মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বিপ্লব-বাবরের খুনের গল্প শুনুন

শোনেন শোনেন প্রিয় পাঠক, শোনেন দিয়া মন, খুনি বিপ্লব-বাবরের খুনের গল্প এখন করিব বর্ণন। তবে তার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা!
গত বছরের জুলাইতে আলোচিত আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের ‘অবিসংবাদিত’ নেতা আবু তাহেরের পুত্র বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মাফ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও নামটা পড়েছিল রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের। আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ তখন বলেছিলেন, আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছু জানে না। এই কথিত না জানার খবরটি যিনি প্রকাশ্যে এনেছিলেন, তিনি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছিলেন, এ বিষয়ে নিয়ম মানা হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই ক্ষমার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
২৫ জুলাই ২০১১ আমার ‘প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমা বৈধ নয়’ শীর্ষক লেখায় আইনমন্ত্রীর ওই না জানার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ জানতেন না, এই কথা অন্তত দালিলিকভাবে ঠিক নয়। কারণ, যে চিঠির ভিত্তিতে নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ড মওকুফ হয়, সেটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিল। আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত আইন সচিবসহ (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক) পাঁচজনের সই করা চিঠি। এই চিঠিতে ‘রাষ্ট্রপতির স্বীয় বিবেচনা’ শব্দটি আছে। এর মানে, আইন মন্ত্রণালয় ক্ষমা করে দেওয়ার দায়ভার সরাসরি নেয়নি। এমনকি এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাঁধে বন্দুক রেখে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করার একটা সূক্ষ্ম চেষ্টাও থাকতে পারে। তবে তারা তাহেরপুত্র ও তাঁর বন্ধু বাবরের ক্ষমা ‘রাষ্ট্রপতির স্বীয় বিবেচনায়’ ছাড়লেও এটাই তাদের অবস্থান নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ক্ষমা না করার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। খুনি পুত্রের জন্য আবু তাহের তাঁর দলীয় পরিচয় পুঁজি করেন। তিনি আওয়ামী লীগার, সে কারণেই তাঁর পুত্রকে জড়ানো এবং সেই কারণেই তাঁর ঘাতক পুত্র ক্ষমাপ্রার্থী, সে বিষয়টি উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক ছিল না। গত ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠক করেন। এ সময় মেয়র আবু তাহের উপস্থিত ছিলেন। বিটিভি এ নিয়ে সচিত্র খবর সম্প্রচার করেছিল। ওই বৈঠকে শিবিরকর্মী মহসিন হত্যা মামলায় বিপ্লব ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা যে ‘নির্দোষ’ এবং তাঁদের সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়। লক্ষ্মীপুরের একজন সাংবাদিক সোমবার এ কথা বলেছেন এই নিবন্ধকারকে।
এবার আমরা দেখব, খুনি বিপ্লব কাকে, কেন ও কীভাবে খুন করেছিলেন। নির্দলীয় ও দক্ষ বিচারপতি হিসেবে মো. ইমান আলীর সুনাম সুবিদিত। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি আপিল বিভাগে উন্নীত হন। রাষ্ট্র বনাম এ এইচ এম বিপ্লব মামলার মূল রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. ইমান আলী। ৬০ পৃষ্ঠার সুলিখিত এই রায় সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত করেছে যে মহসিন হত্যাকাণ্ডের মূলনায়ক তাহেরপুত্র বিপ্লব। ৫ সেপ্টেম্বর ২০০০। আওয়ামী লীগের জমানা। লক্ষ্মীপুর শহরের আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। এদিন মহসিন খুন হন। ২০০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত রায়ের বিবরণ থেকে দেখা যায়, পলাতক বিপ্লবের পক্ষে রাষ্ট্র আইনজীবী দিয়েছিল।
মহসিন হত্যা মামলায় বিপ্লব ও বাবরসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ৬ জুলাই লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে রেফারেন্স পাঠান। এ সময় বিপ্লব ও আবু তাহেরের পালকপুত্রখ্যাত লাবু বাদে অন্য তিনজন কারাগারে ছিলেন। বাবরসহ তিনজনই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য তৈরি করা যন্ত্রণাদায়ক সেলে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সামনে যেমন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষও বলেছিল, ‘রাজনৈতিক শত্রুতার কারণেই মহসিনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মহসিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরা স্বীকৃতমতে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী ছিলেন।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, যাঁদের মধ্যে এখন একজন সাংবিধানিক পদে আছেন, বিপ্লব, বাবর বা লাবু ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন, তা দাবি করতে ভরসা পাননি। তাঁরা বলেছেন, মহসিনকে খুন করাই যদি লক্ষ্য হতো, তাহলে বিপ্লবরা মহসিনের হাত-পায়ে গুলি ছুড়তেন না। তাই ৩০২ ধারায় না হয়ে ৩২৬ ধারায় তাঁদের শাস্তি হতে পারে।
উভয় পক্ষের শুনানি ও যুক্তিতর্ক শ্রবণ শেষে আদালত কিন্তু তাঁদের যুক্তি একেবারে অগ্রাহ্য করেননি। খুন ও খুনিদের কাণ্ড আদালত সাব্যস্ত করেন এভাবে: ‘ওই কক্ষ থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে অভিযুক্ত লাবু, বাবর ও বিপ্লব মহসিনকে টেনেহিঁচড়ে আবদুল আউয়াল এমপির সুপারির বাগানে নিয়ে যায়। বাবর ও লাবু নিহত মহসিনের দুই হাত চেপে ধরে। এ সময় তাহেরপুত্র বিপ্লব মহসিনের দুই পায়ে গুলি করলে সে লুটিয়ে পড়ে। এরপর তাহেরের পালকপুত্র লাবুও গুলি করে এবং তাঁর কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে বিপ্লব-বন্ধু বাবর মহসিনের বগলে গুলি করে। এই হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটেছে। এটা বলা যায় না যে, আসামিরা কোনোভাবেই জনতার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।’
বাবর ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মার্জু ও মেহেদী ছিলেন যুবলীগের কর্মী।
বিচারপতি মো. ইমান আলী তাঁর রায়ের উপসংহারে লিখেছেন, ‘ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। তারা একটি রাজনৈতিক সভা করছিল বলেই অভিযুক্তদের সন্দেহ ছিল। তারা তাদের কাছে চাঁদা চায়নি। তাদের কাছ থেকে মূল্যবান কিছু ছিনিয়েও নেয়নি। আসামিরা তাদের দেহ তল্লাশি করেছিল। তবে নিহত এবং অন্যরা যদি কোনো রাজনৈতিক সভায়ও মিলিত হয়, তাহলেও তাদের সভা পণ্ড করে দেওয়ার কোনো অধিকার আসামিদের ছিল না। মহসিন এই জঘন্য অপরাধের টার্গেট হয়েছিল।’
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ‘এ এইচ এম বিপ্লব, সৈয়দ নুরুল আজিম বাবর এবং আবদুল জব্বার লাবু ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৃশ্যপটে ছিল। তারাই যে মহসিনকে অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করেছিল, তা অবিশ্বাসের কোনো কারণ আমরা দেখি না।’
আমরাও আদালতের সঙ্গে একমত। আইন মন্ত্রণালয়ও ‘স্বীয় বিবেচনায়’ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আদালতের ওই রায়কে অবিশ্বাস করার পরামর্শ দেয়নি। তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের চাকরি বাঁচিয়েছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, তাঁরা কেন ক্ষমা বা অনুকম্পা পাচ্ছেন?
হাইকোর্ট কেন তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছিলেন, তার বিবরণ এ রকম: ‘বিপ্লব-বাবর ও লাবু যেভাবে গুলি করেছে, তা ময়নাতদন্তের চিকিৎসক সঞ্জয় কুমার পালের সাক্ষ্যেও প্রমাণিত হয়েছে। আসামিদের পক্ষে যদিও যুক্তি দেওয়া হয়েছে, মহসিনকে তারা হত্যা করতে চায়নি। সেটা চাইলে তারা ঘটনাস্থলেই হত্যা করতে পারত। রিকশা ডেকে হাসপাতালে নিত না।’ আদালত তা মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মহসিনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার গুলি চালানো হয়। এ কারণে আহত ব্যক্তি মারা যেতে পারে—এটা তাদের জানা ছিল না। সে কারণেই তারা খুনের দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না।’ আদালত দুটি কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লব ও অন্যদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছিলেন। আদালত বলেছেন, ‘শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গুলি না করা এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করার কারণে বিপ্লব, বাবর ও লাবুর শাস্তি লঘু করা হলো। তাদের যাবজ্জীবন বহাল থাকবে। মার্জু ওরফে নুরুল্লা এবং মেহেদী হাসানকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হলো।’
মহসিনের তিন ঘাতকের মধ্যে বিপ্লব ও বাবরের দণ্ড কমেছে বলে প্রথম আলো খবর দিয়েছে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, তাহেরের পালিত পুত্র লাবুরটাও কমবে। সুশাসিত এই রাষ্ট্রে এক যাত্রায় তিন ফল হয় না! লক্ষ্মীপুর জেলে সহযোগীদের নিয়ে ‘বড়মিয়ার (বিপ্লব) বিলাসীজীবন’ কারও অজানা নয়। কিন্তু এসব ঘটছে কিসের মানদণ্ডে? এক অর্থে ব্যক্তিগত সম্পদ ধরে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নাম ভাঙাবেন, কিন্তু সেটা ধোপে টিকবে না। কারণ, এমন অনেক ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগারের দেখা মিলবে, যাঁরা সংগত কারণ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যায্য অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এটা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন যে মহসিনের ঘাতকেরা হাইকোর্ট থেকেও একবার অনুকম্পা নিয়েছিলেন। সুতরাং, ঘাতকেরা দুবার অনুকম্পা নিলেন। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে তাই অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উচ্চ আদালতে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জযোগ্য। সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত এই ক্ষমায় সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সংবিধান বিতর্ক: আহমেদ বনাম আহমদ

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জনগণের সামনে সত্য আড়াল করছে। তারা অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় আছে। এভাবে তারা জনগণকে কার্যত ভাঁওতা দিচ্ছে। সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ইসি পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক।’ তাঁর কথায়, গত ৪০ বছরে এই প্রথম অসাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ‘সংবিধানের কোথাও অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিধান নেই।’ অন্যদিকে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, প্রজ্ঞাপনে ১১৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আইনের উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে এটা সাংবিধানিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি, গত ৪০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ‘উদারতার’ সঙ্গে এটা করা হয়েছে। এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।
উভয় পক্ষের বক্তব্যের চেতনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে বলা যায়, উভয় পক্ষ জেনে বা না জেনে অর্ধসত্য উচ্চারণ করছে। তারা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, অর্ধসত্য মিথ্যা অপেক্ষা ভয়ংকর। এতে আমজনতা তো বটেই, শিক্ষিতজনেরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
১১৮ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ দেবেন।’ সরকার আইন না করে চালাকি করে বলেছে, ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রজ্ঞাপন করা হলো। একটি আইন হলে তার বিধান থাকে। এর আওতায় প্রজ্ঞাপন হয়। অথচ এখন আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘এই মুহূর্তে স্থায়ী আইন করার দরকার নেই। প্রজ্ঞাপনই আইনের কাজ সেরেছে।’ এ ধরনের বক্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত ধরে নিলে সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তার উপায় নেই।
১১৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা কিংবা ভুল ব্যাখ্যার যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটনে আমাদের সাংবিধানিক বিবর্তন ও ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ১৯৫৬ সালের অবিভক্ত পাকিস্তানের সংবিধানে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ১৩৭ অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতিকে যাতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে না হয়। সে কারণে লেখা হয়েছিল, এদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ‘ডিসক্রিশন’ বা একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে। ১৯৬২ সালের ১৪৭ অনুচ্ছেদে এই ক্ষমতা ছেঁটে ফেলা হয়। আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদটি আমরা সম্ভবত ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ থেকে গ্রহণ করেছিলাম। তাহলে এখন আমরা দেখব, ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্কের বিষয়টি কীভাবে আলোচিত হয়েছিল। প্রথম যে খসড়া তৈরি হয়েছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন।’ এ প্রসঙ্গে এটা বলা আবশ্যক যে, বর্তমান সরকার একটা ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়ে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের রেওয়াজ ভেঙে দিয়েছে। কেন তিনজনের পরিবর্তে পাঁচজনের দরকার পড়ল, সেই ব্যাখ্যা সরকারের কোনো মহল থেকে দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলও অন্তত এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে বলে নজরে পড়েনি। ভারতকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আয়তনে ভারতের অনেক রাজ্য বাংলাদেশের তুলনায় বড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এক সদস্যের। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর তারা শুধু একজন সিইসি দিয়ে চলেছে। এরপর তারা দুজন কমিশনার বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাও আইন দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তারা স্থায়ী পদ সৃষ্টি করেনি। আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার পরও মাত্র দুজনকে দিয়ে ইসি পুনর্গঠন করা সম্ভব ছিল। যাক এ প্রসঙ্গ। কী করে ‘আইন’ এল, সে কথাই বলি। ১৫ জুন ১৯৪৯। ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্ক চলছে। অধ্যাপক সাক্সেনা সংশোধনী এনেছেন। এতে তিনি বলেছেন, সিইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ হলো নির্বাহী বিভাগ এতে হস্তক্ষেপ করবে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা যেমন চাইবেন, তেমনটা হবে। তাই তিনি বললেন, যাঁর নাম সিইসি হিসেবে প্রস্তাব করা হবে, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের মতো সংসদে শুনানির মুখোমুখি হতে হবে। ভারতের গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন ড. আম্বেদকার। তিনি একটি মধ্যপন্থা উদ্ভাবন করলেন। বললেন, সিইসি নিয়োগ-প্রক্রিয়ার বিষয়ে সংসদ যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য একটি আইন তৈরি করার বিধান রাখা হোক। অতঃপর ৩২৪ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হলো সংসদের ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন। এই কথাটি আমরা ধার করেছি ১৯৭২ সালে। এবং এ কথা এখন রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে, গত ৪০ বছরে এই আইনটি তৈরি করা হয়নি।
এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শফিক আহমেদ ও মওদুদ আহমদ কীভাবে আইন তৈরি করাসংক্রান্ত ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রেক্ষাপট আড়াল করে আমজনতাকে ভাঁওতা দিয়ে চলেছেন। সরকারি মহল থেকে আমাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আইনের’ ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘“আইন” অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’ আবার ‘প্রচলিত আইন’ নামেও সেখানে একটি সংজ্ঞা আছে। এতে বলা আছে, ‘প্রচলিত আইন মানে সংবিধান তৈরির আগে এই ভূখণ্ডে যে আইন বহাল ছিল।’ এখানে একটি খটকা আছে। আমাদের সংবিধানে ভুল বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ‘আইন’ সংজ্ঞায়িত হয়েছে কি না, সেটা বিচার্য। কারণ, আমাদের সংবিধানে যা উক্তরূপ ‘আইন’ ব্যাখ্যা, ১৯৪৯ সালের ভারতের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদ ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের ২১৮ অনুচ্ছেদে তা-ই হলো ‘প্রচলিত আইন’। ভারত ও পাকিস্তানের মূল সংবিধানে (পাকিস্তান কিন্তু ১৯৬২ সালে এই ব্যাখ্যাটি ফেলে দেয়) শুধু ব্রিটিশ ভারতে কার্যকর থাকা আইন, উপ-আইন, আদেশ ইত্যাদিকেই ‘প্রচলিত আইন’ হিসেবে নিয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯২ ধারায় ‘প্রচলিত আইন’ একই লক্ষ্যে লেখা হয়েছিল। সুতরাং, আইন ও প্রচলিত আইন নামে দুটি দফা ’৭২-এর সংবিধানে কেন লেখা হলো, তা খুঁজে বের করতে হবে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষ-এ ‘প্রচলিত আইন’ বলতে ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত দুটি বিষয়কেই (আইন ও প্রচলিত আইন) কিন্তু একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। এবং সেটাই সঠিক। সুতরাং, সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে আইনমন্ত্রীর বর্ণিত ‘আইন’ আসলে সংবিধান প্রণয়নের আগের যেকোনো আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ বা সংবিধানের অন্যত্র বর্ণিত ‘আইন’কে প্রজ্ঞাপন অর্থে ব্যবহার করা যাবে না।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের ১৫২ অনুচ্ছেদের মতো তাদের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমার জানামতে ভারতের মন্ত্রিসভা বিভাগের কোনো প্রজ্ঞাপনকে তারা সংসদের প্রণীত আইনের মর্যাদা দেয়নি, এক করে দেখেনি।
তবে মওদুদ আহমদের দাবি অনুযায়ী, সংবিধানে ১১৮ অনুচ্ছেদে অনুসন্ধান কমিটির কথা না বলা থাকলেও তাকে অসাংবিধানিক বলা যাবে না। কারণ, প্রজ্ঞাপনটি ১১৮ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ না করলেও সেটা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের চেতনানাশক নয়। সুতরাং, একটি অনুসন্ধান কমিটি (যার সদস্যরা তাঁদের মূলসাংবিধানিক পদেও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না) গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি কিছুটা ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু যে ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তারা এটা করেছে, সেটা ছিল দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রশ্নেও একটা ফাঁকি আছে। সেটা হলো সিইসি ও ইসি নিয়োগের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছিল। সুতরাং যা হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই হয়েছে। দুই দলের একটি বিষয়ে মিল, তারা কেউ ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদে আইন পাস করতে চায় না। সিইসি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কার্যকরভাবে খর্বনা করতে তাদের মধ্যে এত কিছুর পরও অশুভ আঁতাত অটুট। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আর্থার কোয়েসলারের একটি উক্তি হচ্ছে, ‘দুটো অর্ধসত্য থেকে একটি পূর্ণসত্য তৈরি হয় না।’
দুই বড় দলের অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে সত্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সিইসি শুধু ‘কিছু মন্ত্রণালয়’ চান কেন?

আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার সরকারি মনোভাব ধীরে ধীরে স্পষ্ট করা হবে। এ পর্যন্ত এটাই সরকারি অবস্থান। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের বিরোধী দল (গত ২০ বছরের) এমন কোনো ব্যবস্থায় ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন দেখতে চায় না, যা ক্ষমতাসীনদের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত করার প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারে।
সেদিক থেকে বিদায়বেলায় ‘কিছু মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে দিলে সুুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব’ বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদার উক্তিকে যে বিএনপি গুরুত্ব দেবে না তা হলফ করে বলা যায়। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেই চলবে না, সঙ্গে বিরোধী দলের একটা বিজয় মিছিল লাগবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত মেয়াদের সরকার যখন সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করল, তখন বিরোধী দল সারা দেশে ‘সরকারের পতন’ ঘটানোর কৃতিত্ব দাবি করে বিজয় মিছিল করেছে। স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের ৫+৫+১ ফর্মুলাটি আওয়ামী লীগ প্রায় মেনে নিতে বসেছিল। কিন্তু ঠুনকো অজুহাতে তা ভেঙে যায়। এবারও তেমন ঘরানার একটি সংলাপ অনুষ্ঠানের উদ্যোগের আলামত দেখতে পাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ খুশি হতে পারেন যে আওয়ামী লীগ সেদিন যা প্রত্যাখ্যান করেছিল, বিএনপি যদি আজ তা গ্রহণ করতে পারে।
বর্তমান ইসি দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার স্তরের নির্বাচন অনেকটাই অবাধ ও সুষ্ঠু করেছে। কিন্তু তার ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন করতে পারার দাবি যৌক্তিক নয় বলেই অনেকে মনে করেন। এখন সিইসি বলছেন, ‘কতিপয় শর্ত’ পূরণ করা হলে তা সম্ভব। সেই শর্তের একটি তিনি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করেছেন, সেটি হলো, ‘কিছু মন্ত্রণালয়কে’ ইসির অধীনস্থ করতে হবে। ২৭ জানুয়ারি ২০১২ সুরঞ্জিত-মঈনের বাহাস বা ‘তত্ত্বাবধায়কের’ নতুন ফর্মুলাবিষয়ক একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। রেলমন্ত্রী কিছু মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে নেওয়ার ধারণাটি বাংলাভিশনের আলোচনায় উল্লেখ করেছিলেন ২৩ জানুয়ারি। এর সপ্তাহ না ঘুরতেই ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের কাছে তাঁরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, মানে নির্বাচনী আইন সংশোধনে একটি প্রস্তাব দিচ্ছেন। এতে নির্বাচনকালে ‘দলীয় বা যে ধরনের সরকারই’ থাকুক না কেন, তিনটি মন্ত্রণালয়—স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন এবং মন্ত্রিসভা বিভাগকে ‘অবশ্যই ইসির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘মাস্ট কনসাল্ট’ শব্দটি উল্লেখ করেন। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনকালে কী সরকার থাকবে, সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। তবে যে সরকারই থাকুক, নির্বাচনকালে সচিবালয়ের ফাইল চলে আসবে ইসিতে। এ বিষয়ে ঠিক কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তা আইন হলে তার আওতায় বিধি করে নেবে ইসি। সিইসির জবানিতে ২ ফেব্রুয়ারি কিছু মন্ত্রণালয় ‘অধীনে’ কথাটি এসেছে। আমরা জানি না, এই অবস্থাটি আইনগতভাবে কীভাবে নিশ্চিত করা হবে। তবে একটা সারকথা বুঝি এবং সেটা বোঝাই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি যে ‘কানসাল্টেশনের’ কথা বলেছেন, সেটা সভ্য সমাজে স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু তিনি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জটিলতা দেখা দেয়। প্রশ্ন হলো, আইনে থাকলেই দলীয় সরকার তা মানতে বাধ্য থাকবে কি না।
ভাতের চেয়ে ডাল উঁচু হতে পারে না। বিধির চেয়ে আইন বড়, আইনের চেয়ে সংবিধান বড়। আর এমন কোনো আইন বা বিধি আমরা কল্পনা করতে পারি না, যা সংবিধানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেই সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁর কর্তৃত্বে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে।’ এখন যদি কেউ বেমক্কা বলেন যে আইন বা বিধি দিয়ে এই সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করবেন, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই। আর কনসাল্টেশন? সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে, এটা মানতে প্রধানমন্ত্রী বাধ্য নন। উপরন্তু আমাদের দাস্য মানসিকতাও স্মরণে রাখতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে না। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় অভ্যাস ছাড়তে পারে না।
তবে সিইসির এই কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বিএনপি বলছে, তা তো আগামী দুই মেয়াদের জন্য। তাহলে তারপর কী হবে? এর উত্তর হলো, সংবিধান সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। অন্যান্য সভ্য সমাজের মতো নির্বাহী ক্ষমতার কার্যকর অনুশীলন লিখিতভাবে দিতে হবে মন্ত্রিসভার কাছে। এটা যদি সম্ভব হতো, তাহলে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীকে রেখে এতটা মারাত্মক উত্তেজনা সৃষ্টি হতো না। এটা বললে অনেকে গোস্বা করেন। তাঁদের মনে মাইনাস টু ফর্মুলা উদিত হয়। অথচ তাঁরা কিছুতেই সংবিধানের এমন সৃষ্টিছাড়া বিধান শোধরানোর কথা মুখে আনবেন না।
সিইসি ও ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতের বক্তব্য অন্তসারশূন্য বলে প্রতীয়মান হয়। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে বিরোধী দলের স্বপ্নের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি শর্তহীনভাবে সমর্থন দেওয়া।
আমরা সব সময় মনে রাখব, দুই প্রধান দলই সব অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার পক্ষে সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু তাঁদের আশপাশে যাঁরা আছেন, বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁরা যখন পালিশ করার রাজনীতি করেন, তখনই দুঃখ হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনেক ভালো কাজের প্রশংসা করি। কিছুই জুটত না, যদি না তারা সেনা সমর্থনে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনটি না করতে পারত। সুতরাং একই অঙ্গে তাদের অনেক রূপ থাকতে পারে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে কয়েকটি নির্বাচন করে তাদের বলা উচিত নয় যে সংবিধানের বিধিব্যবস্থা না বদলে দিয়ে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না দিয়ে ‘কতিপয় পরিবর্তন আনলেই’ দলীয় সরকারের অধীনে ধরেই নেওয়া যাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। অবশ্য কেউ যদি গণক ঠাকুর হতে চান এবং তাতে সফলও হন, তাতে আমরা অবাক হব না। কেউ বলতে পারেন, সত্তর সালের নির্বাচন কি সেনা সরকারের অধীনে হয়নি। তখন যদি সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে এখন হবে না কেন। যদি কেউ বলেন, আগামী দুই বছরে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা এতটাই কমে যাবে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেও তাতে বিরোধী দলই ফিরে আসবে। এমনকি বিএনপি তার সব অপশাসনের কলঙ্ক ও দেউলিয়াত্ব নিয়েও তিন- চতুর্থাংশ নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে! তাই তারা আওয়ামী লীগকে তাদের ১৯৯৬ সালের মডেলে নির্বাচন করতে দেবে না। জেনারেল এরশাদকে ‘গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা’ কিংবা তাঁকে খালি মাঠে গোল করতে দেওয়া হবে না।
ক্ষমতাসীন দল এখনো বিশ্বাস করে যে প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারে রেখেই তারা নির্বাচন করবে এবং সেখানে সব রকম উসকানি থাকবে, যাতে বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনও বয়কট করে! এ ধরনের কল্পনাশ্রয়ী ঘটনা ধরে যুক্তিসংগত মন্তব্য করা চলে না। বেগম খালেদা জিয়া এমন কিছুই মেনে নেবেন না, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাতে ফ্রিস্টাইলে সরকার চালাতে তার অসুবিধা ঠেকে। তবে ক্ষমতার বৈতরণী পার হতে প্রয়োজনে তিনি অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার ওপরে ক্ষমতা কাটছাঁট করার একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেন। দুই নেত্রী এমন কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চান না, যাতে দুই দলের নেতৃত্ব দিতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয়। এই লেখকের স্থির বিশ্বাস দুই দল এমন কিছুই করবে না, যাতে তৃতীয় কোনো পক্ষ ঢুকে পড়ে। তৃতীয় পক্ষ নিয়ে তারা সাময়িক খেলতে পারে কিন্তু স্থায়ী হতে দেবে না।
তাই বলছি, সিইসি যখন কথাটা বলেছেনই, তখন তাঁর বা ইসির দায়িত্ব বিকল্প ব্যবস্থাটা বিস্তারিত খুলে বলা। শুক্রবার প্রথম আলোতে পড়লাম, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘অসম্ভব নয়। তবে কাজটা কঠিন। এটা করতে হলে শর্তহীনভাবে কিছু কাজ ইসির ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এসব শর্ত না মানলে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন হবে।’ আমরা কিছু কাজের তালিকাটা চাই। তিনি এটা এমন এক প্রেক্ষাপটে বলেছেন, যখন ক্ষমতাসীন দল অনুসন্ধান কমিটিতে নতুন সিইসির জন্য তাঁর নাম পাঠিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের পর সেনা মোতায়েন প্রশ্নে তিনি প্রথমে সংবিধান লঙ্ঘনের কথা বলে পরক্ষণেই অবস্থান পাল্টিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সেনা চাওয়াটা তাঁদের হঠকারি সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি সরকারের মুখ রক্ষা করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ে সার্চ কমিটির ধারণা ইসিই প্রথমে দিয়েছিল। তারা যেভাবে বলেছিল, সেটি বর্তমান কমিটির চেয়ে অনেক উন্নত প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু সেটা সরকারি দল নেয়নি। শুধু কাঠামোটা নিয়েছে এবং ফাঁকিটা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
একইভাবে আমরা হয়তো দেখব, কিছু মন্ত্রণালয় হয়তো ইসির ‘অধীনে’ এসেছে। কিন্তু তা কাজ করছে না। মূল কথা হলো, নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার কী হবে। এই একটি প্রশ্নের জবাব পেলেই অন্য সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া সহজ হবে।
সরকারি দল চাইলে পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায় নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারও করা সম্ভব। তিন মাস আগে সংসদ ভেঙে যাবে। রাষ্ট্রপতি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন। তার আগে নির্বাচন কমিশন একাধিক আসনে উপনির্বাচন করে ‘অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়কের’ স্থলে নির্বাচিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ পথ সুগম করতে পারে। এবং তাতে সাপও মরবে, আবার লাঠিও ভাঙবে না। কিন্তু আমাদের রাজনীতি সম্ভবত সেদিকে যাবে না। যাবে একতরফা নির্বাচন কিংবা জ্বালাও-পোড়াওনির্ভর কথিত ‘গণ-অভ্যুত্থানের’ দিকে।
তাই বলি, ‘কিছু মন্ত্রণালয়ের দরকার কী। মন্ত্রিসভা বিভাগকে দরকার কী। শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সমঝোতার মাধ্যমে যে ইসি গঠিত হবে, তাকে দিন, কিংবা সমঝোতার তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর হাতে ইসির ক্ষমতা দিন, তাহলে ‘ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে’!

 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com