলি ও পদোন্নতিতে প্রভাব খাটাচ্ছিল। এখন সুযোগ এসেছে, তাঁদের শূন্যপদে সুপ্রিম কোর্টের পছন্দে ও কর্তৃত্বে বিচারক নিয়োগ করা। কিন্তু আবার যেন সেই একই খপ্পর। সেটা যাতে না ঘটে, সে জন্যই এ লেখা। যাঁদের সম্পর্কে এ সমালোচনা, তাঁদের সঙ্গে এ ধরনের বৈষম্য নিয়ে বহু দফা মতবিনিময় ঘটেছে। তাঁরা একান্ত আলাপে একমত হন যে এমনটা চলা ঠিক নয়। কারণ, ‘মুখ চিনে খাদিম দেওয়া’র নীতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে নষ্ট করে। আশা করি বিষয়টি তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। কারণ তাঁরা রাগ করেও এটুকু যুক্তির খাতিরে নিশ্চয় মানবেন যে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণীয় হলে বিচার বিভাগের শ্মশান হতে দেরি লাগবে না।
বিচারকদের মুখ বুজে কাজ করার চাকরি। তাঁদের যে সংগঠন রয়েছে, সেটা অনেক আগেই অপসারণ-সন্ত্রাস করে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিবকে অপসারণ করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। অপসারণ আদেশ প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু ভীতিটা থেকে যায়। চর দখলের মতো সমিতির সভাপতি ও মহাসচিব দখল করা হয়েছিল। জাহাঙ্গীর রাতারাতি হন সভাপতি। মহাসচিব দুলাল।
বিচার প্রশাসনের আকর্ষণীয় ঘটনা হলো বদলি ও পদোন্নতি। এখন প্রায় তিন হাজার বিচারক কর্মরত আছেন। কাউকে পুরস্কার বা তিরস্কার করার মোক্ষম অস্ত্র বদলি। 
আলোচ্য তিনজনের প্রথম জন ঢাকা জেলা জজ থেকে দেড় শ জন জ্যেষ্ঠকে ডিঙিয়ে এখন হাইকোর্টে। দুলাল ঢাকার স্পেশাল জজ, বিকাশ চট্টগ্রামে। বদলির প্রক্রিয়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-১) ও সিনিয়র সহকারী সচিবের ভূমিকা নিমিত্তস্বরূপ। এখন লক্ষণীয়, ওই তিনটি শূন্যপদে কী ঘটছে। 
বিকাশ ছিলেন ওই প্রশাসন শাখার অর্থাৎ দুলালের এক ধাপ নিচের সহকর্মী, সিনিয়র সহকারী সচিব। সেখানে এসেছেন পাঁচ বছর ঢাকায় থাকা মাহবুবার রহমান সরকার। তিনি দুলাল-বিকাশের সমিতি বিদ্রোহের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। অন্য আরও অন্তত চারজন সহযোদ্ধা চার-পাঁচ বছরের বেশি সময় দিব্যি ঢাকায় থাকছেন। বিকাশের পদোন্নতি দেওয়ায় বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটে। প্রেষণে দীর্ঘকাল থাকা বিকাশের পদোন্নতি আটকে ছিল। কারণ, বিচারিক কাজে দুই বছর না থাকলে পদোন্নতি প্রাপ্য নয়। বিকাশের কী হবে? বিকাশের ছয় মাস। তো আইন পাল্টাও। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক পরিপত্র পড়ে আমরা হতবাক। ছয় মাসের হলেই চলবে। আর সেটা কার্যকর হবে মাত্র এক বছরের জন্য। অতঃপর বিকাশ পদোন্নতি পেলেন। তাঁকেও ঢাকায় আনার সুপারিশ ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে চলে গেছে। অথচ এ দুলাল-বিকাশের সই করা সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া একাধিক চিঠি আমাদের কাছে আছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘ঢাকায় তিন বছর থাকার কারণে অমুককে ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে অমুক স্থানে বদলির প্রস্তাব করা হলো।’ 
এক কর্মস্থলে চাকরির সাধারণ সীমা তিন বছর। এর বেশি হলে বদলি স্বাভাবিক। ঢাকা থেকে ঢাকায় বদলি আরও নিষিদ্ধ। এমন বদলি কিছু ভাগ্যবানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মেধা ও যোগ্যতা কী কাজ করে, এবং বিচারকেরা কীভাবে বিচারক দ্বারাই ভয়ানক অবিচারের শিকার হন, সেটা বুঝতে হলে বদলি ও পদোন্নতি বুঝতে হবে।
দুলাল-বিকাশদের দাপট কাকে বলে সেটা বোঝানোর জন্য আপনাদের একটি টাটকা গল্প শুনতে হবে।
সা ক ম আনিসুর রহমান পিএসসির মাধ্যমে বিচার বিভাগে ঢোকেন তিরাশিতে। মেধা তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল তৃতীয়। একই পরীক্ষায় তিন কৃতীর পরিণতি লক্ষ করুন। প্রথম হন আশিস রঞ্জন দাশ। তিনি একটি শৃঙ্খলাজনিত ঝামেলায় পড়েন। তাঁর পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি অবশ্য এখন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের বিচার ডিভিশনের তথাকথিত দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব। দ্বিতীয় জন শহীদুল করিম সম্প্রতি হাইকোর্টের বিচারক। আর তৃতীয় জন সা ক ম আনিসুর রহমান। দুলাল-বিকাশ তাঁকে বদলির প্রস্তাব দেন চট্টগ্রামে। সুপ্রিম কোর্ট দেন ঢাকায়। আমরা অপেক্ষা করছিলাম, যিনি তাঁর ২৮ বছরের কর্মজীবনে ঢাকা দেখেননি, তাঁর কপালে একটিবার ঢাকা জোটে কি না। 
মেধা তালিকার প্রথম ব্যক্তি সচিব, দ্বিতীয় হাইকোর্টের বিচারক আর তৃতীয় জন হলেন লাঞ্ছিত। কামরুল-দুলাল-বিকাশদের প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। একটু খুলেই বলি। 
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০। প্রধান বিচারপতি পদে এলেন এ বি এম খায়রুল হক। তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রধান বিচারপতি ঢাকার জেলা জজ পদে নিয়োগে ১৫০ জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙানোর যে প্রস্তাব ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, তিনি তাঁর প্রথম কার্যদিবসেই সেটা কবুল করেন। নির্বাহী বিভাগের হুকুম তামিলের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর কাছ থেকে অনেক ভালো রায় পেয়ে আমরা তাঁর প্রশংসা করেছিলাম। সেটা তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু নিন্দাও তাঁর প্রাপ্য।
যে বিচারকের জজিয়তি-জীবন জীর্ণ, প্রায় অর্ধেক সময় কেটেছে প্রেষণে—রাজধানীতে, যাঁকে ঢাকা থেকে পদোন্নতি দিয়ে নরসিংদীতে মাত্র এক মাস আগে পাঠানো হয়েছিল, তাঁকেই তিনি ঢাকা জেলা জজ করেন। আর সা ক ম আনিসুর রহমানকে নোয়াখালীর জেলা জজগিরির পাট চুকিয়ে নিক্ষেপ করা হলো বরিশালে ট্রাইব্যুনালে। ১৪ নভেম্বর তিনি অবসর নেবেন। এ রকমের বহু আনিসুর রহমান নীরবে চোখের জলে অবসরে যান। পদত্যাগ করেন। অনেক মেধাবী ও যোগ্য ঢাকায় বদলি হওয়ার জন্য তদবির করেন না।
ঢাকা জেলা জজ পদ খালি। সমিতির সদ্য বিদায়ী সভাপতির ভগ্নিপতিও বিচারক। কিন্তু অনেকের জন্য যা কল্পনা করাও কষ্টের, তিনি তা-ই করেছেন। বিচারক হয়ে কুয়েতের দূতাবাসে ২০০৪ সালে কূটনীতিক বনে গিয়েছিলেন। বিএনপি সরকারের প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্ট তা মঞ্জুর করেছিলেন। প্রায় সাত বছর পর হঠাৎ তাঁর ঢাকায় আগমনে অনেকে প্রমাদ গুনছেন যে শ্যালকের ছেড়ে যাওয়া শূন্যপদের দিকে তাঁর নজর পড়েছে কি না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিসহ এই শ্যালক-দুলাভাই জুটির বাড়ি কিশোরগঞ্জে।
এ লেখায় যে তিনজনকে নিয়ে আলোচনা করছি, তাঁদের মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল আছে। তাঁরা প্রত্যেকে অনিয়মের এমন রেকর্ড গড়েছেন, যা আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি।
দুলাল অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে জেলা জজ হন আরও ৪২ জনের সঙ্গে। ৮ সেপ্টেম্বর তাঁরই সইয়ে অন্য সবাইকে দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে তাঁদের নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ যায়। কিন্তু তাঁরটি ঝুলে থাকে। 
আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সস্ত্রীক কানাডা সফর থেকে ফিরে ১৭ অক্টোবর দুলালকে বদলি করা হয় ঢাকার স্পেশাল জজ হিসেবে। নিয়ম হলো, মূল পদে অন্তত দুই বছর জজিয়তি না করলে প্রেষণে বদলি জুটবে না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর একটুও তর সয়নি। চাকরিজীবনের ১৫ বছরের মধ্যে ১১ বছরই প্রেষণে থাকা দুলালের জন্য ওই দিনই সুপ্রিম কোর্টে চিঠি যায়। প্রশাসন-১-এ উপসচিব পদেই তাঁকে প্রেষণে রাখতে হবে। তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্য, তিনি আরও বহু প্রকল্পের মোক্তার। তাঁর এসিআরে দেখি, রায় লেখায় তাঁর দোষ আছে এবং তাও অপ্রতুল। অথচ আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁকে এক শতে নিরানব্বই দেন। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়া ও অপর এক জেলা জজ তাঁকে দিয়েছেন ৬৬। হাস্যকর যুক্তি হলো, তিনি সস্ত্রীক সরকারিভাবে হজে যাবেন। ‘উপসচিব’ পদমর্যাদাকে ‘স্পেশাল জজ’ করতে হবে। টাইপের বিরাট ঝামেলা। দুই মন্ত্রী হয়তো ভেবেছেন, নিয়মকানুন চুলোয় যায় যাক, ব্যক্তিতোষণ টিকে থাক। 
আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতি কর্মস্থল নির্ধারণ ও শৃঙ্খলাজনিত বিষয়টি দেখভাল হয়ে থাকে। আইন প্রতিমন্ত্রী এসব কাজে ভয়ানক দাপুটে, তবে আইনমন্ত্রীও বহু অনিয়মের নথিতে সই করা থেকে বিরত থাকেননি।
বিচারকদের ওপর মানসিক নিপীড়ন চলছে। এর প্রমাণ আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার ডিভিশনকে পদানত রাখা। সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবেরা দৌড়ের ওপর আছেন। আদালতের রায় হলো, জ্যেষ্ঠতমই সচিব হবেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠতা এখন দলিতমথিত। স্পষ্টতই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিচারকদের মানবাধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা যায়। নিয়মতান্ত্রিক আইনসচিব নিয়োগ না করেও তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করছেন। বিচার ডিভিশনের সহকারী সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রত্যেকে অবশ্যই বিচারক হবেন। এবং তাঁরা আছেনও। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করেও তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পদ্ধতিগত অনাচার ও হয়রানির ঘটনাও ঘটছে।
অন্তত পাঁচ বছর ধরে আইনসচিব পদটি শূন্য। অতিরিক্ত সচিব পদ শূন্য। জোড়াতালি দিয়ে চলছে। দুই মন্ত্রী এটা জেনেশুনে করছেন এবং আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জিএ কমিটি এবং সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্টের সব বিচারক নিয়ে গঠিত ফুলকোর্ট এ বিষয়ে তাঁদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে উদাসীন থাকছেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রশাসন ক্যাডারের মনভজন করে সচিব হয়েছিলেন, যা আপিল বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁকে না রাখতে পেরে তাঁরা কি এখনো কলকাঠি নাড়ছেন? হাবিবুলের পরে আনোয়ারুল হক ছিলেন ‘চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত’। তিনি হাইকোর্টে গেলে আসেন শহিদুল করিম। তাঁর পরিচয় তিনি ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’। তিনি হাইকোর্টে গেলে এলেন আশিস রঞ্জন দাশ। তাঁরও জুটেছে ‘দায়িত্বপ্রাপ্তের’ তকমা। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে এটা তামাশা। এটা সুপ্রিম কোর্টের রায় কিংবা এ সংক্রান্ত বিধিবিধানের পরিপন্থী। অবশ্য এর দ্বৈত সুবিধা। হাত মোচড়ানোর ও হাত কচলানোর।
ওই চক্র বিচার প্রশাসনে নিজেদের অপরিহার্য মনে করে। দলের কান্ডারি ভাবে। ‘ম্যাডাম’ ডিজায়ার্সের মতো এরা ‘আপা’ ডিজায়ার্স চালু করেছে। বাকশাল ছাত্রলীগের কর্মী দুলালের একদা স্লোগান ছিল: ‘রক্তের নয়, আদর্শের উত্তরসূরি চাই।’ একজন নিরীহ বিচারককে জেএমবির রং দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর রেজিস্ট্রার হওয়া ঠেকানো হয়েছে। বিষয়টি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও পালের গোদাদের শাস্তি হয়নি। আবার ওই যে আনিসুর রহমান তো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জেএমবির ২১ সদস্যকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। বিএনপির আমলে সেটাই ছিল এ সংক্রান্ত প্রথম রায়। তাঁর নামে নিশ্চয় অন্য কিছু বলে ঢাকায় বদলি ঠেকানো হয়েছে। মোহাম্মদ হারুনর রশীদকে এক বছরের মাথায় হঠাৎ ঢাকা থেকে বদলি করা হয়। সংসদীয় কমিটি এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিকাশের সই করা চিঠিতে উত্তর আসে: ‘তিনি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।’
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জিএ কমিটির আজ বৈঠকে বসার কথা আছে। জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার মিশেলে আমরা একটি নীতিমালা চাই। এর আগে দেখতে চাই রীতিনীতি যেন মুখ চিনে না বদলায়। আলাদা সচিবালয়ের আগ পর্যন্ত সরকারের বিচার ডিভিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।
নতুন প্রজন্মের বিচারকদের কোনো রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় কাজ করা এবং সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমানে যাঁরা ঢাকায় আছেন তাঁদের অনেকেরই অবস্থান এই সূত্রে গাঁথা। 
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com